দিল্লির দাঙ্গায় ত্রিশটা প্রাণ ঝরে গেছে সত্যি, পাঁচশোটা প্রাণ বেঁচে যাওয়ার গল্পও কিন্ত জমে গেছে এরই মধ্যে। শিব বিহারের প্রেমকান্ত বাঘেলের গল্পটা এই তালিকায় অনন্য এক সংযোজন।

দিল্লি জ্বলছে ক্ষোভ আর ধর্মের আগুনে, মসজিদ ভাঙচুর হয়েছে, মিনারে চড়ানো হয়েছে হিন্দুত্বের প্রতীক গেরুয়া পতাকা, পোড়ানো হয়েছে কোরআন শরীফ। সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর হামলা হচ্ছে দেদারসে, বাসা-বাড়ি আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে করা হচ্ছে অগ্নিসংযোগ। সেরকমই একটা হামলায় আগুনের ভেতরে আটকে পড়া ছয়জন মুসলমানকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের জীবনটাকেই হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছেন প্রেমকান্ত। শরীরের সত্তর শতাংশ পোড়া নিয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন তিনি, তবুও ঠোঁটের কোণে মুচকি একটা হাসি ফুটে আছে তার- ছয়জন মানুষের সবাইকে যে তিনি বাঁচাতে পেরেছেন! 

দিল্লির শিব বিহার এলাকার বাসিন্দা প্রেমকান্ত বাঘেল। ছোটবেলা থেকেই প্রতিবেশি হিসেবে হিন্দু-মুসলিম দুই ধর্মের মানুষকেই পেয়েছেন, কখনও মুসলমানদের নিজেদের চেয়ে আলাদা করে দেখার কথা মাথায় আসেনি। এর আগেও ভারতে দাঙ্গা হয়েছে, গুজরাট পুড়েছে, পুড়েছে মুম্বাই- সেসবের আঁচ দিল্লিকে খুব একটা স্পর্শ করতে পারেনি। কিন্ত এবার আগুনের কেন্দ্রবিন্দুটাই দিল্লিতে, আচমকাই চারপাশের চেনা পরিবেশটা বদলে যেতে দেখলেন, পরিচিত অনেকের চোখে দেখলেন মুসলমানদের জন্যে ঘৃণা আর জিঘাংসা- মুসলিমদের কারো কারো মধ্যেও হিন্দুদের প্রতি অবিশ্বাস। 

গতকাল হটাৎই হইচই শুরু হয়েছিল এলাকাজুড়ে, কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রেমকান্ত আবিস্কার করেছিলেন, তাদের আশেপাশে কয়েকটা বাড়ি জ্বলছে, সেগুলোর প্রতিটাতেই মুসলমানেরা থাকেন। বেছে বেছে সংখ্যালঘুদের বাড়িতেই দেয়া হয়েছে আগুন। সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন প্রেমকান্ত, এলাকার লোকজনও তখন জড়ো হয়ে গেছে। কয়েকজন মিলে ধাওয়া দিলেন দাঙ্গাবাজদের, প্রেমকান্ত এগিয়ে গেলেন তার এক মুসলমান বন্ধুর বাড়ির দিকে। সেই বাড়িতেও আগুন দেয়া হয়েছে। 

ক্ষোভের আগুনে জ্বলছে দিল্লি

বন্ধুটি বাড়িতে ছিল না, কিন্ত তার বৃদ্ধা মা, স্ত্রী-সন্তান সহ পরিবারের ছয়জন সদস্য তখনও বাড়ির ভেতরে, আগুনের লেলিহান শিখা ক্রমশ বাড়ছে, আর অসহায় সেই মানুষগুলো আটকা পড়ে আছেন বাড়ির ভেতরে, বের হবার পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না তারা। পাশের বাড়ির জানালা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন প্রেমকান্ত, প্রথমে বন্ধুর সন্তানদের বের করলেন, তারপর বন্ধুর স্ত্রীকে। কিন্ত বন্ধুর মাকে বের করতে গিয়েই হলো গণ্ডগোল, প্যারালাইজড ভদ্রমহিলাকে নিয়ে বের হওয়াটা একজনের কাজ নয়। কিন্ত আশেপাশে সাহায্য করার মতো কেউ নেই তখন। 

ইতিমধ্যেই প্রেমকান্তের হাত-পায়ের কিছু অংশ পুড়ে গেছে, আগুনের পরিমাণও বাড়ছে। নিজের পিঠের সঙ্গে বৃদ্ধা মহিলাকে বেঁধে অনেক কষ্টে তিনি বেরিয়ে এলেন বাড়ি থেকে  তার গায়েও ততক্ষণে ধরে গেছে আগুন, বাড়িটা থেকে বেরিয়েই জ্ঞান হারালেন প্রেমকান্ত। ততক্ষণে এলাকায় সাড়া পড়ে গেছে, পানি ঢালা হচ্ছে তার গায়ে। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার, কিন্ত কোন যানবাহন পাওয়া যাচ্ছিলো না। অ্যাম্বুলেন্সে ফোন করা হলো, রাস্তা বন্ধ থাকায় তারাও আসতে পারল না শিব বিহারে। 

এই দাঙ্গার মধ্যে নিজেদের ব্যাক্তিগত গাড়ি রাস্তায় নামাতে চাইল না এলাকার কেউ, আর তাই আগুনে পোড়া শরীরটা নিয়ে প্রেমকান্ত বাঘেল পড়ে রইলেন সারাটা রাত। যন্ত্রণায় ছটফট করলেন তিনি, তার শিয়রে বসে চিৎকার করে কাঁদলেন স্বজনেরা, কিন্ত যে মানুষটা অন্যের জন্যে নিজের প্রাণ উৎসর্গ করার ঝুঁকি নিলেন, তার জীবন বাঁচানোর জন্যে কেউ গাড়ি বের করার ঝুঁকি নিতে চাইলো না। পৃথিবীটা কি অদ্ভুত, তাই না? 

মানুষ মরছে, মানুষই মারছে

প্রেমকান্ত বাঘেলকে আজ ভোরে ভর্তি করা হয়েছে দিল্লির জিটিবি হাসপাতালে, চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার অবস্থা আশঙ্কাজনক। শরীরের সত্তর শতাংশ পুড়ে গেছে তার, চিকিৎসকেরা চেষ্টার অন্ত রাখছেন না, সেই সঙ্গে যে কোন দুঃসংনাদের জন্যে প্রস্তুত থাকতে বলে দিয়েছেন স্বজনদের। জ্ঞান আছে প্রেমকান্তের, কথাও বলতে পারছেন তিনি। বারবার খোঁজ নিয়েছেন সেই মুসলমান পরিবারটির, যে মানুষগুলোকে তিনি উদ্ধার করেছেন তারা নিরাপদে আছেন কিনা, সেটা জানতে চেয়েছেন কয়েক দফা। 

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার এই ভয়াবহতার মাঝেও মন ভালো করে দেয়া অজস্র গল্পের জন্ম হয়েছে। আক্রান্ত মুসলমানদের রক্ষার জন্যে গুরুদ্বারের দরজা খুলে দিয়েছে শিখ সম্প্রদায়, দলিতেরা রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে পাড়া, যাতে বহিরাগত কেউ তাদের মুসলমান ভাই-বোনদের ওপর হামলা করতে না পারে! একদিকে আরএসএস ক্যাডারেরা হামলা চালাচ্ছে, ভাংচুর করছে সংখ্যালঘুদের ঘর বাড়ি, পিটিয়ে মেরে ফেলছে মানুষ, আবার বিজেপিরই স্থানীয় নেতা ছুটে এসে বাঁচাচ্ছে আক্রান্ত মুসলমানের প্রাণ, বুক চিতিয়ে দাঁড়াচ্ছে আগুয়ান ভীড়ের সামনে- হিংসার সামনে জিতে যাচ্ছে মনুষ্যত্ব, জিতে যাচ্ছে ভালোবাসা- এই ছবিগুলোও দিল্লির আনাচে কানাচে ঘটছে এখন। ত্রিশটা প্রাণ ঝরে গেছে সত্যি, পাঁচশোটা প্রাণ বেঁচে যাওয়ার গল্পও কিন্ত জমে গেছে এরই মধ্যে। শিব বিহারের প্রেমকান্ত বাঘেলের গল্পটা এই তালিকায় অনন্য এক সংযোজন। 

আধার কার্ডে প্রেমকান্ত বাঘেলের নামের নিচে ধর্মের ঘরে লেখা আছে 'হিন্দু' শব্দটা। কিন্ত এই মানুষটা যা করেছেন, তাতে তাকে কোন ধর্মের বাঁধনে বেঁধে রাখাটা ভীষণ গর্হিত একটা কাজ। অন্যের জন্যে নিজের জীবন উৎসর্গ করার কত নমুনাই তো আমরা দেখেছি, শুনেছি, পড়েছি- কিন্ত প্রেমকান্ত বাঘেল যা দেখালেন, সেটার পরে এই ভ্রান্ত যুগে এসেও মানবতার ওপরে ভরসা করতে ইচ্ছে করে, মানুষের ওপর থেকে বিশ্বাসটা উঠতে চায় না।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা