মাঝরাতে তার গান বাজবে কানের পাশে, পৃথ্বীরাজের গাওয়া নজরুল সঙ্গীত গেঁথে থাকবে মাথায়- আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে... পৃথ্বীরাজ দূর ভূবনে পাড়ি জমিয়েছেন, কিন্ত তাকে ভুলে যাওয়া কী এত সহজ?

শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
কাল রাতে ফাল্গুনের রাতের আধারে
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাদ
মরিবার হল তার সাধ...

গায়ক, সুরকার, সংগীত পরিচালক- সব পরিচয়েই পরিচিত পৃথ্বীরাজের মরিবার সাধ হয়নি, লাশকাটা ঘরেও নেয়া হয়নি তাকে। তবুও কার্তিকের এক পূর্ণিমা রাতে হঠাৎই কেন যেন পৃথিবী ছাড়লেন তিনি, কাউকে কিচ্ছু না জানিয়ে, একদমই আচমকা। ভোররাতে ফেসবুকের নিউজফিড স্ক্রল করতে গিয়ে যাযাবর রাসেল আর পৃথ্বীরাজের ছোট ভাই ঋতুরাজের ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখেই ধাক্কাটা এসেছিল। ঘোর কাটতে সময় লেগেছিল অনেকটা। মনের গহীনে কোথাও যেন তৈরি হয়েছিল অসীম এক শূন্যতার। ভোরের সূর্য উঠেছে, মনের অন্ধকার এখনও কাটেনি, কমেনি হাহাকার। 

পৃথ্বীরাজ | সঙ্গীতশিল্পী, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক


অসুস্থ ছিলেন বেশ কিছুদিন ধরে। সেটা কাটিয়েও উঠেছিলেন। গতকাল রাতে স্টুডিওতে গিয়েছিলেন গান রেকর্ড করতে। স্ত্রী ফোন দিচ্ছিলেন বারবার, কেউ ফোনটা ওঠাচ্ছিল না এপাশে। আতঙ্কগ্রস্ত স্বজনেরা ভীড় জমালেন স্টুডিও রুমের বাইরে, দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সেই দরজা ভেঙ্গে পৃথ্বীরাজকে পাওয়া গেল, শরীরটা এলিয়ে পড়ে আছে চেয়ারে। দ্রুত নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে, কিন্ত ডাক্তারদের করা কিছুই ছিল না। পৃথ্বীরাজ যে আরও খানিক আগেই পাড়ি জমিয়েছেন অজানার পথে।

ভারতের পুনেতে ইকনোমিক্সে পড়ালেখা করা পৃথ্বীরাজ গান নিয়ে আলোচনায় এসেছিলেন রিয়েলিটি শো ক্লোজ আপ ওয়ান দিয়ে। প্রথম অ্যালবাম ‘ডট’ প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। উচ্চাঙ্গসংগীতে দারুণ দখল ছিল, আর সেকারণেই সংগীতপ্রেমীদের প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন দ্রুত। গানের পাশাপাশি রেডিও জকি হিসেবেও কাজ করতেন, এবিসি রেডিও এফএম ৮৯.২ এর প্রডাকশন ইনচার্জ ছিলেন পৃথ্বীরাজ। পাশাপাশি ‘সেন্টার ফর মিউজিকলজি’ নামে একটি গানের স্কুলও চালাতেন।

পৃথ্বীরাজের সঙ্গে পরিচয় ইউটিউব থেকে, চ্যানেলের নাম জিলাপি প্রোডাকশন, সেখানে তার মাদকতাপূর্ণ কণ্ঠের প্রেমে পড়েছিলাম অনেক আগে। মন খারাপের মূহুর্তগুলোতে তার কণ্ঠ, তার গান ছিল সঙ্গী। যাযাবর রাসেল বা রেহানদের গানেও সঙ্গীতায়োজন করেছেন পৃথ্বীরাজ, সেগুলোও দারুণ দর্শকপ্রিয় হয়েছে। মানুষটার গলায় আর কখনও নতুন গান শুনতে পাবো না, এটা ভাবতেই কেমন যেন লাগছে!

অকাল প্রয়াত শিল্পী পৃথ্বীরাজ


গত বছর পৃথ্বীরাজের সুর আর সঙ্গীতে রেহান গেয়েছিলেন 'বাজে ছেলে', তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল গানটা। এখনও সময়ে অসময়ে প্লে-লিস্টে বেজে ওঠে বাজে ছেলে। ভাই ঋতুরাজের সঙ্গে তার গাওয়া 'আমার সোনার বাংলা' গানের অপূর্ব সঙ্গীতায়োজন মুগ্ধতা ছড়িয়েছিল। কিংবা কলকাতার 'হাওয়া বদল' সিনেমার মনে পড়লেই গানের কভারটা, আসল গানের চেয়েও যেটা বেশি ভালো লেগে গিয়েছিল অনেকের কাছে- পৃথ্বীরাজের সঙ্গে আমাদের জমে থাকা স্মৃতির গল্প শুরু করলে তো শেষ হবার নয়। রাত ফুরিয়ে গেছে, অথচ গান ফুরোয়নি- এমন ঘটেছে কতবার!

শিল্পী হিসেবে তিনি কতটা ভালো ছিলেন, কী খুঁত ছিল তার, সেসব নিয়ে বোদ্ধারা কথা বলবেন। তার গায়কীর ভক্ত হওয়াটা বাধ্যতামূলক নয়, কিন্ত মানুষ পৃথ্বীরাজের ভক্ত হয়েছিলাম সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাশে তার দাঁড়ানোর গল্প শুনে। নিজের সুর করা গান নিয়ে অ্যালবাম বের করেছেন, সেসব অ্যালবামের টাকার পুরোটাই খরচ করেছেন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের পাশে। গান গেয়ে উপার্জন করে সেটা দিয়ে একদমই অপরিচিত একদল শিশুর মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করেছেন পৃথ্বীরাজ- স্বার্থপর এই যুগে এতখানি কে করে?

ভালো লাগার মানুষগুলো সবাই চলে যাচ্ছেন একে একে, একদম আচমকা, কোন সংকেত না দিয়ে। সাতাশ বছর বয়সে বিডিনিউজ টুয়েন্টি ফোরের সাংবাদিক দীপায়ন অর্ণবদা চলে গেলেন পরশু, গতকাল রাতে এলো পৃথ্বীরাজের চলে যাওয়ার খবর। বয়স কতই বা হয়েছিল তার? ত্রিশ? বত্রিশ? এটা কী চলে যাওয়ার সময়? আরও কত কাজ করার ছিল, গান গাওয়ার ছিল, সুর করার কথা ছিল, কত নতুন গান নিয়ে আসার কথা ছিল- সেসব না করে এভাবে চলে যায় কেউ? 

মাঝরাতে তার গান বাজবে কানের পাশে, পৃথ্বীরাজের গাওয়া নজরুল সঙ্গীত গেঁথে থাকবে মাথায়- আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেব না ভুলিতে... পৃথ্বীরাজ দূর ভূবনে পাড়ি জমিয়েছেন, কিন্ত তাকে ভুলে যাওয়া কী এত সহজ? মাদকীয় কণ্ঠ আর সুরের ইন্দ্রজাল দিয়ে মনের ভেতরে যিনি আসন তৈরী করেছেন, তাকে কি ভুলে যাওয়া যায়?


ট্যাগঃ

শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা