আজ আমরা এমন দুটি ব্র্যান্ড টার্মের পার্থক্য জানবো, যার ব্যাপারে অনেক মার্কেটারই পরিস্কার ধারণা রাখেন না, কিংবা অনেকেই দুটো টার্মকে একই জিনিস বলে মনে করে থাকেন। আর সেটি হলো- প্রোডাক্ট রিকল আর প্রোডাক্ট উইথড্রয়াল। এ দুটোর ভেতরে পার্থক্য কী?

ধরুন, আপনি বাজারে আপনার প্রোডাক্ট ছেড়েছেন। হঠাৎ করে কয়েকজন কাস্টমার ফেসবুকে ছবি আর ভিডিওসহ পোষ্ট করে অভিযোগ করা করলো, আপনার পণ্য ব্যবহার করে তাদের গুরুতর সমস্যা হয়েছে। আপনি পরবর্তীতে ঘটনা খতিয়ে দেখলেন যে, আসলেই আপনার প্রোডাক্টে বড় ধরনের ঝামেলা রয়েছে। কিন্তু প্রোডাক্ট তো অলরেডি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এখন কী করবেন?

বড় ধরনের ক্ষতি আপনার সামনে অপেক্ষা করছে, কিন্তু কিছু করার নাই। দুর্নাম আর আইনী ঝামেলা এড়াতে আপনার সামনে একটা পথই খোলা আছে, আর সেটা হলো- সারা দেশে ছড়িয়ে পরা সেই পণ্যগুলো বাজার থেকে প্রত্যাহার করে নেয়া।

যদিও আমাদের দেশে এইরকম নজির খুবই কম; অনেক অবৈধ ও প্রচন্ড রকম ঝুকিঁপূর্ণ পণ্যও বাজারে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে, কেউ কখনই সেগুলো প্রত্যাহার করেনি। এই দেশে এই টার্মটাই হয়তো হাস্যকর। কিন্তু সামনে কঠিন দিন আসছে ইনশাল্লাহ। বাজার থেকে অবৈধ পণ্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হবে দেশীয় সকল কোম্পানীকে, খুব শীঘ্রই কঠিন আইন আসছে, বিশেষ করে খাদ্যপণ্যগুলোর জন্য।

যা হোক, এতক্ষণ পড়লেন ভূমিকা। এবার আসল কথায় আসি। আজ আমরা ব্র্যান্ডের এমন দুটি পার্থক্য জানবো, যেটার ব্যাপারে পরিস্কার ধারণা অনেকে মার্কেটারই রাখেন না, কিংবা অনেকেই দুটো টার্মকে একই জিনিস বলে মনে করে থাকেন। আর সেটি হলো 'প্রডাক্ট রিকল (Product recall)' আর 'প্রডাক্ট উইথড্রয়াল (Product withdrawal)', এ দুটোর ভেতরে পার্থক্য কী?

যদিও এটা মার্কেটারদের চাইতে ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি ও ব্র্যান্ড মালিকদের ভালো করে জেনে রাখা উচিত, কারণ দেশের ভেতরে সমস্যা না হলেও ভিনদেশে শুধু এই দুইয়ের মাঝে পার্থক্য না জানার কারণে মোটা অংকের জরিমানা গুনতে হতে পারে, এমনকি কপাল খারাপ থাকলে কোম্পানির লাইসেন্সও বাতিল হয়ে যেতে পারে।

এই দুইয়ের মাঝে বহুলাংশে মিল থাকলেও খানিকটা পার্থক্য আছে, ঐ নকল পণ্যের ব্র্যান্ড টার্মগুলোর মতোই। আমি খুব সংক্ষেপে ও মোটা দাগে সেই পার্থক্যগুলো বলার চেষ্টা করবো। এবং অবশ্যই বেশ কয়েকটা উদাহরণ ও সংক্ষিপ্ত কেস স্টাডি থাকবে। বিশেষ করে, আজকের টার্ম দুটো সহজে বুঝতে হলে বাস্তব জীবনে ঘটে যাওয়া উদাহরণের কোন বিকল্প নাই।

(i) প্রোডাক্ট রিকল (Product recall)- একটা পণ্য যখন সমগ্র সাপ্লাই চেইন ও ডিসট্রিবিউশন চ্যানেল থেকে (এমনকি পারলে ক্রেতাদের ঘরে ঘরে গিয়ে হলেও) প্রত্যাহার করা হয়, তখন তাকে বলে প্রডাক্ট রিকল। এটা সাধারণত ঘোরতর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি (Severe Health Hazard) এর আশংকায় করা হয়। মানে যখন কোন পণ্য ক্রেতাদের মারাত্নক স্বাস্থ্য ঝুঁকির ভেতর ফেলে দেয়, তখনই প্রডাক্ট রিকল করা হয়। বাজারে যেন এইরকম আর একটা পন্যও কেউ কখনো খুঁজে না পায়, সেটা নিশ্চিত করাই তখন ঐ পন্য উৎপাদকের মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়াঁয়।

পৃথিবীর অধিকাংশ বড় বড় কোম্পানীরই প্রডাক্ট রিকল করে কোটি কোটি টাকা লোকসান দেবার ইতিহাস রয়েছে। যেমন- কয়েক বছর আগে জাপানের বিখ্যাত অটোমেটিভ পার্টস নির্মাতা প্রতিষ্ঠান 'তাকাতা করপোরেশন' তাদের তৈরী গাড়ীর এয়ারব্যাগ প্রত্যাহার করে নিয়েছিলো প্রায় ১ কোটি ইউনিট গাড়ী থেকে! কারণ, প্রচন্ড গরম আর বায়ুর চাপে এয়ার ব্যাগগুলো একসিডেন্টের সময়ই বিস্ফোরণ করছিলো। চিন্তা করেন, এমনিতেই রোড একসিডেন্ট, তার উপর আবার স্বয়ংক্রিয়ভাবে এয়ার ব্যাগ বিস্ফোরণ- কতটা ভয়াবহ ছিলো এই কেইস!

তাছাড়া কয়েক বছর আগে ব্যাটারি অতিরিক্ত গরম হয়ে আগুন লাগার কারণে স্যামসাংয়ের কয়েক কোটি ইউনিট মোবাইল ফোনের প্রডাক্ট রিকলের ঘটনা তো আমরা সবাই কম-বেশী জানি, তাই না?

পৃথিবীতে সবচাইতে বেশী প্রডাক্ট রিকল করা হয় খাদ্যপণ্য আর শিশুপণ্যে। ২০০০ সালে প্রায় ৩ লাখ প্লাষ্টিকের খেলনা আমেরিকার বাজার থেকে প্রত্যাহার করতে কোম্পানিকে (খেলনাগুলো তারা চায়না থেকে আমদানি করতো) বাধ্য করেছিলো আমেরিকার সরকার, কারণ খেলনার রংয়ে বাচ্চাদের শরীরের জন্য ক্ষতিকর লেড উপাদান পাওয়া গিয়েছিলো। এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে পরবর্তীতে আমেরিকার আর কোনো কোম্পানি এই ভুল করেনি।

(ii) প্রোডাক্ট উইথড্রয়াল (Product withdrawal)- এটা রিকলের মতো অতটা সিরিয়াস না। কোন কোম্পানি যখন তুলনামূলক মাইনর কোন ইস্যুতে শুধুমাত্র তাদের সাপ্লাই লাইন থেকে পণ্য প্রত্যাহার করে (যেমন- পণ্যের ওজনের মাপ ভুলে দেয়া আছে প্যাকেটের গায়ে, কিংবা পন্যের মূল্য ভুল ছাপা হয়েছে), তখন তাকে বলে প্রডাক্ট উইথড্রয়াল। এক্ষেত্রে কোম্পানি সাধারনত নিজেরাই নিজেদের প্রডাক্ট উইথড্রয়ালের কারণ খুজেঁ বের করে থাকে।

পন্য শুধুমাত্র সাপ্লাই চেইন থেকে প্রত্যাহার করা হয় বলে ভুল ওজন কিংবা মূল্যবান উল্লেখ করা পন্যগুলো হয়তো তখনো দোকানের সেলফে থেকে যায়। ওটা কোম্পানি প্রত্যাহার করে না, কারণ ওটা প্রত্যাহার করে সঠিক ওজন বা মূল্যমান বসাতে যে পয়সা তাকে খরচ করতে হবে, এক্সিসটিং ডিফেকটিভ পন্য বিক্রি করে লোকসান হবে তার চাইতে অনেক কম।

একটা কোম্পানির চূড়ান্ত দায়িত্বজ্ঞানহীনতা প্রকাশ পায় এইরকম ঝুঁকিপূর্ণ পন্য উৎপাদনের ঘটনায়, তাই তড়িঘড়ি করে তারা পন্য প্রত্যাহার করে। যদিও এটি করতে ইটসেলফ প্রচুর পরিমানে আর্থিক ক্ষতি গুনতে হয় সংশ্লিষ্ট কোম্পানীকে। যেমন-

১. প্রত্যাহার করার নোটিশের খরচ- প্রেস কনফারেন্স করতে হয়, মিডিয়াতে বিজ্ঞাপনও দিতে হয়।

২. পণ্য প্রত্যাহার করার খরচ- কোম্পানি নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে গাড়ী পাঠিয়ে আবার সেগুলো নিয়ে আসে ফ্যাক্টরিতে। এজেন্টদেরকে তাদের পয়সাও ফেরত দিতে হয়।

৩. গবেষণার খরচ- ল্যাবটরিতে টেষ্ট করতে হয়, খুজেঁ বের করতে হয় আসলেই ঝামেলাটা কোথায় হয়েছে।

৪. আইনি খরচ- সরকার থেকে উকিল নোটিশ পাঠানো হয়, ঝুকিঁপূর্ণ পণ্য উৎপাদন করে তারা সরকারী আইন ভঙ্গ করেছে, সে সব সামলাতে হয় আইনগতভাবেই।

৫. ভোক্তাকে প্রদেয় জরিমানার খরচ- আর যদি কোন ক্রেতা বা ভোক্তা মামলা করে বসে, তাহলে তো কথাই নাই!

এই প্রসংগে ২০০৪ সালে ঘটা Vioxx এর ঘটনা মনে পড়ছে। বিশ্বের ইতিহাসে খুব সম্ভবত আমেরিকার Merck & Co. কে সবচাইতে বেশী জরিমানা দিয়ে পন্য রিকল করতে হয়েছে। তাদের বানানো ওষুধ Vioxx এর বিরুদ্ধে ২৭,০০০ ভুক্তভোগী মামলা করেছিলো, Vioxx সেবনের পর এদের সবারই নাকি হার্ট এট্যাকের হার বেড়ে গিয়েছিলো।

আদালতে এই অভিযোগ প্রমান হওয়ার পর Merck & Co. কত টাকা জরিমানা দিয়েছিলো জানেন? প্রায় ৫ বিলিয়ন ইউএস ডলার! বাংলাদেশে টাকায় প্রায় ৪২,২৫৩ কোটি টাকা (current value)। Merck & Co. এর মতো ডাকসাইটে কোম্পানিরও এরপর প্রায় ২ বছর লেগেছে আবার নতুন করে উঠে দাঁড়াতে।

৬. সুনামের হানি- এইটা ঠিক টাকার অংকে পরিমাপযোগ্য নয়। তবে কোম্পানি মার্কেট শেয়ার হারায়, শেয়ার বাজারে দরপতন হয়, স্টার্টাপ কোম্পানি হলে ভ্যালুয়েশন কমে যায় রাতারাতি। সে সব অবশ্য টাকার অংকে মাপা যায়।

সব মিলিয়ে, কোন কোম্পানি তার পণ্যকে রিকল করেছে মানে সেই কোম্পানির উপর মোটামোটি আল্লাহর গজব নেমে এসেছে বলে ধরা হয়। বড় কোম্পানি হলে সেই ধকল সামলে নিতে পারে। ছোট কোম্পানি হলে নির্ঘাত পথে বসে যায়, আর মাঝারি কোম্পানি হলে পথে হয়তো বসতে হয় না, কিন্তু সেই কোম্পানির আবার নতুন করে উঠে দাঁড়ানোটাও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এই কারণে, বিদেশে প্রায় সব প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানই মাসে মাসে কাড়ি কাড়ি টাকা রিকল-ইন্সুরেন্স প্রিমিয়াম বাবদ দিয়ে থাকে।

অষ্ট্রেলিয়াতে আমি নিজের চোখেই দেখেছি একটা দেশের সরকার কী পরিমান কড়া হতে পারে এই বিষয়ে। তবে তারা কিছু সুবিধাও দেয়, যেমন- আমেরিকার মতো হুট করেই আগেই জরিমানা দিয়ে বসে না, কোম্পানিকে তারা আগে সুযোগ দেয়, যাচাই করে দেখে যে সত্যিই কোম্পানির এখানে আন্তরিকতা আছে কিনা। এই কারণে, পন্য প্রত্যাহারের মতো ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা দেখলেই যে কোন কোম্পানি অষ্ট্রেলিয়ান কনজিউমার কমিশনকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারে যে “আমার পণ্যে অমুক সমস্যা হয়েছে, আমি কি রিকল করবো, নাকি শুধু উইথড্র করলেই চলবে?”

তখন কমিশন সেই বিষয়ে কোম্পানিকে বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে হেল্প করবে। কিন্তু কমিশনের পরামর্শ মোতাবেক না চললে তখন কমিশনই কড়াকড়ি আইনী পদক্ষেপ নেয় কোম্পানির বিরুদ্ধে। যেমন- কমিশন বললো প্রোডাক্ট রিকল করতে, কিন্তু কোম্পানি তাদের খরচ বাচাঁতে করলো উইথড্র, তাহলে মামলা খাবে অতি অবশ্যই, এবং সে মামলায় উক্ত কোম্পানি অবধারিতভাবে হারবে।

তথ্যসূত্র: Investopedia, Business Insider

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন

আরও পড়ুন-


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা