
বুকে হাত দিয়ে বলেন তো, পড়াশোনা বা কাজের জন্য ঢাকায় একা আসা একজন নারী, যার ঢাকায় পরিচিত কেউ নেই, তার জন্য এত বড় শহরে একটা নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যে থাকার জায়গা খুঁজে পাওয়াটা কতটা সহজ?
ঢাকা শহরে বর্তমানে প্রায় ২ কোটি মানুষ বাস করে, প্রতিদিনই নতুন নতুন চোখ ধাঁধানো অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং গড়ে উঠছে। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলেন তো, পড়াশোনা বা কাজের জন্য ঢাকায় একা আসা একজন নারী, যার ঢাকায় পরিচিত কেউ নেই, তার জন্য এত বড় শহরে একটা নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যে থাকার জায়গা খুঁজে পাওয়াটা কতটা সহজ? না, সহজ না। অসংখ্য নারী আছেন আমাদের দেশে যাদের ঢাকার বাইরে থেকে ভালো কোন প্রতিষ্ঠানে পড়ার বা কাজ করার অনুমতি পান না শুধুমাত্র নিরাপত্তার ইস্যুতে। হ্যাঁ, ঢাকায় মহিলা হোস্টেল আছে, কিন্তু ঢাকার বাইরে থেকে এসে এরকম হোস্টেলগুলোতে খুঁজে খুঁজে সিট নেওয়া কতটা কঠিন সেটা অনুমান করাই যায়। আর এসব হোস্টেলের পরিবেশ, খাওয়া দাওয়া কী মানের, যারা ভুক্তভোগী তারাই জানেন।
যে মেয়েটা মাত্র ২-৩ মাস সময় হাতে নিয়ে ঢাকায় এসেছে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে, তার যদি নতুন জায়গায় উঠে নানা ইস্যু সামলাতে আর মানিয়ে নিতেই সংগ্রাম করা লাগে তাহলে সে আর পড়বে কখন? যে নারীটি সারাদিন অফিসে থেকে ক্লান্ত শরীরে বাসায় ফিরেন, তিনি যদি দেখেন খাবার ঠিক নেই, কাপড় চোপড় নিজেরই ধোয়া লাগছে, অপরিষ্কার পরিবেশে থাকা লাগছে, উনি আবার দিনের পর দিন কীভাবে কাজে যাবেন নিজের সেরাটুকু দিতে?
এসব চিন্তা মাথায় নিয়েই 'প্রজেক্ট সেকেন্ড হোম' এর পথ চলা শুরু। ঢাকায় একা থাকতে আসা নারীদের জন্য আক্ষরিক অর্থেই একটা 'সেকেন্ড হোম' দিতেই এই উদ্যোগ। বাকি সব তথাকথিত মহিলা হোস্টেলের সাথে প্রধান পার্থক্য হলো- এটা শুধু দায়সারা একটা থাকার জায়গা আর ৩ বেলা নাম কা ওয়াস্তে খাবার দেওয়াটাকেই সবকিছু ভাবে না। বরং এই সেকেন্ড হোম চিন্তা করে সেখানে থাকতে আসা প্রতিটি মেয়ে যেন সত্যি সত্যিই নিজের একটা আপন ঘর খুঁজে পায়, যে উদ্দেশ্যে ঢাকায় এসেছে, তার জন্যই পুরোটা সময় ও মনোযোগ দিতে পারে, থাকার পরিবেশ ও খাবার বা অন্য কোন কিছু নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথায় টেনশন না নিতে পারে।

তো, কী করে এই সেকেন্ড হোম? প্রথমত ঢাকার সুন্দর লোকেশনে ভালোমানের অ্যাপার্টমেন্টের ফ্লাট ভাড়া নিয়ে সেটাকে মনোরোম ভাবে ডেকোরেশন করা হয়। সেরা মানের বেড, ডেস্ক, আলমারি ইত্যাদি পার্সোনাল ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়। এছাড়াও প্রতিটি ব্রাঞ্চে সবার কমন ইউজের জন্য ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রো ওভেন, টোস্টার, ফ্রিজ, স্বয়ংস্ক্রিয় ইলেক্ট্রিকাল ওয়াটার ফিল্টার, ফুল ইকুইপড রান্না ঘর, আলাদা স্টাডি রুম, নামাজ পড়ার ঘর সহ আরো অনেক ফ্যাসিলিটি থাকছে।
খাবারের ব্যাপারে সেকেন্ড হোম খুবই কড়াকড়ি কারণ আমাদের দেশের মেয়েরা নিজেদের খাওয়া দাওয়া নিয়ে একটু বেশিই খামখেয়ালি থাকে, যার রেশ বয়স বাড়লে টানতে হয়। প্রজেক্ট সেকেন্ড হোম তার সদস্যদের জন্য তিনবেলা খাবার সরবরাহ করে তাদেরই আরেক সহযোগী প্রতিষ্ঠান “Pocket Friendly Catering” এর সেন্ট্রাল কিচেন থেকে। মানে একটা জায়গায় সব ব্রাঞ্চের জন্য রান্না হয় এবং তা নিজস্ব কর্মীবাহিনী যথাসময়ে প্রতিটি ব্রাঞ্চে পৌছে দেয় সুদর্শন লাঞ্চ বক্সে। খাবারের আইটেমগুলোতে থাকে বৈচিত্র্য ও নানাধরনের শাক-সবজী যেগুলো গতানুগতিক হোস্টেলে পাওয়া যায় না।

জীবন নির্ঝঞ্ঝাট করতে প্রতিটা ব্রাঞ্চে প্রতিদিন পরিচ্ছনতাকর্মী এসে সব কিছু ঝাড়ু দিয়ে ধুয়ে মুছে যায়, যাদের সাথে সেকেন্ড হোমে থাকতে আসা মেয়েদের কোন রকম ইন্টারেকশনের দরকার হয় না। অর্থাৎ কাজের বুয়াদের হ্যান্ডেল করার ঝামেলা নেই। সমস্যা হলে সরাসরি ম্যানেজমেন্টকে কমপ্লেইন করলেই হয়। কাপড়চোপড় ধোয়ার জন্য প্রতিটা ব্রাঞ্চে আছে ওয়াশিং মেশিন। সারাদিন পরিশ্রমের পর আবার কাপড় ধোয়ার যন্ত্রণা নেই। সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ২৪ ঘন্টা দারোয়ান, সিসিটিভি ক্যামেরা ও ফিঙ্গারপ্রিন্ট লকের ব্যবস্থা আছে। মোদ্দা কথা, একটা নিরাপদ নিশ্চিন্ত জীবন যাপনে যা যা প্রয়োজন সবই থাকছে এখানে, আর সবকিছু- থাকা, খাওয়া, ওয়াইফাই, বিদ্যুত, পানি, গ্যাস সবকিছু মিলিয়ে ভাড়া শুরু হয়েছে মাত্র ৬৫০০/- থেকে। কেউ আরো বেশি স্বাচ্ছন্দে থাকতে চাইলে আরো বেশি ভাড়ায় প্রিমিয়াম সিট বা সিংগেল রুমও আছে।

পরিবেশ অনেক বড় একটা ব্যাপার। অপরিচ্ছন্ন নোংরা পরিবেশে থাকলে মন মেজাজ কিংবা শরীর কিছুই ভালো থাকে না। প্রজেক্ট সেকেন্ড হোম তাই তাদের ডেকোরেশনের উপর জোর দেয়। বিছানার চাদর, বালিশের কভার, জানালার পর্দা সবকিছুই নিজেদের ডিজাইনে বানানো হয়। আর একাজের জন্য আছে আফ্রেদিতি নামে আরেক সহকারী প্রতিষ্ঠান। সেখানে এসব জিনিস বানানোর কাজে নিয়োজিত থেকে কর্মসংস্থান হচ্ছে অনেক নারীরও। প্রজেক্ট সেকেন্ড হোম, পকেট ফ্রেন্ডলি ক্যাটারিং বা আফ্রেদিতি- সব কিছুই চলছে আরটেমিস লিমিটেড নামক একটা প্রতিষ্ঠানের আয়ত্বে, যার কর্ণধার সুমনা শারমিন। তিনি CEO হিসেবে দুর্দান্তভাবে এই প্রতিষ্ঠানগুলো শূন্য থেকে গড়েই তুলেননি, একই সাথে তাঁর প্রতিটি ব্র্যান্ডের নেতৃত্বে রেখেছেন নারীদের।

আরটেমিস লিমিটেডের আরো কিছু ব্র্যান্ড হলো অরিজিনাল লেদার পণ্য নিয়ে কাজ করা ‘লেদার বি’, ফ্যাশন পণ্য নিয়ে কাজ করা ‘দ্যা থ্রেড স্টোরি’, ছেলেদের জন্য ডরমেটরির উদ্যোগ “দ্যা ড্রিম হাউজ বিডি’ ইত্যাদি। নারীদের জন্য শুধু মুখে বর বড় বুলি ছেড়ে নয়, এই আরটেমিস গ্রুপ আক্ষরিক অর্থেই নারীদের নেতৃত্বে রেখেছে, তাদের স্বনির্ভর হতে নিরাপদ নিশ্চিন্ত বাসস্থানের ব্যাবস্থা করেছে, এমনকি নারীদের পছন্দ অনুযায়ী বিভিন্ন কর্মমুখী বিষয়ে হাতে কলমে শিক্ষা দেওয়া হয়, তাদের সরাসরি কর্মসংসথান কিংবা তারা নিজেরাই উদ্যোক্তা হতে চাইলে প্রাথমিক পুঁজির ব্যবস্থা করে দেয় আরটেমিস।
আলাপকালে সুমনা শারমিন জানান, তিনি নিজে শুধুমাত্র ঢাকায় একটা নিরাপদ বাসস্থানের অভাবে জীবনে অনেক বড় সুযোগ হারিয়েছেন। নিজের সেই যন্ত্রণা থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা থেকেই তিনি জানেন, এরকম একটা উদ্যোগ ঢাকায় কত দরকার। আপাতত তাদের ব্রাঞ্চ মূলত শ্যামলী ও ধানমন্ডি এলাকাকে কেন্দ্র করেই পরিচালিত হচ্ছে। তাদের কাছে এখন প্রচুর নারী প্রতিদিন খোঁজ নিতে আসে, ঢাকার প্রতিটি এলাকায় রয়েছে তাঁদের প্রজেক্ট সেকেন্ড হোমের চাহিদা। কিন্তু পর্যাপ্ত ইনভেস্টের অভাবে তাঁরা চাহিদা অনুযায়ী তাদের ব্র্যাঞ্চের সংখ্যা বাড়াতে পারছেন না। যদি তাঁরা পর্যাপ্ত ফান্ডিং পেতেন তবে মিরপুর, বারিধারা, ফার্মগেট, বনানী, গুলশান ইত্যাদি এলাকাতেও তাদের ব্রাঞ্চ খোলা যেত, এসব এলাকায় প্রচুর চাহিদা ভালোমানের একটা মেয়েদের থাকার জায়গার। তিনি আশা করেন সমাজের বিত্তবানরা তাঁর এই প্রজেক্টে ইনভেস্ট করতে এগিয়ে আসবেন। ফলে তাদের অলস টাকাগুলো পড়ে না থেকে লাভজনক ব্যবসায় খাটবে এবং তাঁর এই প্রজেক্টও আকারে বড় হতে পারবে। আরো অনেক নারীর স্বপ্ন অর্জনে, স্বাবলম্বী হওয়ায় পাশে থাকতে পারবে আরটেমিস!