"ভালো অভিনেতা হবার লোভে আমি আমার স্ত্রীকে সময় দেইনি, ছেলেকে ভ্যাকেশানে বেড়াতে নিয়ে যাইনি, সব ওই 'অভিনেতা প্রসেনজিত' ব্র্যান্ডটার জন্যে..."
কলকাতায় চোখের বালি'র প্রিমিয়ার শো শেষ হয়েছে। আমন্ত্রিত অতিথিরা বেরিয়ে আসছেন একে একে। সবাই গিয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছেন সিনেমার পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ আর অভিনেতা প্রসেনজিত চট্টোপাধ্যায়কে। আরেক বিখ্যাত পরিচালক হরনাথ চক্রবর্তীও এসেছিলেন শো'তে। তার সঙ্গে প্রসেনজিতের খুব ভালো সম্পর্ক। প্রায় তুই তোকারী পর্যায়ের। তিনি একপাশে ডেকে নিলেন প্রসেনজিতকে, বললেন- "এ শালা বুম্বা, তুই তো ভয়ানক অ্যাক্টিং করিস! এত ছবি করলাম একসঙ্গে, তোকে তো অমন চেহারায় কোনদিন দেখিনি রে!"
প্রসেনজিত নিজেও কথাটা স্বীকার করেন। চোখের বালি করার পরেই প্রথমবার তাঁর মনে হয়েছিল, অভিনেতা বলে একটা সত্ত্বা বাস করে তাঁর ভেতরে। এর আগে যেগুলো করেছেন, সেগুলো আবর্জনা নয় তাঁর কাছে, তবে সেসব ছিল সময়ের প্রয়োজনে। কিন্তু তাঁর ভেতরের অভিনেতা স্বত্ত্বাটা জাগিয়ে তুলেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ নামের আধপাগল এক পরিচালক।
যে প্রসেনজিত একটা সময় রোবটিক এক্সপ্রেশন ধরাবাঁধা অভিনয় ছাড়া কিছুই পারতেন না, কিংবা করতেন না, সেই মানুষটাকে নিয়েই ঋতুপর্ণ একে একে বানিয়ে ফেললেন চোখের বালি, সব চরিত্র কাল্পনিক, নৌকাডুবি... প্রসেনজিতের বদলে যাওয়ার শুরুটা হয়েছিল সেই ঋতুপর্ণের হাত ধরেই।
এর আগের গল্পটা ভীষণ একঘেয়ে, একদমই ক্লিশে। খুব একটা নতুনত্ব নেই কোথাও। বাবা অভিনেতা, টালিগঞ্জের দাপুটে নায়ক, ছেলেও বাবার পথেই হাঁটবেন, এ আর এমন কী! টালিগঞ্জ যে বছর উত্তম কুমারকে হারালো, সেই বছরই নায়ক হিসেবে রূপালী পর্দায় অভিষেক হলো প্রসেনজিত চট্টোপাধ্যায়ের। শুরুটা খুব আশা জাগানীয়া নয়, আবার ফেলে দেয়ার মতোও নয়।
বক্স অফিসে হিট ছিল, সুপারহিটও দিয়েছেন। তবে সবচেয়ে বড় সাফল্যের দেখা পেয়েছিলেন অভিষেকের সাত বছরের মাথায় এসে- সিনেমার নাম অমর সঙ্গী। 'চিরদিনই তুমি যে আমার' শিরোনামের একটা গানই যে পরিমান তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা পেয়েছিল, সেটার কোন তুলনা নেই। ভক্ত তো আগে থেকেই ছিল, এবার খ্যাতির জোয়ারে ভাসতে শুরু করলেন প্রসেনজিত।
পশ্চিম বাংলায় তখন একজনই নায়ক, লোকে বুম্বাদা বলতে অজ্ঞান। বাড়ির সামনে প্রযোজক-পরিচালকদের লাইন, একসঙ্গে পাঁচ-সাতটা ছবিতে সাইন করছেন তিনি। ইন্ডাস্ট্রি তখন একটা পালাবদলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, প্রেমের ছবি, নাচ-গান আছে এমন সিনেমাগুলো কমার্শিয়ালি ভীষণ হিট হচ্ছে। সেসব সিনেমার পরিচিত রেসিপি- প্রসেনজিতকে নাও, একটা-দুটো নায়িকা রাখো, চারটে গান, দুটো ফাইট সিকোয়েন্স- দেখবে সিনেমা হিট!
কোয়ান্টিটির ভীড়ে কোয়ালিটিটা হারিয়ে গিয়েছিল বেমালুম। প্রসেনজিত অবশ্য সেগুলোকে 'মানহীন' তকমা দেন না কখনও। শত হলেও, নিজের কাজ তো! তার কথা হচ্ছে-
"আমি সিনেমায় এসেছিলাম পেটের ভাত জোগাতে, আমাকে আমার পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। আর ইন্ডাস্ট্রিতে আট-দশ বছর কাটিয়ে ফেলার পরে দেখলাম, পুরো ইন্ডাস্ট্রি আমার ওপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সেই সময়ে আমি সিনেমাগুলো না করলে হল বন্ধ হয়ে যেতো, ইন্ডাস্ট্রিটাও হয়তো কোথাও গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়তো খানিকটা। কারণ আমি ছাড়া আর কেউ ছিল না সেই সময়ে। আমি চ্যারিটি করিনি অবশ্যই, কিন্ত সেই সময়ে সিনেমাগুলো না করে উপায় ছিল না আমার। আমি নাহয় খেয়েপরে বেঁচে থাকতাম, কিন্ত এই ইন্ডাস্ট্রি তো আরও হাজারটা লোকের ভাত জোগায়, তাদের কী হতো?"
অনেকগুলো বছর, একটানা অনেকগুলো বছর টালিগঞ্জকে একা টেনেছেন তিনি। লোকে হয়তো টালিউড মানেই প্রসেনজিত চ্যাটার্জীকে চিনতো। রচনা ব্যানার্জী আর ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের সঙ্গে তাঁর জুটি তো কিংবদন্তীর পর্যায়ে পড়ে!
বলিউডে কাজ করেছেন, খুব একটা সফল হতে পারেননি প্রাথমিক সময়ে, বোম্বেতে গিয়ে নতুন করে সবকিছু শুরু করার ইচ্ছেটা তাঁর হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের রাজা তিনি, সেখানেই থাকতে চেয়েছেন, টালিগঞ্জকে একটা ব্র্যান্ড হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছেন। এখন, এই মধ্যপঞ্চাশে এসে প্রসেনজিত আবিস্কার করেন, ঝোঁকের মাথায় নেয়া সিদ্ধান্তটা কত বেশি ঠিক ছিল!
ভারতের সেরা অভিনেতাদের নাম নেয়া শুরু হলে অমিতাভ বচ্চন, কমল হাসান, ইরফান খান বা মনোজ বাজপাইদের সঙ্গে তাঁর নামটাও উচ্চারিত হয়, সেটা বাংলা সিনেমার অভিনেতা হিসেবেই! নায়ক থেকে অভিনেতায় রূপান্তরটা সহজ কিছু ছিল না। ঋতুপর্ণ ঘোষ যেটা আবিস্কার করেছিলেন, সেই মশালটাই বয়ে নিয়ে চলেছেন সৃজিত মুখার্জী বা কৌশিক গাঙ্গুলীরা।
অটোগ্রাফ দিয়ে অন্যরকম একজন প্রসেনজিত চট্টোপাধ্যায়কে সবার সামনে নিয়ে এসেছিলেন সৃজিত। ইকনোমিক্স ছেড়ে সিনেমায় আসা আনকোরা তরুণ সৃজিত মুখার্জী যে প্রসেনজিতের ক্যারিয়ারটাই পাল্টে দিতে এসেছেন, সেটা হয়তো কেউ ভাবতেও পারেনি। বাইশে শ্রাবণের সেই রুথলেস পুলিশ অফিসার প্রবীর রায় চৌধুরী থেকে জাতিস্মরের কুশল হাজরা আর হ্যান্সম্যান অ্যান্টনির দ্বৈত চরিত্র- শিউরে ওঠার মতো অভিনয় করেছেন প্রসেনজিত।
এই প্রসেনজিত চট্টোপাধ্যায়কেই একটা সময়ে সমালোচকেরা ধুয়ে দিয়েছেন একঘেয়ে অভিনয় আর একটানা একই ঘরানার সিনেমা করার জন্যে! সেই মানুষটা গত দশ বছরে একটার পর একটা ভিন্নরকমের সিনেমা নিয়ে এসেছেন। অপরাজিতা তুমি, চলো পাল্টাই, লড়াই, শঙখচিল, প্রাক্তন, জুলফিকার, দৃষ্টিকোণ, নিরন্তর- এই নামগুলোও আসলে প্রসেনজিতের বহুমাত্রিক অভিনয়ের সবটা বোঝাতে পারছে না পুরোপুরি।
এই পালাবদলের রহস্যটা কী? প্রসেনজিতের মতে, অভিনয়ের ক্ষিধে, যেটা আগে ছিল না। ভালো অভিনয় কী জিনিস সেটাই তিনি পুরোপুরি বুঝতেন না অনেকটা সময় ধরে। বোঝার পর থেকেই ক্ষিধেটা চেপে বসেছে। কিন্ত ভালো বাজার হলেই তো হবে না, ভালো রান্নার জন্যে ভালো রাঁধুনিও যে চাই। সেই রাঁধুনি হয়ে কখনও ঋতুপর্ণ ঘোষ এসেছেন, এখন সৃজিত-কৌশিকরা আছেন। আরেকটা জিনিস প্রসেনজিতকে পাল্টে দিয়েছে, সেটা তাঁর সেলফিশ মনোভাব। প্রসেনজিত বলে চলেন-
"ক্যামেরাটা ওপেন হলে আমি আরেকটা দুনিয়ায় হারিয়ে যাই। আমার কী টেনশন, কী করা উচিত, কী করা উচিত নয় সব ভুলে যাই। যে একটা সুইচ অফ হয়ে যায় কোথাও। ওই জায়গাটায় আমি হিটলার, আমি রুথলেস। আমি সবকিছুর সঙ্গে আপোষ করতে পারি, অভিনয়ের সঙ্গে না। আমি কখনও দাবী করবো না যে আমি খুব ভালো স্বামী, কিংবা ভালো একজন বাবা। ভালো অভিনেতা হবার লোভে আমি আমার স্ত্রীকে সময় দেইনি, ছেলেকে ভ্যাকেশানে বেড়াতে নিয়ে যাইনি, সব ওই 'অভিনেতা প্রসেনজিত' ব্র্যান্ডটার জন্যে। সেটাই আমার কাছে সবচেয়ে দামী..."
এমন দুর্দান্ত কামব্যাকের গল্প টালিগঞ্জে আর একটাও নেই। ভারতেও হয়তো দুই-একটার বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না। একসময়ের একঘেয়ে, বিরক্তিকর প্রসেনজিত চট্টোপাধ্যায় এখন পুরোপুরি বদলে গেছেন। বুম্বাদার সিনেমা মানেই এখন নতুন কিছু, একদম আলাদা কিছু। আটান্ন বছর বয়সেও তিনি ইন্ডাস্ট্রির এক নম্বর হিরো, সেরা অভিনেতাদের একজনও। ওল্ড ওয়াইনের মতো দিনকে দিন তিনি কেবল আকর্ষণীয় করে তুলছেন নিজেকে, নিজের অভিনয়কে...