সিস্টেমে কিছু পরিবর্তন আনলেই পাবলিক বাসগুলোতে এত ভোগান্তি পোহাতে হয় না যাত্রীদের। সে পরিবর্তনগুলো নিয়ে আসা যে খুব কঠিন নয়, তা এসি বাসগুলো এরই মধ্যে দেখিয়েছে। তারা পারলে তাহলে অন্যরাও কেন পারবে না?
বিকেলবেলা ফার্মগেটে দাঁড়ালেই মন খারাপ হয়ে যায়। সারি সারি অসংখ্য মানুষ এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। চোখে মুখে সারাদিনের ক্লান্তি। শেষ বিকেলের ম্রিয়মান আলোয় তাদের আরও বিষন্ন দেখায়। কেউ কারও দিকে তাকায় না। তীব্রভাবে অপেক্ষা করে বাড়ি ফেরার। অপেক্ষা এক পংখীরাজের, যাতে উড়ে ফেরা যাবে শান্তির ঠিকানায়। কিন্তু এই চোরাবালিময় যুদ্ধক্ষেত্রসম শহরে কোনও পংখীরাজ আসে না। দৈত্যর মতো তীব্রতায় ছিটকে আসে কর্কশ চেহারার বাসগুলো। শুরু হয় বাড়ি ফেরার এক শ্বাসরুদ্ধকর লড়াই।
এতোক্ষন এলোমেলো হয়ে থাকা মানুষগুলো এবার ঘন হয়ে আসে। জমাট বাধে বাসের দরজার মুখে। ছোট্ট দরজার মুখে বেয়ে নেমে আসা মানুষগুলোকে কেউ নামার সুযোগটাও দিতে চায় না। যারা ওঠার অপেক্ষায় থাকে তারা তখন প্রায় অন্ধ। নারী, পুরুষ, শিশু, বয়স্ক কোনও ভেদাভেদ নেই। কোনও ভদ্রতা নেই, দয়া নেই, বিনয় নেই। কেবল আছে হিংস্র প্রতিযোগিতা। যেভাবে হোক একহাত বা আধা হাত জায়গা পেলেই হবে। এর মাঝেই বাস চলতে শুরু করে। প্রতিযোগিতা আরও বেপরোয়া হয়, আরও বিপদজনক। শেষ পর্যন্ত দৌড়াতে থাকে মানুষ, শেষ সম্ভাবনা পর্যন্ত। কেউ কেউ হাল ছেড়ে দেয় আবার আরেক বাস পর্যন্ত অপেক্ষা করবে বলে। আর কেউ কেউ বাসের হ্যান্ডেল ধরেই ঝুলতে থাকে প্রায় শুন্যের উপরে।
বাসে ওঠা তো হলো কিন্তু স্বস্তি মিললো কি? কেউ কেউ লটারিতে পুরষ্কার জয়ের মতো পেয়ে গেছে বাসে সীট। যারা পায়নি তাদের জন্য দমবন্ধ পরিবেশ। আশেপাশে লোকের ভিড়ে শরীরটা আধ ইঞ্চিও নাড়ানো যায় না। গায়ে গায়ে লেগে থাকা মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে একে অপরের উপর। আর মেয়ে হলে তো আরও বিপদ। ভিড়ের মধ্যে কে সুযোগ নিচ্ছে তাও বোঝার উপায় নেই।
এভাবেই চলে দিনের পর দিন। মেয়েদের জন্য আলাদা করা সীটে বসে থাকে পুরুষেরা। বেশীরভাগ সময় তাদের সরে যেতে বললেই জেগে ওঠে তাদের অধিকার সচেতনতা(!)। 'মেয়েদের তো সব জায়গায় সমান অধিকার চাই, বাসে আবার আলাদা সীট লাগবে কেন' কিংবা 'মেয়েরা যখন ছেলেদের সীটে বসে তখন তো ছেলেরা তাদের উঠতে বলে না'। বিচিত্র সব মানসিকতা। ওদিকে বাস চলেছে বেপরোয়া, ব্রেক চলছে দুমদাম। বাস ভর্তি লোক তারপরেও যেকোনও জায়গা থেকে তুলতে হবে যাত্রী।
সিটিং সার্ভিস নামক আরেক ভন্ডামি চলে, যেখানে যুক্তি দেখানো হয়, একটু পর তো অন্য যাত্রী নেমে যাবে, তখন দাঁড়ানো যাত্রী বসে যাবে। আর ভাড়া নিয়ে ঝগড়া অবিরাম। বিচিত্র সব যুক্তিতে ভাড়া আদায়ে মত্ত কোম্পানিগুলো। যাত্রী-হেল্পার সম্পর্ক তাই স্বাভাবিক হয় না কখনও। ঝামেলা শুধু বাসের ভিতরেই না, চলছে বাহিরেও। যাত্রী তোলার তীব্র প্রতিযোগিতায় এক ড্রাইভার আরেক বাসের পথ আটকে রাখছে। শুরু হয়ে যাচ্ছে ড্রাইভারের সাথে ড্রাইভারের ঝগড়া। প্রকাশ্য রাস্তায় এক বাস আরেক বাস ইচ্ছে করে ঠুকে দিচ্ছে বা গায়ে ঘষা দিয়ে চলে যাচ্ছে। কখনও বিপদজনক গতিতে টার্ন নিয়ে দখল নিচ্ছে অন্যবাসের রেখে দেওয়া ছোট্ট জায়গা।
বাসের ভিতর হুমড়ি খাওয়া যাত্রীদের গালাগালিতে ভ্রুক্ষেপ নেই কারও। একসময় এই শ্বাসরুদ্ধকর যাত্রা শেষ হয়। কিন্তু নামার সময়েও কোনও স্বস্তি নেই। নামার কোনও নির্দিষ্ট জায়গা নেই। রাস্তায় পা রাখতেই সেখানে চলে আসতে পারে আরেকটি বাস। এ যাত্রায় বেঁচে গেলে পরের দিন আবার সেই একই লড়াই। এ যেনও অনন্ত গোলকধাঁধা। কিছুতেই মুক্তি নেই। অথচ পাশ দিয়ে যখন এসি বাসগুলো চলে যায়, তখন মনে হয়, আসলেই সবকিছু কি এতো কঠিন? এতো কঠিন হলে ওরা এতো সুশৃঙ্খল কিভাবে?
নাহ আসলে খুব কঠিন না। এই গোলকধাঁধার সমাধানে কোনও বিপ্লবেরও দরকার নেই আসলে। শুধু দরকার কিছু ছোট ছোট পরিবর্তন। কেমন হতে পারে সে পরিবর্তনগুলো? যেমন-
ক) সারা শহরে কিছু নির্দিষ্ট জায়গা বাসস্টপেজ থাকবে। খুব বেশি স্টপেজ ঢাকা শহরে নেই। হয়তো পঞ্চাশের আশেপাশে স্টপেজ দিলেই গোটা শহরকে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব।
খ) প্রতিটা স্টপেজে থাকবে যাত্রী ছাউনি। যেনও যাত্রীরা আরামে অপেক্ষা করতে পারেন। এবং সেসব ছাউনিতে থাকবে প্রতিটা বাস কোম্পানীর আলাদা করে কাউন্টার। যার যে কোম্পানি পছন্দ, সে সেই কোম্পানির টিকেট কাটবে। তখন প্রতিটা কোম্পানী যাত্রীদের আকৃষ্ট করতে যাত্রী সেবার মান বাড়াতে বাধ্য হবে।
গ) কাউন্টার ও টিকেট ছাড়া বাসে যাত্রী উঠানো যাবে না। ফলে যত্রতত্র যাত্রী দাঁড়িয়ে থাকবে না। টিকেট বাধ্যতামূলক হওয়ায় বাসগুলো একজন আরেকজনের যাত্রী নেওয়ার জন্য বেপরোয়া হবে না। ভাড়া নিয়ে বচসা বন্ধ হবে। সিট ছাড়া বাড়তি লোক উঠানো বন্ধ হবে। নারী যাত্রিদের হ্যারাসমেন্ট কমে আসবে।
ঘ) টিকেটের সিরিয়াল নাম্বার অনুসারে বাসে যাত্রী উঠবে। ফলে কোনওরকম তাড়াহুড়ো করা লাগবে না। যারা সিরিয়াল পাবে না তারা পরের বাসের জন্য অপেক্ষা করবে। হেল্পারদের দায়িত্ব হবে কেবল সবাই সঠিক জায়গায় নামছে কিনা সেটা দেখা।
ঙ) যারা কাজ বা চাকরির জন্য প্রতিদিন একই রুটে যান তাদের জন্য মাসিক পাস থাকবে। সেই পাসধারীরা অগ্রাধিকার পাবেন বাসে অথবা তাদের জন্য আলাদা বাসের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
চ) প্রতিটা বাস কোম্পানীর ড্রাইভার ও হেল্পারদের আলাদা ইউনিফর্ম থাকবে। সেই ইউনিফর্মে থাকবে তাদের নাম এবং সিরিয়াল নাম্বার। সাথে থাকবে অভিযোগ বক্স অথবা হেল্পলাইন ও সিসি ক্যামেরা। ইউনিফর্ম মানুষকে দায়িত্বশীল করে। একই সাথে যাত্রিদের সুযোগ থাকবে তাদের অভিযোগ জানানোর।
এই পরিবর্তনগুলো নিয়ে আসা যে খুব কঠিন নয় তা এসি বাসগুলো এরই মধ্যে দেখিয়েছে। তারা পারলে তাহলে অন্যরাও কেন পারবে না? প্রয়োজন কেবল সদিচ্ছার। সেবার মানসিকতার। সিটি কর্পোরেশন যদি এগিয়ে আসে তাহলে অল্প সময়েই কাজগুলো সম্ভব। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই সামান্য কয়েকটি সহজ কাজ করার মতো কঠিন মানসিকতার একজন লোকও কি নেই সারা শহরে? নাকি এভাবেই চলবে বছরের পর বছর আরও?
প্রিয় পাঠক, এই লেখাটি একজন কন্ট্রিবিউটর লিখেছেন। চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন