কাসেম সোলাইমানী- আরব্য রূপকথা, কিংবা এক জটিল ধাঁধা
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
যুক্তরাষ্ট্রের হিটলিস্টে তো সোলাইমানি আগে থেকেই ছিলেন। তবে সোলাইমানিকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ইসরায়েলের মাথাব্যথাই ছিল বেশি।
বাবার ঋণের বোঝা পরিশোধ করতে মাত্র তেরো বছর বয়সে বাড়ি ছাড়তে হয়েছিল ছেলেটাকে, পরিবার থেকে অনেক দূরের এক শহরে গিয়ে করতে হয়েছিল দিনমজুরের কাজ। সেই কিশোর ছেলেটা পরে নিজের মেধা, তীক্ষ্ম বুদ্ধি আর সাহসিকতার মাধ্যমে পরিণত হয়েছেন দুনিয়ার সেরা সমরনায়কদের একজনে। ইরান তো বটেই, গোটা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিই নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ছিল তার, মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তিও তাকেই বিবেচনা করা হতো।
গত কয়েক বছরে আমেরিকা-ইজরাইলের মতো দেশগুলোর মাথাব্যাথার আরেক নাম হয়েছিলেন তিনি, সিআইএ এবং মোসাদের হিটলিস্টের একদম ওপরে জ্বলজ্বল করছিল তার নাম- সেই কাসেম বিন সোলাইমানিকে গতকাল ভোররাতে হত্যা করেছে আমেরিকা, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সরাসরি নির্দেশে হেলিকপ্টার থেকে রকেট হামলা চালিয়ে উড়িয়ে দেয়া হয়েছে তার গাড়িবহর, মধ্যপ্রাচ্য এখন কাঁপছে নতুন এক যুদ্ধের আতঙ্কে। কাসেম বিন সোলাইমানি তো এমনই মানুষ ছিলেন, মৃত্যুতেও যিনি সাড়া জাগিয়ে যান ভীষণভাবে!
ইসলামিক রেভুলেশনারি গার্ডস কর্পস বা আইআরজিসি নামে পরিচিত ইরানী বাহিনীর প্রধান ছিলেন সোলাইমানি। তবে অলিখিতভাবে তার পদমর্যাদা ছিল দেশটির যেকোনো সামরিক কর্মকর্তার ওপরে। রেভল্যুশনারি গার্ডের ‘কুদস্ ফোর্স’ সরাসরি তার নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়ে এসেছে। গত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে এই বাহিনীটিকে গড়ে তুলছেন তিনি। অপ্রচলিত যুদ্ধের জন্য তৈরি একটা বৃহৎ ‘স্পেশাল অপারেশান ইউনিট’ বলা যায় একে, যাদের মূল কাজ ইরান নয়, বরং ইরানের বাইরে। দেশটির বৈশ্বিক উত্থানে বর্শার ফলকে পরিণত হয়েছেন কুদস ফোর্সের সদস্যরা, যাঁদের ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলেছিলেন কাসেম সোলাইমানি।
১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লাহ খোমেনির নেতৃত্বে ইরানে শাহ রাজত্বের বিরুদ্ধে ইসলামিক বিপ্লব হয়েছিল, সেই ঘটিনার কিছুদিন পরেই ইসলামি রেভুলেশনারি গার্ডস নামের বাহিনীতে যোগ দেন সোলাইমানি। খোমেনির ঘোষিত ইসলাম প্রজাতন্ত্রে নতুন কোনো অভ্যুত্থান ঠেকাতে সে সময় বাহিনীটি গঠন করা হয়েছিল।
আইআরজিসি'তে যোগদানের দুই বছরের মধ্যে সোলাইমানিকে ইরাক-ইরান যুদ্ধে পাঠানো হয়। সেখানে তিনি নিজের কৃতিত্বের পরিচয় রাখেন। এ কারণে তাকে একটি ব্রিগেডের প্রধান করা হয়েছিল। সমরনায়ক হিসেবে তিনি ছিলেন দুর্ধর্ষ, প্রতিপক্ষের চাল আগে থেকে আন্দাজ করার দারুণ গুণ ছিল তার, স্ট্র্যাটেজির দিক থেকে সোলাইমানি ছিলেন মাস্টার লেভেলের। আর সেকারণে বাহিনীতে তার প্রভাব বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে আইআরজিসি'র প্রধান হন তিনি।
ইরানের প্রভাবশালী এই জেনারেলের পরিচিতি ছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। তার নিয়ন্ত্রিত আইআরজিসি বা 'কুদস্ ফোর্স' এর কর্মকাণ্ড ইরান ছাড়াও দেশটির বাইরে বিস্তৃত ছিল। 'কুদস’ শব্দের অর্থ ‘পবিত্র’। বোঝা যাচ্ছে, সোলাইমানির এই বাহিনীর পরিকল্পনায় ধর্ম বড়সড় জায়গা নিয়ে রেখেছে। সেটা কতটা ইসলামের শত্রুর বিরুদ্ধে, আর কতটা শিয়া মতাদর্শের পরিসর বাড়াতে, তা নিয়ে বিতর্কও আছে। তবে সোলাইমানির সক্ষমতা নিয়ে কোন বিতর্ক ছিল না। তার ধুরন্ধর মস্তিস্কের কারণেই অর্থনৈতিক অবরোধ বা আমেরিকা-ইজরাইল-সৌদি আরবের ত্রিমুখী চাপের পরেও মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে ইরানকে দমিয়ে রাখা যায়নি। বরং কুদস ফোর্সের কার্যক্রম ছড়িয়েছে দূর দূরান্তে।
মধ্যপ্রাচ্য সংকট বা সিরিয়ার গৃহযুদ্ধেও তার ভূমিকা ছিল বহুদূর বিস্তৃত। সিরিয়ায় আমেরিকার হামলা বা ইসলামিক স্টেটের হত্যাযজ্ঞের পরেও যে বাশার আল আসাদ সরকারের পতন হয়নি, সেটার পেছনে সোলায়মানির অবদান ছিল অপরিসীম। আমেরিকার বিরুদ্ধাচরণ করে তাদের হিটলিস্টে জায়গা করে নিয়েছিলেন, কিন্ত পরোয়া করেননি কখনও, নিজের কাজটা করে গেছেন, বাড়িয়েছেন বাহিনীর সক্ষমতা, কাজের পরিধি। কুদস ফোর্স একের পর এক হামলা চালিয়েছে প্রতিপক্ষের স্থাপনায়, সীমিত শক্তি নিয়েও শত্রুপক্ষকে বড়সড় ক্ষতির সম্মুখীন করেছে তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের হিটলিস্টে তো সোলাইমানি আগে থেকেই ছিলেন। তবে সোলাইমানিকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে ইসরায়েলের মাথাব্যথাই ছিল বেশি। ইরানের এই জেনারেলকে তারা প্রকাশ্যেই ‘এক নম্বর শত্রু’ বলতো। প্রতিবেশী সিরিয়ায় ইরানের কুদস ফোর্সের সামরিক দপ্তর থাকা ইসরায়েলের কাছে তেহরানের পারমাণবিক অস্ত্রের মতোই অসহনীয় কিছু, আর পুরো পরিকল্পনাটাই ছিল সোলায়মানির। ইসরায়েলের জেনারেলরা প্রকাশ্যের বলতেন যে মোসাদের হিটলিস্টে সোলাইমানি সর্বাগ্রেই আছেন। ব্যাপারটা সোলাইমানি বা ইরান- কারোরই অজানা ছিল। হয়তো এ কারণেই আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি সোলাইমানিকে অভিহিত করতেন ইরানের ‘জীবন্ত শহীদ’ হিসেবে।
ইরানের ভবিষ্যত রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে শোনা যাচ্ছিলো সোলায়মানির নাম। নিজের দেশে প্রেসিডেন্টের চেয়েও বেশি ক্ষমতাবান ছিলেন তিনি। নিজের কাজকর্মের জন্যে সরাসরি আয়াতুল্লাহ খোমেনিকে রিপোর্ট করতেন সোলায়মানি, এমনকি প্রেসিডেন্টের কাছেও কোন জবাবদিহি করতে হতো না তাকে। এবছরই খোমেনির কাছ থেকে বীরত্বের জন্যে 'অর্ডার অব জুলফিকার' নামের পদক পেয়েছিলেন সোলায়মানি। সেই অনুষ্ঠানে তাকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে চুমু খেয়েছিলেন খোমেনি, ইরানী সংস্কৃতিতে খুব কাছের বা প্রিয় মানুষদেরই এভাবে আদর করা হয়। সোলায়মানি যে খোমেনির সবচেয়ে প্রিয় এবং বিশ্বস্ত মানুষদের একজন ছিলেন, তাতে কোন সন্দেহই নেই।
কাসেম সোলায়মানি চলে গেছেন, ইরান ঘোষণা দিয়েছে চরম প্রতিশোধের। যুক্তরাষ্ট্র সতর্কতা জারী করেছে, অনতিবলম্বে ইরাক ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে মার্কিন নাগরিকদের। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়েছে, পড়েছে শেয়ারের মূল্য। চারপাশে অশুভ একটা গন্ধ, বাতাসে যুদ্ধের দামামা। সোলায়মানি মানুষটা কারো কাছে ছিলেন আরব্য রূপকথার নায়ক, কারো কাছে আবার জটিল এক গোলক ধাঁধা- সেই ধাঁধার সমাধান হয়তো কখনও হবে না, তবে তার বিদায়ে পরিস্থিতি বরং ঘোলাটেই হয়েছে, অনিশ্চয়তা ভর করেছে মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যতের ওপর...