
ট্রেইলার রিলিজের পর থেকেই সবাই নেটফ্লিক্সের ফেসবুক পেজে হামলে পড়ছিল, বলাবলি করছিল, এটা নির্ঘাত নাইভস আউট-এর নকল, আরেকটা গার্বেজ আসতে চলেছে! কিন্ত না, ছবির কাহিনী মোটেই নাইভস আউট থেকে 'মেরে দেওয়া' নয়...
রাত আকেলি হ্যায়-এর ট্রেইলার রিলিজের পর থেকেই সবাই নেটফ্লিক্সের ফেসবুক পেজে হামলে পড়ছিল, বলাবলি করছিল, এটা নির্ঘাত নাইভস আউট-এর নকল। আর যেহেতু হলিউডি ছবির অ্যাডাপ্টেশনে বলিউডের রেপুটেশন খুব একটা সুবিধার না, এবং নেটফ্লিক্সের ইন্ডিয়ান অরিজিনাল কনটেন্টগুলোও সাম্প্রতিক সময়ে একদমই যাচ্ছেতাই, ফলে আরো একটা গার্বেজ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা খুব ভালোভাবেই ছিল।
কিন্তু সুখবর হলো, হানি ত্রেহানের নির্মাণে রাত আকেলি হ্যায় প্রায় সব আশঙ্কাকেই মিথ্যা প্রমাণ করেছে। এই ছবির কাহিনী মোটেই নাইভস আউট থেকে 'মেরে দেওয়া' নয়। নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকির ইন্সপেক্টর জটিল ইয়াদভ চরিত্রটার মাঝে শুধু ড্যানিয়েল ক্রেইগের বেনোয়া ব্লাঙ্ক কেন, স্বয়ং এরকুল পোয়ারোর ছাপও রয়েছে। তাছাড়া প্রথম দর্শনে এই ছবির হত্যা রহস্যটার সাথে নাইভস আউটের হারলান থ্রমবি খুনের মামলার কিছু মিলও নিশ্চিতভাবেই খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু তারপরও, ছবির কাহিনী যতই এগোতে থাকে, ততই পরিষ্কার হতে থাকে, রাত আকেলি হ্যায়-এর কাহিনী পুরোপুরি আলাদা ও স্বতন্ত্র।
রাত আকেলি হ্যায়-এর লেখক স্মিতা সিং, যার ইতঃপূর্বে রয়েছে সেকরেড গেমসের সহ-লেখক হিসেবে কাজেরও অভিজ্ঞতা। তবে সেখানে তার আশেপাশে আরো অনেকে ছিলেন, ফলে আলাদা করে তিনি হয়তো তেমন হাইলাইটে আসেননি। কিন্তু এই ছবির কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপের জন্য অবধারিতভাবেই সবটুকু কৃতিত্ব যাবে তার ঝুলিতে।
সেকরেড গেমসের কথা দর্শকের আরো কিছু কারণে মনে পড়বে, যার মধ্যে প্রধান কারণ নওয়াজ ও রাধিকা আপ্তের উপস্থিতি। সেকরেড গেমস প্রথম সিজনের পর আবারো তারা একসাথে নেটফ্লিক্সে। বিশেষ করে রাধিকার জন্য এটাকে নেটফ্লিক্স কামব্যাকও বলা চলে! এছাড়াও এই ছবিতে রয়েছে আরো একঝাঁক দুর্দান্ত অভিনেতা। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য শ্বেতা ত্রিপাঠি, টিগমাংশু ঢুলিয়া, শিবানি রঘুবংশী, আদিত্য শ্রীবাস্তব প্রমুখ। সব মিলিয়ে একটা আনসাম্বল কাস্ট।
অতীতে মকবুল, ওমকারা, ফুকরে, দেড় ইশকিয়া, রইস, হিন্দি মিডিয়ামের মতো সব ছবিতে কাস্টিং ডিরেক্টরের ভূমিকা পালন করা হানি ত্রেহানের পরিচালক হিসেবে প্রথম ছবিতে এমন আনসাম্বল কাস্ট খুবই ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কেননা হুডানিট ঘরানার মার্ডার মিস্ট্রিতে সন্দেহভাজন প্রতিটা চরিত্রেই বাঘা বাঘা সব অভিনেতা থাকা প্রয়োজন, যাতে দর্শক বিশেষ কোনো অভিনেতাকে দেখেই বুঝে না যায় যে দোষী হয়তো এই ব্যক্তিই।
এবং সত্যি কথা বলতে কী, যে নাইভস আউটের সাথে রাত আকেলি হ্যায়-এর এত তুলনা হচ্ছে, সেই ছবির কাস্টিংও কিন্তু কোনোভাবেই খুঁতহীন ছিল না। সেখানেও অনেক নামজাঁদা অভিনেতা-অভিনেত্রী ছিলেন বটে, কিন্তু তবু ক্রিস ইভান্সের উপস্থিতি একটা বড় ধরনের গিভ অ্যাওয়ে ছিল। নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, রাত আকেলি হ্যায়-তে সেটা হয়নি। ফলে শেষাংশের টুইস্টের মাধ্যমে দোষী হিসেবে যে বা যারা উন্মোচিত হবে, সেটার জন্য দর্শকের আগে থেকে প্রস্তুত থাকার সম্ভাবনা খুবই কম। এমন বৈশিষ্ট্যেই না হুডানিটের প্রকৃত সার্থকতা নিহিত!
তবে কোনোভাবেই এটা বলছি না যে সামগ্রিকভাবে নাইভস আউটের চেয়ে রাত আকেলি হ্যায় এগিয়ে। কেননা আগাথা ক্রিস্টির কল্যাণে এই ধরনের ক্লাসিক মার্ডার মিস্ট্রি খুব পরিচিত জনরা হলেও, সাম্প্রতিক সময়ে নাইভস আউট নিঃসন্দেহে একটা নতুন ট্রেন্ড সেট করে দিয়েছে। সেজন্যই কিনা বারবার ওই ছবির প্রসঙ্গ চলে আসছে। কিন্তু তারপরও রাত আকেলি হ্যায়-এর কিছু দুর্বলতা বা খামতি রয়েই গেছে।
এই ছবির বড় দুর্বলতাগুলোর একটা হলো এর লম্বা রানিং টাইম। আজকের দিনে প্রায় আড়াই ঘণ্টার ছবি বলিউড কিংবা হলিউড যেকোনো জায়গাতেই বিরল। বিশেষত মিস্ট্রি থ্রিলারের কাহিনীবিন্যাস আরো টানটান হওয়াই তো কাম্য। অনেকে বলতে পারেন, এই ছবিতে ক্যারেক্টার বিল্ডআপে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু তবু প্রশ্ন থেকে যায়, এত লম্বা সময় ধরে ক্যারেক্টার বিল্ডআপের আদৌ কোনো দরকার ছিল কী?
আর দ্বিতীয়ত, জটিল ইয়াদভের সাথে রাধার (রাধিকা) সম্পর্কের যে সাবপ্লট, সেটা না থাকলেও চলত। এমন নয় যে মূল কাহিনীর গতি এতে ব্যাহত হয়েছে। কিন্তু রানিং টাইম যে বেড়ে গেছে, সেটা তো দৃশ্যমান। একটা ইনটেন্স মার্ডার মিস্ট্রিতেও এ ধরনের রোমান্টিক সাবপ্লট রাখা টিপিক্যাল বলিউড মেন্টালিটি ছাড়া কিছুই নয়। কিংবা এমনও হতে পারে, জটিল ইয়াদভকে নিয়ে সামনে আরো ছবি নির্মাণের লক্ষ্যে ইচ্ছাকৃতভাবেই এই কাজটা করা হয়েছে!
নাইভস আউট শুধু একটা মার্ডার মিস্ট্রিই ছিল না, একই সাথে সেখানে সোশ্যাল কমেন্ট্রিও ছিল, এবং সেগুলো ছিল খুবই সূক্ষ্ম। রাত আকেলি হ্যায়-তে কি সেরকম কিছু আছে? অবশ্যই আছে। এখানেও সরাসরি সবকিছু বলার পরিবর্তে, নিগূঢ়ভাবেই বিষয়গুলোকে দেখানো হয়েছে। তাই শুধু রহস্যের সমাধান বা খুনী কে সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার পরিবর্তে, আরো বেশি মনোযোগ দিয়ে পুরো ছবিটা দেখলেই দর্শক সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম জিনিসগুলো ধরতে পারবে।
কিন্তু যেমনটা আগেই বলেছিলাম, রানিং টাইম এখানে একটা বড় প্রতিবন্ধকতা। ১০০ মিনিটের ছবি দেখতে অভ্যস্ত প্রজন্মের ১৫০ মিনিটের ছবির পুরোটা সমান একনিষ্ঠতার সাথে দেখার ধৈর্য হবে কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। আর এজন্য কিছুটা দায় সম্পাদক শ্রীকর প্রসাদের উপরও বর্তায়।
রাত আকেলি হ্যায়-এর সেট ডিজাইন এবং সাউন্ড ডিজাইন দুটোই প্রশংসার দাবিদার। কিছুদিন আগে যেমন গুলাবো সিতাবো কিংবা বুলবুলের 'হাভেলি' এক-একটা জীবন্ত চরিত্র হয়ে উঠেছিল, তেমনই এই ছবির প্রাসাদোপম বাড়িটারও বিশেষ ভূমিকা ছিল রহস্যের জাল বাঁধার জন্য। নেপথ্য সঙ্গীতও কাহিনীর রহস্যময়তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল, যা এই ধরনের ছবিকে আরো উপভোগ্য করে তোলে। এছাড়া স্নেহা খানওয়ালকারের সঙ্গীতায়োজনে একটা গানও ছিল, যেটা অপ্রত্যাশিত হলেও, কাহিনীর মুডের সাথে বেশ ভালোই গিয়েছে।
কিছু অ্যাকশন সিকোয়েন্স ছিল, যেগুলো নওয়াজউদ্দিনের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জিং হওয়ার কথা। তবে পর্দায় যা দেখা গিয়েছে, তাতে একদমই অস্বাভাবিক কিছু লাগেনি। পুরো ছবিজুড়েই দুর্দান্ত স্ক্রিন প্রেজেন্স ছিল নওয়াজের। বরাবরের মতোই আরো একটা অসাধারণ পারফরম্যান্স তার। সন্ত্রাসী-অপরাধী-গ্যাং লিডার হিসেবে কাজ করতে করতে তিনি টাইপকাস্ট হয়ে যাচ্ছেন বলে যাদের অভিযোগ ছিল, এই ছবির মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন যে পুলিশ অফিসার হিসেবেও তিনি অনবদ্য। রাধিকা আপ্তের বেশি কিছু করার ছিল না। তারপরও যেটুকু করেছেন মন্দ লাগেনি, আবার উচ্ছ্বসিত হওয়ার মতোও কিছু মনে হয়নি। এছাড়া অন্যান্য প্রধান অভিনেতা-অভিনেত্রীরাই তাদের নিজ নিজ ভূমিকায় ভালো করেছেন।
সব মিলিয়ে রাত আকেলি হ্যায় নিঃসন্দেহে একটা ভালো ছবি। মুক্তির আগে থেকেই বারবার নাইভস আউটের সাথে তুলনা হয়েছে এবং মুক্তির পরও তা অব্যাহত্ রয়েছে বটে, কিন্তু অন্য কোনো ছবির সাথে তুলনা বাদেও এটা চমৎকার একটা ছবি। একবার যদি কাহিনীর ভেতরে ঢুকে পড়া যায়, তাহলে বাকি সময়টা বেশ উপভোগ্যই হবে। এবং রহস্য উন্মোচনের অংশের সারপ্রাইজটাও ন্যাচারালিই আসবে।
প্রথম ছবিতেই মুগ্ধ করলেন হানি ত্রেহান। তার কাছ থেকে ভবিষ্যতে আরো দারুণ দারুণ সব কাজের আশা করা যেতেই পারে। এবং কে জানে, রাত আকেলি হ্যায়-এর পজিটিভ রেসপন্স দেখে এটাকে একটা ফ্র্যাঞ্চাইজে পরিণত করার কথাও তিনি ভাবতেই পারেন!
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন