মুশকান জুবেরী চরিত্রের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোট জয়ার পক্ষে বলে কি নির্মাতা সৃজিত মুখার্জিও কেবল জয়াকেই নিতে বাধ্য? এর বদলে পরীমনি কিংবা আর কাউকেই তিনি নিতে পারবেন না?

মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের 'রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেন নি' বইটি ২০১৫ সালে যখন প্রকাশিত হয়, তখন থেকেই মুশকান জুবেরী হিসেবে জয়া আহসানকে কল্পনা করে এসেছি। পরবর্তীতে মুশকান জুবেরী চরিত্রটি যখন একটি কাল্টে পরিণত হলো, তখনো দেখেছি দশ জনের মধ্যে নয়জনই বলছে, পর্দায় এই চরিত্রটা ফুটিয়ে তুলতে পারবেন জয়াই। তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই, এই বইটির উপর ওয়েব সিরিজ নির্মাণের ঘোষণা আসার পরও, সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রথম পছন্দ ছিল জয়া। এমনকি স্বয়ং লেখকেরও নাকি পছন্দ ছিল জয়াকেই।  

কিন্তু এখন কথা হলো, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোট জয়ার পক্ষে হলেই কি নির্মাতা সৃজিত মুখার্জিও কেবল জয়াকেই নিতে বাধ্য? এর বদলে পরীমনি কিংবা আর কাউকেই তিনি নিতে পারবেন না? ফেসবুকে মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখে সেরকমটাই মনে হচ্ছে। 

বইপড়ুয়া যারা, 'স্বাধীনতা' কনসেপ্টটি তাদের আরো ভালোভাবে বোঝা উচিৎ। কিন্তু খুব খারাপ লাগে যে, এই বইপড়ুয়ারাও কেন যেন খুব বেশি ধরনের গোঁড়া ও রক্ষণশীল। তারা নিজেদের মত ও পছন্দের বাইরে অন্য কারো মত ও পছন্দকে কেন যেন গ্রহণই করতে পারে না। শিল্পের স্বাধীনতা বলেও যে একটি জিনিস আছে, সেটি যেন তাদের কল্পনাতেই আসে না।

এটি যে শুধু মুশকান জুবেরী চরিত্রের অভিনেত্রী বাছাই নিয়ে হচ্ছে, তা কিন্তু না। প্রায় সবসময়ই একশ্রেণীর গোঁড়া বইপ্রেমীর মধ্যে এই প্রবণতাটা দেখা যায়। তাদের মত অনেকটা এমন যে: সত্যজিৎ রায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে ভেবে ফেলুদা লিখেছিলেন, তাই দুনিয়ায় আর কেউ ফেলুদা চরিত্রে অভিনয় করতে পারবে না। কোন্যান ডয়েল উনিশ-কুড়ি শতকের প্রেক্ষাপটে শার্লক হোমস লিখেছিলেন, তাই শার্লক হোমসকে বর্তমানের প্রেক্ষাপটে আনা যাবে না। শরৎচন্দ্র একজন পুরুষ চরিত্রকে কেন্দ্র করে দেবদাস লিখেছিলেন, তাই দেবদাসের হুট করে নারী চরিত্র হওয়া যাবে না। মানে বিষয়টি হলো, মূল লেখকদের সৃষ্ট সাহিত্য হলো বেদবাক্য, রূপান্তরে তার বাইরে যাওয়াই যাবে না!

রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি

অথচ এই গোঁড়া বইপ্রেমীরা একটি জিনিস বুঝতে পারেন না, বই আর সিনেমা (কিংবা হালের সিরিজ) সম্পূর্ণ ভিন্ন দুইটি আর্ট ফর্ম। বই থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সিনেমা/সিরিজ বানানো যেতে পারে, আবার সিনেমা/সিরিজ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বই লেখা যেতে পারে। তার মানে এই না যে রূপান্তরকারীকে সবসময় মূলানুসারীই হতে হবে। একজন নির্মাতা, হোক তিনি লেখক কিংবা চলচ্চিত্র পরিচালক, তার অবশ্যই নির্মাণের ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য রয়েছে, এবং তাকে সেই ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য ব্যবহারের স্বাধীনতাটুকু দিতেই হবে। আপনার যদি তা ভালো না লাগে, আপনি এড়িয়ে যান। কিন্তু আপনার ভালো লাগছে না বলে সেটির ঘোরতর বিরোধী হয়ে উঠতে হবে, এ কেমন কথা!

এই যে সত্যজিৎ রায়ের সৃষ্টি নিয়ে এত টানাহ্যাঁচড়া হয়, ফেলুদা কিংবা শঙ্কুর সঠিক চরিত্রায়ন হলো না বলে চারিদিকে হাহাকার দেখা যায়, সেই সত্যজিৎ রায় নিজে কি রূপান্তরের ক্ষেত্রে সবসময় মূলানুসারী ছিলেন? তিনি যে প্রথমবার পর্দায় ব্যোমকেশকে এনেছিলেন, তিনি কি শরদিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের আঁকা ছকেই এগিয়েছিলেন? তা তো না। তিনি তো ঠিকই ব্যোকমেশকে চশমা পরিয়ে দিয়েছিলেন। এতে কি ব্যোমকেশ-স্রষ্টার কোনো অপমান হয়েছে? কিংবা ব্যোমকেশ চরিত্রের অবমাননা হয়েছে? কোনোটাই না। বরং ব্যোমকেশ চরিত্রে একটি নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। মোদ্দা কথা হলো, বইয়ের পাতায় শরদিন্দু একভাবে ব্যোমকেশ চরিত্রটিকে সাজিয়েছিলেন মানে এই না যে সত্যজিৎ কিংবা অন্য যেকোনো পরিচালককেও সেটিই অনুসরণ করতে হবে।

রূপান্তর শিল্পে ইন্টারপ্রিটেশন অনেক বড় একটি ব্যাপার। এবং এই ইন্টারপ্রিটেশনের বৈচিত্র্যই রূপান্তরকে আরো সুন্দর করে তোলে। তাই তো পৌরাণিক কাহিনীতে যা-ই থাকুক, মাইকেল মধুসূদন দত্ত যখন রাম-লক্ষ্মণকে হীনরূপে আর রাক্ষসরাজ রাবণ ও তার পুত্র মেঘনাদ যাবতীয় মানবীয় গুণের ধারকরূপে উপস্থাপিত করেন, তাতে রামায়ণের বিন্দুমাত্র অসম্মান হয় না, বরং রামায়ণের একটি নতুন ধরনের ইন্টারপ্রিটেশন আমাদের ভাবনার জগতকে বিস্তৃত করে, আমাদের উপলব্ধি করায় যে সবকিছুই সরাসরি সাদা আর কালো নয়, মাঝে অনেক ধূসর এলাকাও আছে, যেগুলো নিজেদের চিন্তা করে বের করতে হবে। 

জয়া আহসান

অথচ, এই যে আজকাল বইপ্রেমী কিংবা মোটাদাগে শিল্পানুরাগীদের মাঝে ভাবনার গভীরতা অনেক কমে গেছে, এর জন্য দায়ী আসলে তাদের সংকীর্ণ মানসিকতাই। তারা সবসময় তাদের গোঁড়ামি আঁকড়ে ধরে বসে থাকে যে যেকোনো রূপান্তর শিল্পকে তার মূল উৎসের সমতুল্যই হতে হবে, এর বাইরে যাওয়া যাবে না। মূল উৎসের চেয়ে রূপান্তরটি ভালো হলেও তারা হাজারটা ভুল ধরবে, আর খারাপ হলে তো কথাই নেই, শুরু হয়ে যাবে রূপান্তরকারীর মুণ্ডুপাত।

শিল্পানুরাগীদের এমন চিন্তাধারা খুবই হতাশার জন্ম দেয়। সমাজের অন্য সকল গোষ্ঠীর মতো, তারাও তাদের নিজেদের কল্পনার সীমাবদ্ধতার ফলে অন্য যারা ভিন্নপথে হাঁটতে ইচ্ছুক বা নিজেদের কল্পনাকে আকাশে ডানা ঝাপটানোর ইচ্ছা পোষণ করে, তাদেরকেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অবদমিত থাকতে হয়। 

অথচ এমনটি তো হওয়ার কথা ছিল না। শিল্পানুরাগীদের কাছ থেকে তো সর্বোচ্চ উদারতা কাম্য। তারা যেকোনো রূপান্তরকে সাদরে গ্রহণ না করুক, অন্তত সহ্য করার মতো মানসিক সক্ষমতা তো রাখবে। নিজেদের মতের সাথে না মিলুক, তবু অন্তত অন্য কেউ চিরচেনা কোনো একটি কাহিনী বা চরিত্রকে ভিন্নভাবে ভাবতে চাইলে, সেই ভিন্নতাটা কেমন ও কতটা, তা জানার আগ্রহ তো থাকতে হবে।

এই যে বিবিসিতে অত্যাধুনিক শার্লককে দেখানো হলো, এতে কি শার্লক চরিত্রটির তাৎপর্য কমল না বাড়ল? আপনি ব্যক্তিগতভাবে হয়তো চিরাচরিত শার্লককেই দেখতে চান। কিন্তু তাই বলে অন্য কারো কারো তো আগ্রহ থাকতেই পারে জানার যে সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে, আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে শার্লক কী কী করতে পারত। তাদের সেই আগ্রহটা তো বিবিসির শার্লক মিটিয়েছে। তাহলে আপনার এত গায়ে জ্বালা কেন?

পরি মণি

যা-ই হোক, ভাবতে পারেন ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি। মূল প্রসঙ্গে ফেরা যাক। মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের মুশকান জুবেরীকে আমরা বইয়ের পাতায় পড়েছি, নিজেদের মতো করে তাকে কল্পনা করেছি, ভালোবেসেছি। কিন্তু, সৃজিত মুখার্জি বা আর কেউ যখন 'রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেন নি'-কে পর্দায় আনবেন, তখন তো চরিত্রগুলো আর মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের ব্যক্তিগত সম্পত্তি থাকবে না। 

মূল লেখকের কিছু ব্যক্তিগত ইনপুট অবশ্যই থাকবে, কিন্তু চরিত্রগুলোকে নিজের মতো করে ঢেলে সাজানোর অধিকার অবশ্যই চলে যাবে পরিচালকের হাতে। তিনিই নিজের ইন্টারপ্রিটেশন অনুযায়ী ঠিক করবেন, কোন চরিত্রটি কেমন হবে, কিংবা কাহিনীর প্রেক্ষাপট কোন সময়টা হবে। তাতে যদি অরিজিনাল টেক্সট থেকে তিনি কিছুটা সরেও যান, তাতেও কোনো আপত্তিই থাকা উচিৎ না। বরং এটি আমাদের জন্য একটি বাড়তি পাওনাই হওয়া উচিৎ যে বইয়ের কাহিনী তো আমরা জানিই, এবার সেটির একটি ব্যতিক্রমী ইন্টারপ্রিটেশনও আমরা পেতে চলেছি। অডিয়েন্স হিসেবে এটি নিয়েই তো আমাদের সন্তুষ্ট থাকা উচিৎ। 

সিরিজটি বের হওয়ার পর যদি আমাদের ভালো না লাগে, আমরা অবশ্যই গঠনমূলক সমালোচনা করব। সেই অধিকারও দর্শক হিসেবে আমাদের আছে। কিন্তু যেকোনো জনপ্রিয় কিংবা ধ্রুপদী কাহিনীর রূপান্তরের কথা উঠলেই সেটির প্রেক্ষাপট, কাস্টিং থেকে সবকিছু নিয়েই নেতিবাচকতা ছড়ানো খুবই বাজে একটি প্রবণতা। এবং এ থেকে এটিই বারবার প্রমাণিত হয় যে, সামগ্রিকভাবেই মানুষ হিসেবে আমরা দিনদিন কতটা অসহনশীল হয়ে উঠেছি, পরমত-সহিষ্ণুতাকে জাদুঘরে পাঠাতে চলেছি, এবং নিজেদের মতের বিপরীতে কিছু দেখলেই আমাদের অতিমাত্রার স্পর্শকাতর অনুভূতিতে আঘাত লেগে যাচ্ছে।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা