মানবতার বুলি আর কপচাবো না। আমরা হয়তো এমন সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশই চেয়েছিলাম। তাই যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশটা স্বাধীন করেছিলাম, তাদের মতোই আচরণ শুরু করেছি।  

আসবার কালে কী জাত ছিলে? এসে তুমি কী জাত নিলে? কী জাত হবা যাবার কালে? সেই কথা ভেবে বলো না! লালনের মতো এতো সহজভাবে আমরা অনুধাবন করতে পারিনি জাত-পাতের ব্যাপারটি। তাইতো এদেশে এখনো সাম্প্রদায়িক আচরণ প্রকোট। এ সাম্প্রদায়িকতায় সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ। নিম্ন আয় এবং জীবনমান এর মূল কারণ।

বাংলাদেশে বর্তমানে দলিতদের সংখ্যা প্রায় ৬০ লাখের মতো। বাঙালি দলিত বলতে সমাজে যারা অস্পৃশ্য তাদের বোঝায়, যেমন- চর্মকার, কামার, কুমার, জেলে, ক্ষৌরকার।  এসব সম্প্রদায় আবার বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত। জন্ম ও পেশাগত কারণে বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার এমনই এক সম্প্রদায় ‘হরিজন’, কটু ভাষায় যাকে বলে মেথর বা সুইপার। এই গোত্রের মানুষদের সাথে অধিকাংশই খেতে চায় না, চলাফেরা করতে চায় না, প্রয়োজন ছাড়া কথাও বলতে ইচ্ছুক না অনেকে।

ধরুন, আপনার খুব ক্ষিধে পেয়েছে। কোনো হোটেলে যেয়ে খেতে চাইলেও পারবেন না। কারণ, আপনি হরিজন সম্প্রদায়ের একজন। এমনটাই অভিযোগ মৌলভিবাজারের হরিজন বাসিন্দাদের। শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ নয়। শিক্ষার ক্ষেত্রেও রয়েছে এ বৈষম্য। সেখানে এক শিশুকে কিন্ডারগার্টেন স্কুল থেকে বের করে দেয়া হয় হরিজন সম্প্রদায়ের হওয়ার কারণে!

ছোট্ট শিশুটি অসীম আগ্রহে প্রস্তুতি নিচ্ছিলো স্কুলে যাওয়ার, লেখাপড়া শেখার। দারিদ্র ও অশিক্ষার ছোবল থেকে মুক্তির পথ খুঁজছিলো একটি শিশু মন। তাতে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে অন্য শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা। শিশুটি স্কুলটিতে পড়তে গেলে অন্য অভিভাবকরা তাদের সন্তানকে অন্যত্র সরিয়ে নেবেন বলেও হুমকি দিয়েছেন।

বিরাট বাসপর

৭ বছর বয়সী শিশুটির নাম বিরাট বাসপর। তার পিতা মনা বাসপর। গত ১৩ই জানুয়ারি, মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার অগ্রদূত চাইল্ড কেয়ার হোমস্ নামের একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যথাযথ নিয়ম মেনে প্রথম শ্রেণিতে ছেলেকে ভর্তি করান তিনি। ভালো স্কুলে পড়ানোর জন্য এই দরিদ্র পিতা স্কুল ড্রেসসহ বইখাতা কিনে দেন ছেলেকে।  কিন্তু সেদিন রাতেই স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে ফোন করে জানায়, হরিজন সম্প্রদায়ের হওয়ার কারণে তার সন্তানকে ঐ স্কুলে ক্লাস করতে দেয়া সম্ভব নয়। তাকে যেন অন্য কোন স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হয়। কারণ হিসেবে তাকে জানানো হয় যে, 'অন্য বাচ্চার অভিভাবকরা নাকি সমস্যা করছে। তাদের টাকায় যেহেতু স্কুল চলে সেহেতু তাদের কথা ফেলে দেয়া যাবে না’।

মনা বাসপর বলেন, 'বিষয়টি নিয়ে স্কুল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলেছি। আমরা হরিজন সম্প্রদায় বলে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে তারা জানান। বিষয়টা অমানবিক। আমার ছেলেকে অন্যদের মতো পড়াতে চাই।'

স্কুল কর্তৃপক্ষ জানায়, ছাত্র-ছাত্রীদের বেতনের টাকায় স্কুল পরিচালিত হচ্ছে। সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন না তারা। শুধুমাত্র বছরের শুরুতে বই পাচ্ছেন। এ অবস্থায় বেশিরভাগ অভিভাবক মৌখিক আপত্তি জানালে বাধ্য হয়ে এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তাই বিরাটকে ক্লাসে যেতে নিষেধ করা হয়।

এদিকে ঘটনায় প্রতিকার চেয়ে বৃহস্পতিবার বিরাটের অভিভাবক একটি লিখিত আবেদন দিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বরাবর। পরবর্তীতে ইউএনওর হস্তক্ষেপে আবারো শিশুটিকে স্কুলে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ টি এম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, 'শিক্ষা সবার মৌলিক অধিকার। এটা থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যাবেনা,সে যেই সম্প্রদায়ের হউক। লিখিত অভিযোগ পাওয়ার পর স্কুল কর্তৃপক্ষকে ডেকে এনেছিলাম। ওই স্কুলছাত্রকে ক্লাসে ফিরিয়ে নিতে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছি। আগামী মঙ্গলবার স্কুল কর্তৃপক্ষ ও অভিভাবকদের নিয়ে একটি সচেতনতামূলক সভার প্রস্তুতি চলছে। সেখানে নিস্পত্তি হতে পারে বিরাটকে নিয়ে তৈরি হওয়া জটিলতার।’ 

মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় হরিজন ঐক্য পরিষদের সভাপতি মংলা বাসপর জানান, ‘শুধু স্কুলে ভর্তির ক্ষেত্রে নয়।  দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন কাজ-কর্মেও তাদের এ ধরণের বৈষম্যের মুখে পড়তে হয়। তিনি জানান, কুলাউড়া থানায় ৪০টির মতো হরিজন পরিবার রয়েছে। এসব পরিবারের সদস্যদের সামাজিক কোন অধিকার নেই। তিনি বলেন, হোটেলে খাবার খেতে গেলেও বৈষম্যের শিকার হতে হয় তাদের। অন্যদের সাথে চেয়ার টেবিলে বসে খাবার খেতে দেয়া হয় না। তাদের বাচ্চারা বাইরে কাগজে নিয়ে মাটিতে বসে খায়! এছাড়া চাকরি এবং বাসস্থানের মতো সমাজের প্রতিটি স্তুরে হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষেরা বৈষম্যের শিকার।’

মানবতার বুলি আর কপচাবো না। আমরা হয়তো এমন সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশই চেয়েছিলাম। তাই যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে দেশটা স্বাধীন করেছিলাম, তাদের মতোই আচরণ শুরু করেছি।  

তথ্যসূত্রঃ বিবিসি বাংলা, কালের কন্ঠ। 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা