নোয়াখাইল্লা-বরিশাইল্লা বিদ্বেষ এবং আমাদের অদ্ভুত হীনমন্যতা!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
নোয়াখালী তো আছেই, এর বাইরেও কুমিল্লার সব লোক মানেই নাকি ইতর, চট্টগ্রামের ছেলে মানেই নাকি সমকামী, পাবনার বাসিন্দা মানেই পাগলা গারদ, বরিশালের লোক মানেই নাকি হ্যান-ত্যান...
যখনই কারো বাসায় দাওয়াতে যাই, বন্ধুদের আড্ডাতে যাই এবং তারপর খাওয়া-দাওয়ার পর্ব থাকে, আমি সে ধরনের অনুষ্ঠানের শেষে এক ধরনের ভয়াবহ আতংকে ভুগি। কেন ভুগি? কারন আমার গ্রামের বাড়ী নোয়াখালী এবং খাওয়া দাওয়া পর্বের পরেই একজন আরেকজনকে অত্যন্ত সহজ গলায় বলেন, “ভাই নোয়াখাইল্লাদের মত খাইয়া দৌড় দিলাম। মাইন্ড কইরেন না। বাসায় কাজ আছে”
এই কথা বলার পরেই, কেউ না কেউ আমার দিকে তাকায় এবং বলে, “ভাই মাইন্ড কইরেন না, মজা করলাম”
তো এমন মজা একদিন বা দুইদিন হয়নি। প্রতিটি দাওয়াতে আমি এই লাইনটা শুনি এবং আমার ভেতরে এক ধরনের ক্রোধ জন্ম নিতে থাকে। মাঝে মধ্যে ইচ্ছে করে চড় মেরে মুখের সব ক’টা দাঁত ফেলে দেই কিন্তু সভ্য সমাজে বাস করবার হ্যাপা অনেক। তাই ভেতরে ভেতরে “হারামজাদা” বলে গালি দিয়ে চুপ করে হাসি মুখে ব্যাপারটা যে মজা ছিলো সেটি মেনে নেই।
সাম্প্রতিক সময়ে আমি ধীরে ধীরে দাওয়াত টাইপ ব্যাপার বাদ দিয়েছি। এইসব মানসিক অত্যাচার নেবার মত রুচি আমার আর নেই।
এটা তো গেলো নোয়াখালীর লোকেরা খাবার খেয়ে বাসায় চলে যাবার এক প্রবাদ প্রতিম উদ্ভট গল্প। আরো আছে অন্য অঞ্চল নিয়ে। যেমন কুমিল্লার সব লোক মানেই নাকি ইতর, চট্টগ্রামের ছেলে মানেই নাকি সমকামী, পাবনার বাসিন্দা মানেই পাগলা গারদ, বরিশালের লোক মানেই নাকি হ্যান-ত্যান আরো কতকি।
বাংলাদেশের এক এক জেলা নিয়ে এক এক রকমের এমন নোংরা জোক্স চালু রয়েছে। বিয়ের সময় উত্তর বঙ্গের মেয়ে বা ছেলের ক্ষেত্রে আমি অনেক মানুষকে ঠোঁট উল্টে বলতে শুনেছি “ওহ, নর্থ বেঙ্গলের মেয়ে?” “ওহ, নর্থ বেঙ্গলের ছেলে?” কথার মধ্যেই যেন একটা কিসের টান, কোথায় যেন সমস্যা রয়েছে এমন অভিব্যক্তি।
কিছুদিন আগে একটা নাটক দেখেছিলাম কয়েকটা পর্ব। নাটকের নাম 'ব্যাচেলর পয়েন্ট'। সেখানে দুইটি চরিত্র রয়েছে। একটির নাম কাবিলা এবং আরেকটির নাম শুভ।
কাবিলা মানে জিয়াউল হক পলাশ নামের অভিনেতা-টি দূর্দান্ত অভিনয় করে। আমার এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তার চরিত্রটির নাম 'কাবিলা' ও তার গ্রামের বাড়ী নোয়াখালী এবং সে নোয়াখালীর উচ্চারণে কথা বলে। এই পুরো ব্যাপারটি একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলে আমার আপত্তি থাকতো না। কিন্তু এই নাটক দেখে স্পস্ট বুঝতে পারা যায় চরিত্রটির নাম কাবিলা ও নোয়াখালীর উচ্চারণে তার সংলাপ দেয়াই হয়েছে মানুষকে হাসাবার জন্য। যেন নোয়াখালীর উচ্চারণে কথা বলাটা অত্যন্ত হাস্যকর ব্যাপার।
একই ঘটনা ঘটেছে এই নাটকের 'শুভ' এবং 'হাবু ভাই' চরিত্র দুটিতে। প্রথমত শুভ ছেলেটি বরিশালের ভাষা ঠিকমত বলতেই পারছে না এবং যতটুকু বলছে সেটি করা হয়েছে বিনোদনের জন্য। যেন বরিশালের ভাষা মানেই বিনোদন এবং হাস্যকর।
নাটকের এই হাবু ভাই চরিত্রটি-ও এমন। লোকটির অর্থ কড়ি কিছু নেই। অন্যের বাসায় বিনামূল্যে থাকে ফলে লোকটির নামের মধ্যেও এক ধরনের তাচ্ছিল্যের সুর। নাম হচ্ছে হাবু। কথা বলছেন বরিশালের আঞ্চলিক ভাষায়।
নাটকে কাবিলার নাম করনও করা হয়েছে বিনোদনের জন্য। বাংলা সিনেমাতে কাবিলা নামে এক ভদ্রলোক ছিলেন, বরিশালের ভাষায় মানুষকে আমোদিত করতেন, ফলে এই নামটি উদ্দেশ্যমূলক ভাবে ব্যবহার করে এই তিনজনকে বর্ণবাদ ও আঞ্চলিক কু-বিনোদনের জন্য-ই রাখা হয়েছে।
নামের মধ্যেও এক ধরনের বর্ণবাদ রয়েছে। আপনারা কি কখনো শুনেছেন যে বাড়ীর নারী সাহায্যকারীর নাম নীলা, নীলাঞ্জনা, অর্পিতা, ফিওনা এসব হতে? কিংবা পুরুষ সাহায্যকারীর নাম নিঝুম, ইথান, সৌম্য, জয়ন্ত, অর্ক এমন হতে? উত্তর হচ্ছে না দেখেন নি। দেখেছেন রহিমার মা, সখিনার মা, জুলেখা কিংবা আবুল, আব্দুল, হাবু, গাবু এইসব নাম হতে। ভালো করে লক্ষ্য করলে এই বিষয়গুলো বুঝতে পারা যায়। যেন ঘরের সাহায্যকারীর নামের ভেতর মাধুর্য্য থাকতে নেই। এটা রাখলেই তাঁরা এলিট সমাজে ঢুকে পড়বেন।
এই নাটকে কাবিলা ছেলেটিকে খুব চালাক ও ধূর্ত দেখানো হয়েছে। তার মা নোয়াখালীর চেয়ারম্যান, বজরা বাজারের জাকিরকে সে দেখতে পারেনা, তার মেয়ে বন্ধু রোকেয়া এবং রোকেয়ার সাথে সে আঞ্চলিক ভাবে কথা বলে মানুষকে বিনোদন দেয়।
এই কাবিলা, শুভ, হাবু ( যথাক্রমে পলাশ,সাব্বির ও আলম সাহেব) এরা তিনজনই যে দু’টি সুনির্দিষ্ট অঞ্চলকে হেয় করে এই অভিনয়টি করে যাচ্ছেন, সেটি হয়ত তারা নিজেরাও বুঝতে পারেন না। কিন্তু খুব গভীরে বিবেচনা করলে বুঝতে পারা যায় এই তিনটি চরিত্র-ই রাখা হয়েছে পাবলিককে বিনোদন দেবার জন্য।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে বিনোদন দেয়া হচ্ছে জনতার জন্য, জনতা কি সেটা গিলছে? উত্তর হচ্ছে, অবশ্যই গিলছে। জনতা নোয়াখালীর ভাষা শুনলে হাসে, বরিশালের ভাষা শুনলে হাসে। কোনো কোনো নাটকে রাজশাহীর চাঁপাই নবাবগঞ্জের ভাষায় দুই একটা চরিত্র থাকে, এগুলো শুনেও হাসে।
আমি প্রায়-ই দেখি ইউটিউবের বিভিন্ন ভিডিওতে, গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় বা কোনো পত্রিকার কলামের নীচে পাব্লিক মন্তব্যের যায়গায় কেউ না কেউ এসে লিখে যায় , “নোয়াখালী বিভাগ চাই”। এই পুরো ব্যাপারটিও করা হয় নোয়াখালী অঞ্চলের লোকদের অবজ্ঞা করে, তাদেরকে হাসি রসাত্নক হিসেবে চিত্রিত করে। আমি মোটামুটি নিশ্চিত, “নোয়াখালী বিভাগ চাই” এই মন্তব্যটি করে অন্য অনেক ব্যাক্তি সুখ পায়, আমোদ পায় এবং হাসাহাসি করবার একটা উপলক্ষ্য পায়।
বাংলাদেশের পাহাড় অঞ্চলে মূলত যারা থাকেন যেমন চাকমা সম্প্রদায়, মারমা সম্প্রদায়, তাঁদের দেখলেও আমরা ব্যাঙ্গ করি। আমরা তাদের চিংকু বলে পেছনে ফোড়ন কাটি। তাদের খাদ্যাভাষ নিয়ে মজা করি, তাদের গৌরবগুলো নিয়ে ইতরামি করি।
বাংলাদেশের একজন সরকারী কর্মকর্তাকে বদলী করবার কথা মনে হলেই আমরা বলি বান্দরবনে বা রাঙামাটিতে বদলী করে দিব। যেন এই দুই অঞ্চলে যাওয়া একটা শাস্তি। যেন এই দুই অঞ্চল, কোনো অঞ্চল নয়। এরা গৌণ এবং এটা শাস্তির যায়গা। ঠিক বহুকাল আগে ইংরেজরা অপরাধীদের নির্বাসনে পাঠাতো সূদূর অস্ট্রেলিয়াতে। তেমন।
শুধু আঞ্চলিকতাই নয়, বাংলাদেশের মানুষ বর্ণবাদেও কয়েক ধাপ উপরে। নাটকের মধ্যে অহরহ দেখানো হয় কালো বলে বিয়ে হচ্ছেনা, একজন আরেকজনকে কাইল্লা বলছে, নিগ্রো বলছে। আফরান নিশো নামের এক ভদ্রলোকের একটা নাটক দেখছিলাম, যেখানে একটা ছেলেকে বলা হচ্ছে “ঐ তুইতো কাইল্লা-ই, তোর বিয়া হবে কেমনে?”। এমন কালো বর্ণের জন্য বিয়ে হচ্ছেনা, এরকম অসংখ্য নাটক রয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের বড় বাজার বাংলাদেশ। ফেয়ার এন্ড লাভলী, হেনোলাক্স ইত্যাদি।
আমার এক আত্নীয়ের ক্ষেত্রেই এমন ঘটনা রয়েছে। আমার সেই আত্নীয়ের দুই মেয়ে। গ্রামে থাকেন তাঁরা। বড় মেয়ের বিয়ের সময় ছোট মেয়ে কালো বলে তাঁকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো। কেন লুকিয়ে রাখা হয়েছে, কি কারনে হয়েছে তার আগা-মাথা আমি কিছুই জানিনা। মিথের মত এসব শুনেছি আর বিষ্ময় নিয়ে ভেবেছি, এত নোংরামো-ও হতে পারে?
অঞ্চলের পর রয়েছে ধর্ম নিয়ে নোংরামো। ধর্ম নিয়ে বলে আসলে শেষ করা যাবে না। ইউটিউবে কাঠ মোল্লাদের ওয়াজগুলো শুনলেই বুঝতে পারা যায় মুসলমান ছাড়া অন্য ধর্মের ব্যাক্তিদের কি জ্ঞান করা হয়। শুধু মসুলমান কেন? বাংলাদেশের অনেক হিন্দুরা বাড়ীতে মসুলমান পা দিলে, তারা যাবার পর পুরো বাড়ী পরিষ্কার করে। এমন অভিজ্ঞতা আমার পরিচিত অনেকের-ই হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্নজীবনী পড়লে এই বিষয়ে বেশ কিছু তথ্য পাবেন।
বাংলাদেশের মানুষ গায়ের রঙের দিক থেকে কালো, ফর্সা, শ্যমলা, উজ্জ্বল শ্যমলা এমন অসংখ্য শেডে ভাগ করে মানুষকে বিবেচনা করে। আমি ইংল্যান্ড থেকে ঢাকায় ফিরলেই কিছু আত্নীয় স্বজন দেখা হলেই বলে, “নিঝুম এত কালো হয়ে গ্যাছো কি করে? তুমি তো ছোটবেলায় অনেক ফর্সা ছিলা”।
বাংলাদেশে থাকার সময় এসব ব্যাপার না বুঝলেও, দীর্ঘ সময় পশ্চিমে থাকার কারনে এসব কথা শুনে রীতিমত বিষ্ময় লাগে। আমি এইসব বক্তব্যে পালটা উত্তর দেইনা। কারন আমি যেই উত্তর দিব সেটি কারো জন্যই সুখকর হবে না ফলে পারিবারিক শান্তির জন্য চুপ করে অন্য প্রসঙ্গে চলে যাই।
সমগ্র পৃথিবীতেই মানুষের গায়ের বর্ণের পার্থক্য রয়েছে এবং সেটি প্রাকৃতিকভাবেই। এই পৃথিবীতে এক সময় ভয়ানক রেসিজম ছিলো এবং সেটি বেশীরভাগ সময় করেছে আসলে পশ্চিমারা, এপারথেইড নামক যে বিষয়টি রয়েছে, সেটির চর্চা দীর্ঘদিন ধরে করেছে পশ্চিম। পশ্চিম আজ সভ্য হয়েছে কিন্তু তাদের লেগেসি রেখে এসেছে কলোনীগুলোতে।
রুয়ান্ডাতে অমানবিক গণহত্যা হয়েছে হুতু আর তুতসী ট্রাইবের মধ্যে। কি পার্থক্য এই দুই ট্রাইবের? কিছুই না, এক ট্রাইবের নাক একটু চাপা আর আরেক ট্রাইবের নাক একটু খাড়া। খাড়া নাক মানেই সেটি এলিট বা উঁচু আর চাপা নাক মানেই অচ্ছ্যুৎ। আপনারা হোটেল রুয়ান্ডা চলচ্চিত্রটি দেখলে আরো অনেক কিছু জানবেন।
কিন্তু এই পার্থক্য দেখিয়ে দিয়ে গেলো কারা? দেখিয়ে দিয়ে গেছে বেলজিয়ান অধিপতি রা। এক সময় রুয়ান্ডা বেলজিয়ামের কলোনী ছিলো। যাবার আগে বিভাজন করে দিয়ে গেছে দুই ট্রাইবে। তেমনি ইংরেজরাও এই দেশে বুনে দিয়ে গেছে নানাবিধ বর্ণবাদ আর বিভাজন। কিন্তু কলোনিয়াল হ্যাঙ্গোভার থেকে আজও মুক্ত হতে পারিনি।
আমার মা’কে আমি সারাটিজীবন নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে শুনেছি, আজও শুনি। ফলে এই ভাষাটি নিয়ে কেউ ইতরামী, ফাতরামী কিংবা ব্যাঙ্গ-বিদ্রুপ করলে আমি কেমন যেন সহ্য করতে পারিনা।
এই পুরো দেশটিকে আমরা যে আসলে রাজনৈতিক বিষয়ে এত গালিগালাজ করি আর এত হতাশা ছড়াই আমরা কি ভেবে দেখেছি জাতি হিসেবে আসলে আমাদের চিন্তা চেতনা কিংবা দর্শনের জায়গাটা কতটা ঠুনকো আর দারিদ্রে ভরা? এই দারিদ্র মনের দারিদ্র। একটু ধাক্কা দিলেই এই জাতির মুখোশগুলো নানানভাবে খসে খসে পড়তে থাকে।
কোথাও বর্ণবাদ, কোথাও আঞ্চলিকতার বিদ্বেষ, কোথাও ধনী আর গরীবের প্রবল পার্থক্য এই দেশটিকে একেবারে আগাগোড়া খেয়ে রেখেছে। এতসব কিছু ফেলে আমি তাই আপাতত দাওয়াত খাওয়া থেকে বিরত নিয়েছি। নোয়াখালীর লোকেদের বলা হয় নোয়খাইল্লা আর তাঁরা খেয়েই বাসায় চলে যান, অতিথির বাসায় থাকেন না, এইসব নোংরা উপকথা শুনবার রুচি হয়না এখন। ফলে দূরত্ব বাড়াই।
আমার জন্মস্থান, আমার মায়ের জন্মস্থান, আমার বাবার জন্মস্থান কিংবা তাঁদের মুখের এই অপার সুন্দর ভাষাগুলোর এই অপমান গুলো গায়ে মাখতে আর ইচ্ছে করেনা।