চামড়ার রঙটা কালো না হলে বোধহয় জর্জ ফ্লয়েডকে মরতে হতো না!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ফ্লয়েড চিৎকার করছিলেন, অফিসার, 'আমি শ্বাস নিতে পারছি না!' তার আর্তনাদে পাত্তা দেয়নি শ্বেতাঙ্গ পুলিশ, পায়ের চাপ বাড়িয়েছে ঘাড়ের ওপর। আচ্ছা, জর্জ ফ্লয়েডের চামড়ার রঙ যদি সাদা হতো, পুলিশ কি এভাবে মেরে ফেলতে পারতো তাকে?
জর্জ ফ্লয়েডের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ ছিল। যে রেস্টুরেন্টে তিনি কাজ করতেন, সেটার সামনে থেকেই তাকে গ্রেফতার করেছিল তিন পুলিশ সদস্য। নিরস্ত্র ফ্লয়েডকে রাস্তায় শুইয়ে তার ওপরে চড়ে বসেছিল দুই পুলিশ, একজন আবার হাঁটু দিয়ে চেপে ধরেছিল ফ্লয়েডের ঘাড়ের ওপরে। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল ফ্লয়েডের, ব্যথায় চিৎকার করছিলেন তিনি, বলছিলেন- "Officer, I can't breathe officer! I can't breathe! My stomach hurts! My neck hurts! Everything hurts! I want some water, or something! Please!"
কিন্ত সেসব আর্তনাদে কান দেয়ার চেষ্টাও করেনি পুলিশ। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া লোকজন অবাক হয়েছে এমন বর্বর আচরণে, কেউ মোবাইলে ভিডিও করেছে, কেউবা এগিয়ে এসে বলেছে, "ও তো বাধা দিচ্ছে না, কেন তোমরা ওকে এভাবে চেপে ধরে রেখেছো? রক্ত বেরুচ্ছে ওর! তোমরা মজা পাচ্ছো এটা করে? নিজেদের চেহারাটা একবার আয়নায় দেখো, পিশাচের মতো লাগছে তোমাদের!" ফ্লয়েডের মুখ থেকে ফেনা বেরুচ্ছিল, নাক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল রক্ত। কিছুক্ষণ অদ্ভুত গোঙানীর মতো আওয়াজ করে নিস্তেজ হয়ে গিয়েছিল তার শরীরটা। পুলিশ দুজন তখনও তার শরীরের ওপর থেকে নড়েনি।
খানিক পরে এম্বুলেন্স এসেছে, ফ্লয়েডের নিথর শরীর তোলা হয়েছে তাতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জানা গেছে, দম বন্ধ হয়ে মারা গেছে জর্জ ফ্লয়েড, যার বিরুদ্ধে সামান্য একটা অভিযোগ ছিল বিশ ডলারের জাল নোট কাস্টোমারকে দেয়ার, হয়তো না জেনেই দিয়েছিলেন। কিংবা জেনে-বুঝে দিলেও, অপরাধ প্রমাণীত হলে সর্বোচ্চ মাস ছয়েকের সাজা হতো, কিংবা দিতে হতো জরিমানা। ফ্লয়েড দোষী কিনা আমরা জানিনা, যদি হয়েও থাকেন, ভীষণ লঘু একটা পাপে চরম দণ্ড দিতে হলো তাকে। প্রতারণার চেয়ে বড় অপরাধ তো তিনি জন্মের সময়ই করেছেন- গায়ের রঙ কালো নিয়ে দুনিয়ায় এসেছেন, বাস করেছেন আমেরিকার মতো দেশে, যেখানে শুধুমাত্র গায়ের রঙের কারণেও কাউকে প্রাণ দেয়া লাগতে পারে!
ফ্লয়েড যদি শ্বেতাঙ্গ হতেন, সাদা চামড়ার ওই দুই পুলিশ অফিসার কি তার গায়ের ওপর এভাবে চড়ে বসতে পারতো? রাস্তায় ফেলে ঘাড়ের ওপর হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে পারতো? দম আটকে ফ্লয়েড যখন চিৎকার করছেন, তখন সেসব না শোনার ভান করে মুখে পৈশাচিক হাসিটা ফুটিয়ে রাখা সম্ভব হতো পুলিশের ওই অফিসারের পক্ষে? এসব প্রশ্নের একটাই উত্তর- না!
আমেরিকায় গত বছর এক হাজারের বেশি মানুষ পুলিশের হাতে নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে ৭৫-৮০ শতাংশই কৃষ্ণাঙ্গ। কালোদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বেশি, এটা সত্যি। কিন্ত হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট আমেরিকান পুলিশের কিছু কর্মকাণ্ড বারবার প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দেয়, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, আইন আসলে সবার জন্যে সমান নয়। সেটা বাংলাদেশের মতো আমেরিকার বেলাতেও সত্যি।
জর্জ ফ্লয়েডকে যেখানে খুন করা হয়েছে, সেই মিনিয়াপোলিস এখন রণক্ষেত্র। কালো মানুষেরা ফুঁসে উঠেছে, নেমেছে রাস্তায়। পুলিশ স্টেশন জ্বালিয়ে দিয়েছে, থানার বাইরে দাঁড়িয়ে পুলিশ সদস্যরাই দর্শক হিসেবে দেখেছে আগুনের সেই লেলিহান শিখা। কোন প্রতিরোধে যায়নি তারা, জানতো, গেলে হিতে বিপরীত হবে। একজন নিরস্ত্র অসহায় মানুষকে রাস্তায় চেপে ধরে মেরে ফেলা আর কয়েক হাজার প্রতিবাদীর সঙ্গে লাগতে যাওয়া তো এক জিনিস নয়।
কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা #BlackLivesMatter নামের মুভমেন্টটা চালু হয়েছে আবার, করোনাভাইরাস, লকডাউন- সবকিছুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শহরে শহরে গর্জে উঠছে মানুষ, সেই মিছিলে কালোরা যেমন আছে, তেমনই উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আছে সাদাদের অংশগ্রহণও। ঠান্ডার মধ্যেই খালি গায়ে বুকে-পিঠে নির্যাতনবিরোধী স্লোগান লিখে ঘুরছে তারা। মাথায় ব্যান্ডানা, হাতে প্ল্যাকার্ড- সবকিছুতেই এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার বাণী! বিক্ষোভ হয়েছে হোয়াইট হাউজের সামনেও, জ্বলেছে আগুন।
১৭ বছরের ট্রেভর মার্টিনকে গুলি করে মেরেছিল এক নিরাপত্তাকর্মী, তার অপরাধ ছিল, সে মুখে মুখে তর্ক করছিল! জর্জ ফ্লয়েডের মতোই দম আটকে মেরে ফেলা হয়েছিল এরিক গার্নারকে। তর্ক করায় মাইকেল ব্রাউনকে গুলি করে মেরেছিল ড্যারেন উইলসন নামের এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার, আদালত পরে রায় দিয়েছে, আত্মরক্ষার্থেই নাকি গুলি চালিয়েছিল ড্যারেন! নিরস্ত্র এক কিশোরের হাত থেকে আত্মরক্ষার্থে গুলি কেন চালাতে হবে- এই প্রশ্নটা কেউ করেনি বিচারককে! ওয়াল্টার স্কট, ফ্রেডি গ্রে, সান্ড্রা ব্ল্যান্ড, আতাতিয়ানা জেফারসন, ব্রেওনা টেলর- নামের তালিকাটা বলতে শুরু করলে কেবল দীর্ঘই হবে। এদের কারো হত্যাকান্ডের বিচার হয়নি। দুয়েকটা ঘটনায় অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যকে চাকরি থেকে অব্যহতি দেয়া হয়েছে। কারাদণ্ড বা ফাঁসির সাজা হয়নি কারোরই।
তবে এসব প্রতিরোধ-প্রতিবাদে আদতে লাভ নেই। হোয়াইট সুপ্রিমিস্টদের নাকউঁচু স্বভাব আর কালোদের মানুষ হিসেবে মনে না করার মানসিকতা কোনদিনই দূর হবে না। আমেরিকায় এমন উদাহরণ তো একটা দুটো নয়। যে অবজ্ঞা, অবহেলা মার্টিন লুথার কিংকে সইতে হয়েছে, মোহাম্মদ আলীকে বরণ করতে হয়েছে, যে ঘৃণার বীজ থেকে জর্জ ফ্লয়েডকে জীবন দিতে হয়েছে- সেটা কখনও সমূলে উৎপাটন করা সম্ভব নয়। ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতার মতোই বিষবাস্প হয়ে বাতাসে থাকবে বর্ণবাদের ঘৃণার রেণু।
আরও প্রাণ যাবে, আবার ফুঁসে উঠবে সাধারণ মানুষ, কয়েকদিন পরে আবার সব ভুলেও যাবে। জর্জ ফ্লয়েডরা টিকে থাকবেন সংখ্যা হিসেবে। বিপ্লব, আন্দোলন, মুভমেন্ট- এসব অচল হয়ে গেছে এখন। দ্রোহের আগুনের মেয়াদ সীমিত, লম্বা হলেও ফলাফলটা ভালো কিছু হয় না। এই প্রজন্ম আরব বসন্ত দেখেছে, তাতে কি এমন বদলটা এসেছে? মধ্যপ্রাচ্য আরও বেশি অশান্ত হয়েছে, আরও বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, পুরনো স্বৈরাচারের পতন ঘটে নব্য স্বৈরাচার এসেছে সেসব দেশে। নতুন বোতলে সেই পুরনো মদই উপহার পেয়েছে মানুষ।
সবকিছু মেনে নিতে হবে, মানিয়ে নিতে হবে জেনেও কেন যেন এসব ঘটনার পর মানুষ হয়েও মানুষ প্রাণীটার প্রতি তীব্র ঘৃণার জন্ম নেয়। মনে হয়, করোনায় পুরো মানবসভ্যতা শেষ হয়ে গেলেই ভালো হয়। কালো হবার অপরাধে, অন্য ধর্ম মানার অপরাধে, গরুর মাংস খাওয়ার অপরাধে যখন মানুষ মানুষকেই মারে- তখন এই প্রাণীটা পৃথিবীতে টিকে থাকার অধিকারটা হারিয়ে ফেলে। মুখ খারাপ করে আমরা কাউকে শুওর-কুকুর বা হায়েনার সাথে তুলনা করি। অথচ এই নির্বোধ প্রাণীগুলোও কিন্ত স্বজাতিকে অকারণে হত্যা করে না কখনও। 'আশরাফুল মখলুকাত' বা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠতম জীব হিসেবে মানুষ আসলেই যোগ্য কিনা- এই প্রশ্নটা উদয় হয় মনের ভেতর...