র্যাডক্লিফ লাইন: ইতিহাসের সবচেয়ে কুৎসিত সীমান্তভাগ!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ভারতের 'ভ' না জানা একটি মানুষকে দেয়া হলো আশি মিলিয়ন মানুষের দেশ নির্ধারণের ভার। সময় দেয়া হলো কয়েক সপ্তাহ। র্যাডক্লিফ যে জুয়োটি খেললেন এই উপমহাদেশ নিয়ে, ইতিহাসে এরকম ঘৃণ্য, নৃশংস, বর্বর ঘটনা ঘটেনি আর একটিও...
ভারতীয় উপমহাদেশ অনেক ইতিহাসের স্বাক্ষী। সীমান্ত, কাঁটাতার, ধর্ম নিয়ে এখানে যে পরিমাণ হিংস্রতা, রক্তপাত, প্রাননাশ, নাটকীয়তা হয়েছে, এরকমটি হয়নি আর কোথাও। হাস্যকর বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তৎকালীন বিভিন্ন কর্তৃপক্ষ, মাশুল গুনেছে সাধারণ মানুষজন। বুড়ো খোকাদের ভীমরতির শাস্তি এদেশের তৃণমূল মানুষদেরই ভোগ করতে হয়েছে বরাবর। বুড়ো খোকাদের ভীমরতির সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ নিঃসন্দেহে র্যাডক্লিফ লাইন! যে লাইন এতটাই হাস্যকর, কলমের এক খোঁচায় ঘরের এক প্রান্ত চলে যায় এক সীমান্তে, আরেক প্রান্ত আরেক সীমান্তে। লাখ লাখ মানুষ ঘরছাড়া হলো, দাঙ্গায় রক্ত ঝরলো। আমরা হাসতে হাসতে 'র্যাডক্লিফ লাইন' এর হোতা শেরিল র্যাডক্লিফকে গালিগালাজ করে এলাম বরাবরই। বললাম, না জেনে, চোখ বুঝে দেশভাগ করতে গিয়েছে সে। কিন্তু পুরো ইতিহাস জানলে স্যার শেরিল র্যাডক্লিফকে পুরো দোষ দেয়া যাবেওনা আসলে।
১৫ জুলাই, ১৯৪৭ সালে ইন্ডিয়ান ইন্ডিপিন্ডেন্স এ্যাক্ট-১৯৪৭ পাশ হয় লন্ডনের পার্লামেন্টে। যেখানে বলা হয়, আগামী মাস অর্থাৎ ১৫ই আগস্ট, ১৯৪৭ থেকে ভারতে ব্রিটিশদের শাসন থাকবেনা। ভারতীয়রা তাদের দেশ তাদের মত করেই শাসন করবে। এবং ভারত মহাদেশ দুইটি ভাগে ভাগ হবে- ভারত ও পাকিস্তান।
কিন্তু এই দেশ ভাগ কে করবে? ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ গঠন করলো বাউন্ডারি কমিশন। পাঞ্জাব ও কলকাতা এই দুই প্রদেশের জন্যে। এই দুই প্রদেশের মধ্য দিয়েই বাউন্ডারি লাইন আঁকা হবে। এখন প্রশ্ন উঠলো, কাকে এই বাউন্ডারি কমিশনের দায়িত্ব দেয়া যায়। কেউ যেটা দূরতম কল্পনাতেও ভাবতে পারেনি। সেটাই হলো। লর্ড মাউন্টব্যাটেন এই দুই প্রদেশের বাউন্ডারি কমিশনের চেয়ারম্যান বানালেন স্যার শেরিল র্যাডক্লিফকে। ব্রিটিশ এই উকিল তখন ছিলেন শিমলায়। যিনি ভারতের ঘোরেননি সিকিভাগও। ভারতের ভৌগোলিক অবস্থা কীরকম, জনসংখ্যা কীরকম, ভারতের মানুষদের অবস্থা কীরকম তা নিয়ে কোনো জ্ঞান ছিলোনা তার। তাকে ডাকা হলো, দুই বাউন্ডারি কমিশনের চেয়ারম্যান করা হলো। পাঁচ সপ্তাহ সময় দেয়া হলো। বলা হলো- ভাগ করো। চারশো মিলিয়ন মানুষের ভাগ্য এবং ১ লাখ ৭৫ হাজার বর্গমাইল এলাকার দায়িত্ব দেয়া হলো এমন মানুষকে, ভারত নিয়ে যার জ্ঞান ভারতের একজন নিরক্ষর মানুষের চেয়েও কম। অনেককাল ধরে এই উপমহাদেশে থেকে আসা মানুষের ভিটেমাটি নিয়ে জুয়োখেলার দায়িত্ব দেয়া হলো এক বিদেশিকে। বলা হলো, এমনভাবে ভাগ করতে হবে, যাতে দুই দেশের আয়তন ঠিক থাকে। মানুষজন যাতে ঠিকঠাক বন্টন হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানরা যেন পাকিস্তানের সীমানা পায়, বাকিরা যেন পায় ভারতের সীমানা।
র্যাডক্লিফকে কিছু দলিলপত্র, বই, ম্যাপ দেয়া হলো। র্যাডক্লিফের নিজের ভাষাতেই, যেগুলো ছিলো ভুল তথ্যে ভরা, অনেক পুরোনো পরিসংখ্যানে ভরা, এবং মিথ্যে তথ্যে ভরা কাগজপত্র। যা পড়ে এবং যার সাহায্য নিয়ে তার কোনো লাভই হয়নি। তাকে দেয়া হলো একটি টীমও। টীমে তিনি ছাড়া মানুষ চারজন। দুইজন ভারতের পক্ষের ও দুইজন পাকিস্তানের পক্ষের। ভারতের পক্ষে ছিলেন- মেহের চন্দ্র মহাজন ও তেজা সিং। পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন- দিন মোহাম্মদ ও মোহাম্মদ মুনীর। তারা প্রত্যেকেই ছিলেন সে সময়ে বিভিন্ন কোর্টের বিচারক। এদের প্রত্যেকেই নিজ নিজ দেশের স্বার্থ নিয়ে বেশি ব্যস্ত ছিলেন, সীমান্তের সুষ্ঠু বন্টনের দিকে নজর ছিলোনা কারোরই। তবে এদের মধ্যে মেহের চন্দ্র মহাজন ছিলেন বেশ নিরপেক্ষ। ভৌগোলিক ও আইনী জ্ঞান দিয়ে তিনি র্যাডক্লিফকে অনেকটাই সাহায্য করেছিলেন। নাহয় সীমান্তের কাঁটাছেড়া আরেকটু বিচ্ছিরি হতেই পারতো!
এই কমিশনের মেম্বারদের সমস্যা হলো, তারা কাজ করার চেয়ে কাজ পণ্ড করতেন বেশি। কারণ, প্রথমত, এরা চাইছিলেন, নিজ নিজ দেশের সীমানা বাড়াতে এবং প্রতিপক্ষ দেশ যাতে কম পায়, সে চেষ্টা করতে। মতের মিল তাদের মোটেও হচ্ছিলো না। সিদ্ধান্ত তাই র্যাডক্লিফকেই নিতে হচ্ছিলো অধিকাংশ সময়ে। তাছাড়া এরা কাজ করার চেয়ে কাজে বিঘ্নও ঘটাচ্ছিলেন বেশি। একটা ঘটনা বললে সেটা বুঝতে সুবিধে হবে। দার্জিলিং'কে যখন ভারতের অংশ করা হচ্ছে, তখন পাকিস্তানপন্থী বাউন্ডারি কমিশনের একজন মেম্বার র্যাডক্লিফের সাথে গোপনে দেখা করেন এবং বলেন, দার্জিলিং কে পাকিস্তানের অংশ করে দিতে। কারণ, তার পরিবার প্রত্যেকবার গরমের সময়ে দার্জিলিং যায়। এখন দার্জিলিং যদি ভারতের অংশ হয়, তাদের খুব সমস্যা হবে!
এ তো গেলো কমিশনের মেম্বারদের কথা। মাউন্টব্যাটেনের নির্দেশ ছিলো যত তাড়াতাড়ি পারা যায় কাজটা শেষ করতে হবে। কিন্তু ওদিকে র্যাডক্লিফের পক্ষেও কাজ শুরু করা সম্ভব হচ্ছেনা। জুনের তীব্র গরমে পাঞ্জাবে ফিল্ড সার্ভে করা সম্ভব ছিলো না মোটেও। তাছাড়া পাঞ্জাবের প্রভিন্সিয়াল এ্যাসেম্বলি চলছিলো তখন। আইন অনুযায়ী, এই এ্যাসেম্বলি শেষ হওয়ার আগে কোনোভাবেই র্যাডক্লিফের পক্ষে কাজ শুরু করার অধিকার নেই। এ্যাসেম্বলি যখন শেষ হলো, তখন হাতে সময় নেই বললেই চলে। 'র্যাডক্লিফ লাইন' টানার আগে শেরিল র্যাডক্লিফ শুধুমাত্র ভারতের উত্তরাঞ্চলের ডাকোটাতে যেতে পেরেছিলেন। আর কোথাও যাওয়া সম্ভব হয়নি। একরকম ঘরে বসেই তিনি মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করেছেন! তাদের জীবন-মৃত্যু নির্ধারণ করেছেন!
এর মধ্যেও কিছু মজার ঘটনা ঘটেছিলো। তিনি ভারতকে 'লাহোর' প্রায় দিয়েই দিচ্ছিলেন। কারণ লাহোরে হিন্দু ও শিখরা ছিলো সংখ্যাগরিষ্ঠ। আর তাকে সীমান্ত ভাগ করতে বলা হয়েছে ধর্মেরই ভিত্তিতে। পরে তার টনক নড়লো, ভারতকে কলকাতা দেয়া হয়েছে। আরেকটা বড় শহর ভারতকে দেয়া হলে, সেটা অবিচার হবে। তাই লাহোর চলে যায় পাকিস্তানের মধ্যে। জিন্নাহ সহ উচ্চপদস্থ অনেক মুসলিম নেতাই এই সিদ্ধান্তে খুশি হয়েছিলেন তখন।
এবং ক্রমাগত র্যাডক্লিফকে চাপ দেয়া হচ্ছিলো সীমান্তভাগের জন্যে। র্যাডক্লিফ নিজেও আক্ষেপ করেছিলেন, দুই-তিন বছর সময় যদি তিনি পেতেন, তাহলে কাজটা তিনি হয়তো আরেকটু ভালো করতে পারতেন। কিন্তু মাউন্টব্যাটেন সহ বাকি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের ভয় ছিলো, যদি বেশি দেরী হয়, তাহলে গণ্ডগোল হতে পারে। স্বাধীনতার সময় ঘনিয়ে আসছে। অবিভক্ত মানচিত্র দিলে, ম্যাসাকার হতে পারে। এবং এই ভূখণ্ড পুরো তালগোল পাকিয়ে যেতে পারে। অনেকটা 'থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়' এর মতন সবকিছু করতে বলা হলো র্যাডক্লিফকে।
এর ভেতরে হয়ে গিয়েছিলো আরো কিছু অদ্ভুত ঘটনা। যেমন- ভারত ও পাকিস্তানের যে নদীগুলো, সেগুলোর অধিকার পেয়ে গিয়েছিলো ভারত, আবার খালগুলোর অধিকার পেয়েছিলো পাকিস্তান। এ নিয়ে ১৯৪৭ এর পর কম জলঘোলাও হয়নি। নেহরু ও আইয়ুব খানের যৌথ উদ্যোগে 'ইন্দুস বেসিন ট্রিটি'ও করা হয়। যেটা নিয়ে পরে নেহরু বেশ আলোচনার মুখেও পড়েন। আগ্রহীরা গুগল করলে জানতে পারবেন এই বিষয় নিয়ে।
যাই হোক, অনেকেরই অভিযোগ ছিলো, র্যাডক্লিফ হিন্দুদের বেশি সুবিধে দিয়েছিলেন এই 'র্যাডক্লিফ লাইন' এর মাধ্যমে। এই বিষয়ে পরে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন-
মোটেও না। বরং আমি মুসলমানদের বেশি সুবিধে দিয়েছি। নিয়ম অনুযায়ী লাহোর ভারতের পাওয়ার কথা। আমি দেইনি।
তাছাড়া কাশ্মীর ভাগ করাও নিয়ে তার সমালোচনা করেন অনেকে। যদিও তিনি বলেন, কাশ্মীরের ইতিহাস, ভূগোল কিছুই জানতেন না তিনি। একরমকম আন্দাজেই তাই কাশ্মীরকে কাটাছেঁড়া করা হয়েছে।
যেটাই হোক না কেন, র্যাডক্লিফের এই বিতর্কিত 'র্যাডক্লিফ লাইন' এর পর বারো মিলিয়ন মানুষ রাতারাতি ঘরছাড়া হন। ৯ই আগস্ট তিনি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট সাবমিট করেন, ১৫ই আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস ঘোষণার পর এই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। লাখ লাখ মানুষ ঘরছাড়া হওয়ার পাশাপাশি শুরু হয় রক্তাক্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। মানুষ, মানুষকে স্রেফ কচুকাটার মতন ছিন্নভিন্ন করে, জবাই করে, জীবন্ত পুড়িয়ে ফেলে। কৃষণ চন্দর, খুশবন্ত সিং, সাদত হোসেন মান্টোর বইগুলো পড়লে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার খুব ভালো ধারণা পাওয়া যাবে। লাখ লাখ মানুষ মারা যায়, আহত হয়, অজস্র নারী ধর্ষিত হয় এই 'র্যাডক্লিফ লাইন' ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জের ধরে। এরমধ্যেই র্যাডক্লিফ চলে যান লন্ডনে। যাওয়ার আগে নিজের সব নথিপত্র পুড়িয়ে দিয়ে যান তিনি। তিনি বুঝতে পারছিলেন, তার ভুলের মাশুল দিচ্ছে গোটা উপমহাদেশ। তাকে নাইট গ্রান্ড ক্রস অফ দি অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার দেয়া হয়। সেটা তিনি গ্রহণ করলেও তাকে দেয়া তিন হাজার পাউন্ডের বেতন তিনি প্রত্যাখান করেন। তিনি বলেন-
আশি মিলিয়ন মানুষ ঘৃণার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, আমি এটা নিতে পারছিনা।
অথচ তাকেও কী পুরোটা দোষ দেয়া যায় এখানে? ইতিহাস মোটেও তা বলেনা কিন্তু।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন