শারীরিক সৌন্দর্য্য নয়, রাধিকার ইউএসপি হচ্ছে মেধা, তার অভিনয়প্রতিভা। গ্ল্যামারাস রোলে তিনি যেমন দারুণ, পাশের বাড়ির মেয়ের চরিত্রেও একদম সাবলীল। অ্যাকশন, থ্রিলার কিংবা রোমান্টিক- সব চরিত্রেই তিনি দারুণ মানানসই...

একটা সময় ছিলো যখন বলিউডে নায়িকা হতে গেলে যোগ্যাতার প্রথম এবং প্রধান মাপকাঠি ছিলো সৌন্দর্য্য। নায়িকাদের সুন্দর ফিগারের সাথে সাথে সুন্দরী এবং নৃত্যে পারদর্শী হতে হতো। তবে সময়ের সাথে সাথে সেই সমীকরন বদলে দিচ্ছিলেন অনেকেই। যেমন আশির দশকে স্মিতা পাতিল বা শাবানা আজমীদের সময় শুরু করে থেকে নব্বই দশকে টাবু বা নন্দিতা দাশ দুই ধারার সিনেমাতেই সফল হলে একটু একটু সেই ধারনা বদলালেও তথাকথিত বানিজ্যিক ধারার নায়িকা হিসেবে তাদের সেভাবে মূল্যায়ন হয়নি।

তবে এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে সব সমীকরন বদলে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত। এখন বলিউডে তথাকথিত সুন্দরীদের বাইরেও অনেকে নিজেদের শক্তিশালী অভিনয় দক্ষতা, মেধা, অভিনয়ের প্রতি ডেডিকেশন, পরিশ্রম দিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পিছপা হচ্ছেন না। তাদেরই একজন এই সময়ের আলোচিত এবং জনপ্রিয় অভিনেত্রী রাধিকা আপ্তে। ১৯৮৫ সালে আজকের দিনে জন্মগ্রহণ করা এই অভিনেত্রীর ৩৫ তম জন্মদিন উপলক্ষে আজকের এই বিশেষ ফিচার। 

রাধিকা আপতে বলিউডে এই মুহূর্তে এক আস্থাভাজন এবং জনপ্রিয় অভিনেত্র হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার অসাধারন অভিনয় দক্ষতা সিনেমাপ্রেমী কারোই অজানা নয়। তবে বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে সফল অভিনেত্রী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার গল্পটা সিনেমার চেয়ে কম রোমাঞ্চকর নয়। রাধিকার জন্ম তামিলনাড়ুর ভেলোরে। তাঁর বাবা-মা দু’জনেই চিকিৎসক। রাধিকা নিজেও ভীষণ মেধাবী। পুণের ফার্গুসন কলেজ থেকে অর্থনীতি এবং অঙ্ক নিয়ে স্নাতন করেছেন তিনি। পুণেতেই তার বেড়ে ওঠা। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনা এবং নাচে তিনি সমান পারদর্শী। আট বছর ভারতের অন্যতম সেরা নৃত্যশিল্পী রোহিণী ভাটের কাছে তিনি কত্থক নৃত্য শিখেছেন। 

একটা সময় নাচের পাশাপাশি রাধিকা পুণের থিয়েটার গ্রুপের সঙ্গেও যুক্ত হন। সেখানেই অভিনয়ের সাথে তার সখ্যতা। তারপর সিনেমায় কাজ করার ইচ্ছা থেকেই স্বপ্ননগরী মুম্বাইয়ে পাড়ি জমান। কিন্তু মুম্বাইয়ে সিনেমার জন্য অডিশন দেওয়ার সময় খুব খারাপ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলে ফের পুণেতে বাবা-মার কাছে চলে যান। সেখানে গিয়ে পাকাপাকিভাবে আবার যোগ দেন থিয়েটারে। তবে যার চোখে সিনেমার অভিনয় করার স্বপ্ন সারাদিন ঘুরপাক খাচ্ছে তার কি থিয়েটার নিয়ে সন্তুষ্ট থাকলে চলে!! না চলেনা তাই রাধিকাও আবার সেকেন্ড চান্স হিসেবে আবার পাড়ি জমান মুম্বাইয়ে। 

রাধিকা আপ্তে

সিনেমায় পুরোদমে কাজ করার আগে  রাধিকার ক্যারিয়ার শুরু করেন মাত্র আট হাজার টাকা বেতনে, মুম্বাইয়ের একটি থিয়েটার কোম্পানিতে কাজে যোগ দেন তিনি। মুম্বাইয়ের গোরেগাঁওয়ের একটি পুরনো বাড়ির ছোট ঘরে পেয়িং গেস্ট থাকতেন তিনি। রুম শেয়ার করতেন তখন আরো দুজন মেয়ের সাথে। অবশেষে  ‘বাহ! লাইফ হো তো অ্যায়সি’ সিনেমার মধ্যে দিয়ে ২০০৫ সালে বড় পর্দায় অভিষেক হয় তার। এর পরের বছরই নামী প্রযোজক একতা কাপুরের ‘দার্মিয়া’ সিনেমাতে অভিনয় করেন তিনি। 

তবে টলিউডে তথা বাংলা সিনেমাপ্রেমীদের নজর কেড়েছিলেন ‘অন্তহীন’ সিনেমার মধ্যে দিয়ে। ২০০৯ সালে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা সিনেমার পুরস্কার পাওয়া ‘অন্তহীন’ সিনেমাতে অসাধারন অভিনয় করে চমকে দেন সবাইকে। এই সিনেমার সফলতার রেশ যেয়ে পড়েছিলো মুম্বাইতেও। তারপর থেকেই ভিন্নধর্মী নানা সিনেমার অফার আসা শুরু। এবং সেই সুযোগ পুরোপুরি নিষ্ঠার সাথে কাজে লাগিয়ে তিনি আজকে বলিউড ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও জনপ্রিয় একটি নাম। 

সুজয় ঘোষের স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা ‘অহল্যা’ হোক বা রামগোপাল ভার্মার ‘রক্তচরিত্র’ সিনেমার প্রথম দুই কিস্তি অথবা অনুরাগ কাশ্যপের স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা ‘পারচ্ছেদ’ রাধিকা প্রথম থেকেই চেনা ছকের বাইরে এসে নিজেকে প্রমান করেছেন। ‘কৌন কিতনে পানি মে’ বা ‘মানঝি’ থেকে ‘বদলাপুর’ বা সাম্প্রতিক সময়ের ‘দ্যা ওয়েডিং গেস্ট’, ‘প্যাডম্যান’ বা ‘আন্ধাধুন’ রাধিকা প্রমান করেছেন তিনি অন্যদের থেকে আলাদা। নেটফ্লিক্সের ‘দ্যা লাস্ট স্টোরিজ’ ‘সেক্রেড গেমস’ বা ‘ঘউল’ সব চরিত্রেই অসাধারন তিনি। ডি-গ্ল্যাম লুকের বাইরেও সাহসী অভিনেত্রী হিসেবেও যথেষ্ঠ নামডাক রয়েছে রাধিকার। 

বরাবরই ভিন্ন ধরনের চরিত্র নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে ভালবাসেন। ডি-গ্ল্যাম লুকের বাইরে যে কোনও সাধারণ চরিত্র সবকিছুতেই সাবলীল এই তন্বী অভিনেত্রী। একের পর এক ভিন্নধর্মী কনটেন্ট নির্ভর সিনেমায় অভিনয় করে রীতিমতো দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছেন তিনি। আর তার জনপ্রিয়তা শুধুমাত্র বলিউডেই সীমাবদ্ধ নেই তিনি। বলিউডের গন্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও রীতিমতো এক জনপ্রিয় মুখ তিনি। সিনেমার পাশাপাশি ওয়েব সিরিজ মাতাচ্ছেন তিনি। তার সাফল্যের অন্যতম কারন হিসেবে ওয়েব সিরিজ বা ওয়েব ফিল্ম এটা বললেও খুব ভুল বলা হবেনা। সমসাময়িকদের থেকে একটু ভিন্নভাবে উপস্থিত হবার ইচ্ছা সাথে তার অভিনয় দক্ষতা, এক্সপ্রেশন, গ্ল্যামার, স্ক্রিপ্ট বাছাই তাকে এনে দিয়েছে অভাবনীয় সাফল্য। 

সব ধরণের রোলেই তিনি মানানসই

বাংলা, হিন্দি, তেলেগু, মারাঠি, তামিল, মালায়লাম সব ভাষার সিনেমাতেই কাজ করেছেন তিনি। এতো ব্যস্ততার মধ্যেও মঞ্চে কাজ করছেন তিনি। তিনি বলেছিলেন- ‘মঞ্চ আমার শিকড়, আমার প্রথম ভালোবাসা। এই মাধ্যমে আমি কাজ করতে চাই সবসময়। এটা সত্য যে, থিয়েটারে তেমন কোনো টাকা-পয়সা নেই, এখান থেকে আপনি সহজে তারকাখ্যাতি পাবেন না কিন্তু এটা আপনাকে মাটিতে পা রেখে চলা শেখাবে, বিনয়ী করবে। কখনো আপনাকে মাত্র সাতজন দর্শকের সামনে পারফর্ম করতে হতে পারে। সেটাও নিজের সব উদ্যম, শক্তি ও প্রচেষ্টা দিয়ে করতে হবে। থিয়েটার আপনার মধ্যে দায়িত্ববোধটা তৈরি করে দেবে। থিয়েটারের প্রতি আমার কমিটমেন্ট অন্য যেকোনো কিছুর ঊর্ধ্বে। এমনকি বড় কোনো চলচ্চিত্রেরও ওপরে। কারণ আমি যদি একটা শো মিস করি, তাহলে এর সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সবার ক্ষতি হবে এবং থিয়েটার নিয়ে তাদের যে ভালোবাসা এবং একাগ্রতা সেখানে আঘাত লাগবে। উল্লেখ্য ‘আসাক্তা’ নামের একটা থিয়েটার গ্রুপের সঙ্গে প্রায় ১৪ বছর ধরে কাজ করছেন তিনি। 

ভারতের প্রায় সব সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করার পর তার অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন- একজন অভিনেত্রীর জন্য ‘ইমেজ’ খুব গুরুত্বপূর্ণ। সব সীমাবদ্ধতার মধ্যেই আপনাকে পর্দায় একটা চরিত্রের মাধ্যমে নিজের ‘ইমেজ’ তৈরি করতে হবে এবং সেটা নিজের ভেতর বয়ে বেড়াতে হবে। একজন শিল্পী হিসেবে আপনি কিন্তু মার খেয়ে যাবেন যদি পরপর একই ধরনের চরিত্র করেই যেতে থাকেন। যে মানুষটা সবসময় ভালো মানুষের চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি যদি খলনায়কের চরিত্রে অভিনয় করেন সেটা দর্শকরা স্বাভাবিকভাবে নিতে পারেন না। হ্যা, সে কারণে আঞ্চলিক সিনেমাগুলোতেও টাইপকাস্টের ব্যাপারটা রয়েছে। তারা এটাকে বলে ‘নিজস্ব সংস্কৃতি’। এর পাশাপাশি অনেক প্রথাবিরোধী ছবি হচ্ছে। পরিচালকরা নতুন গল্প নিয়ে কাজ করছেন কিন্তু ইন্ডাস্ট্রির বড় একটা অংশই একই ধরনের কাজ করতে পছন্দ করে, যেসব কাজে সফলতা আসে।

একজন ‘আউটসাইডার’ হয়েও দেশের গন্ডি পেরিয়ে রাধিকার জনপ্রিয়তা আজ আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও। ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যামি এওয়ার্ড’এ সেরা নারী অভিনয়শিল্পী বিভাগে মনোনয়ন পেয়েছিলেন বলিউড অভিনেত্রী রাধিকা আপ্তে। আর এ পর্যন্ত অভিনয়শিল্পী হিসেবে এই মনোনয়ন রাধিকার অর্জনের মুকুটে সবচেয়ে বড় পালক। শুধু রাধিকা কেন, এটি ভারত আর বলিউডের জন্য একটা বড় অর্জন। নেটফ্লিক্সের অরিজিনালের সিনেমা ‘লাস্ট স্টোরিজ’ এ তার অসাধারন পারফরম্যান্সের জন্য এই মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিলো। নেটফ্লিক্সের আরেক জনপ্রিয় সিরিজ ‘সেক্রেড গেমস’ এ নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকী এবং সাইফ আলি খানের শক্তিশালী অভিনয়ের মাঝে হারিয়ে যাননি তিনি। সম্প্রতি নেটফ্লিক্সের আরেকটি সিনেমা ‘রাত আকেলি হ্যায়’তেও তার পারফরম্যান্স প্রশংসিত হয়েছে। 

তিনি একজন সেলফ মেড সুপারস্টার

অভিনয়ের পাশাপাশি কিছুদিন আগে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র পরিচালনা করছেন তিনি। রাধিকার প্রথম পরিচালিত সিনেমার নাম ‘স্লিপওয়াকার্স’। এছাড়া হলিউডে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত একটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি। উইনস্টাইন চার্চিলের ‘সিক্রেট আর্মি’কে সেলুলয়েডে রূপ দিয়েছেন পরিচালক লিডিয়া ডিন পিলচার। ‘এ কল টু স্পাই’ নামের এই সিনেমায় রাধিকার সাথে এই সিনেমায় আরো ছিলেন স্ট্যানা ক্যাটিক, সারা মেগান থমাস। সিনেমাতে রাধিকা অভিনয় করেছেন নূর ইনায়াত খানের চরিত্রে। সিনেমাটি ২০১৯ সালে সারাবিশ্বে মুক্তি পায়। 

২০১১ সালে একটি মজার ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রথমবার ডেটে যান ব্রিটিশ বেহালাবাদক বেনেডিক্ট টেলরের সাথে। সেই ডেট থেকে প্রেম, প্রেম থেকে পরিনয়। ২০১২ সালে বেনেডিক্ট টেলরেকে বিয়ে করেন তিনি। তাই ব্যস্ততার মধ্য একটু সময় পেলেই ব্রিটেনে স্বামীর কাছে ছুটে যান রাধিকা। তার মতে দুজন দুই দেশে অবস্থান করলেও এই দুরত্ব মানসিক ভাবে দুজনকেই আরো কাছে নিয়ে আসে। 

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন যে, অভিনয়ে যতোদিন মজা পাবো বা নিজেকে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রে উপস্থাপন করার সুযোগ পাবো ততোদিন অভিনয় করে যাবো। যখন এমনটা হবেনা তখন ছোটবেলার একটা স্বপ্নে ফিরে যাবো। আমি অঙ্ক প্রচণ্ড ভালোবাসি এবং হয়তো কোনোদিন অঙ্ক পড়াবো কোথাও। আমার দাদি মধুমালতি আপ্তে একজন গণিতবিদ ছিলেন এবং তিনি ভারতে লেখাপড়া শেষ করে পিএইচডি করতে ফ্রান্সে গিয়েছিলেন। তিনি অঙ্কের শিক্ষিকা ছিলেন। তাকে দেখেই এই শিক্ষকতার স্বপ্নটা আমার মধ্য জায়গা করে নিয়োছিলো। অভিনেত্রী হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করার আগে নিজের কাছে নিজেই প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যে একসময় আমি আবার অঙ্কের কাছেই ফিরে আসব এবং আমি এখনো আশা করি যে আমি সেটা পারবো। 

তার কাছের মানুষেরা জানেন যে, দেশের অন্যতম জনপ্রিয় তারকা হলেও তারকাসুলভ কোনো অহংকার বা ইগো সমস্যা নেই রাধিকার। আইএএনএসকে দেয়া এক ইন্টারভিউয়ে রাধিকা স্টারডম নিয়ে বলেছিলেন, "আমি নিজেকে এখনো তারকা মনে করি না। এই পথচলা কঠিন, কিন্তু এটা পূর্ণ করতে হবে। আমি মনে করি, আমার পথচলা কেবল শুরু হয়েছে, আরো অনেকটা পথ যেতে হবে। আর আমি এমনটাই থাকতে চাই।" 

রাধিকা এমনটাই থাকবেন, অভিনয়ের জাদুতে মুগ্ধ করবেন বারবার, এটা আমরাও চাই...

তথ্যসূত্র- উইকিপিডিয়া, মুম্বাই মিরর, ইন্ডিয়া টুডে

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা