বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে এসেছে ভালো কথা, পড়াশোনা করবে। পড়াশোনা শেষ, চলে যাবে। বেলেল্লাপনা করার তো কোনো সুযোগ নেই। তাছাড়া সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অধিকারই পেলো বা কবে থেকে যে উৎসব করবে?

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আসলে ফেলাই উচিত। বুকের উপর জগদ্দল পাথরের মতন যে ভার চেপে বসেছিলো, সে ভার নেমে গেলো হুট করেই। এতদিন ধরে চলে আসা 'অমানবিক-নিষ্ঠুর-নীতিবহির্ভূত ' এক উৎসবের ইতি ঘটিয়েছে 'প্রাচ্যের অক্সফোর্ড' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইতিহাসের আদিকাল থেকেই দেখে আসছি, যেকোনো বিষয়ে এরা অগ্রগন্য সিদ্ধান্ত রাখে। 'র‍্যাগ ডে' নামক অপসংস্কৃতির হাত থেকে তারা যে শিক্ষাঙ্গন'কে বাঁচিয়েছে, এ জন্যে আমরা কৃতার্থ।

ঠিকই তো। এটা কোনো উৎসব হলো!  একদল ছেলেমেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে যাচ্ছে, বেশ ভালো কথা। সেজন্যে আবার উৎসব করতে হবে কেন? নাচানাচি করতে হবে কেন? রঙ মাখামাখি করতে হবে কেন? সবাই নিলে একত্রে খাওয়াদাওয়া করতে হবে কেন? এটা অমানবিক না? এটা অবশ্যই অমানবিক। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে এসেছে ভালো কথা, পড়াশোনা করবে। পড়াশোনা শেষ, চলে যাবে। বেলেল্লাপনা করার তো কোনো সুযোগ নেই। তাছাড়া সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অধিকারই পেলো বা কবে থেকে যে উৎসব করবে?

এরকম নিষ্ঠুর উৎসবও তো কোথাও দেখিনি। বিদায়বেলায় ছেলেমেয়েরা কান্না কান্না চোখে সার্টিফিকেট হাতে চলে যাবে। এরপর চাকরীতে যোগ দেবে, ব্যবসা করবে, যা খুশি করবে। কিন্তু তা না করে, রঙ নিয়ে খেলে পরিবেশ নষ্ট করতে হবে, সাউন্ডবক্স বাজিয়ে শব্দ দূষণ করতে হবে, এগুলোর মানে কী? রঙ, সাউন্ডবক্স নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে চাইলে  নিজের বিয়ে তে করুক, পারিবারিক অন্য কোনো উৎসবে করুক। কিন্তু এসবের নাম করে বিশ্ববিদ্যালয়ের 'সতীত্ব' নষ্ট তো করা যাবেনা মোটেও।

জোকস এ্যাপার্ট, নোংরামোর একটা সীমা থাকে। আমি গতকাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নেয়া এ সিদ্ধান্তটির পক্ষে বিপক্ষে ভাবার চেষ্টা করেছি। অবাক হলেও সত্যি, তাদের এ সিদ্ধান্তের পক্ষে আমি কোনো কারণ পেলাম না, যা সভ্য সমাজের কাছে গৃহীত হতে পারে। অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন আর অবাকও করেনা। তাদের বিচিত্র সব সিদ্ধান্ত, প্রশ্নবিদ্ধ সব অবস্থান, অদ্ভুতুড়ে সব কর্মকাণ্ড এখন আর কোনো হেলদোলই ফেলেনা কোথাও। তবু গতকালকের নেয়া এই সিদ্ধান্তটি মানতে পারিনি আসলেই। কোনো যুক্তি নেই, কোনো ভাবনাচিন্তার বিষয় নেই, হুট করেই এতকাল ধরে আসা একটা সংস্কৃতিকে তারা কীভাবে বন্ধ করে দেয়? গায়ের জোরে?

অমানবিক, নিষ্ঠুর আর নীতিবহির্ভূত হওয়ার সংজ্ঞা কী, কেউ একটু বলবেন? বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একদল শিক্ষার্থী চার/পাঁচ বছর পর যখন চলে যাচ্ছেন, তখন শেষবেলায় সবাই হয়ে যায় পরিবারের অংশ। সবাই-ই চায়, বিদায়টা যেন একটু রঙিন হয়। পরিবারের সবাই মিলে অন্তত একটাদিনের জন্যে হলেও যাতে একটু উৎসব করা যায়। প্রিয়জনদের সাথে শেষদিন'টা যাতে একটু মনে রাখার মত হয়, সেজন্যে কিছু করা কি পাপ? এত সুন্দর একটা বিষয় কেন অমানবিক হবে? অমানবিকের সংজ্ঞা জানেন প্রশাসন? নিষ্ঠুর মানে কী? নিষ্ঠুরতার সংজ্ঞা কী? নীতিবহির্ভূত কী? কোন নীতিতে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ে 'র‍্যাগ ডে' করা যাবেনা? যদি এরকম নীতি থেকেও থাকে, এটা কেমনতরো রীতি?

মাননীয় ভিসি নাকি বলেছেন, 'র‍্যাগ ডে' উপলক্ষ্যে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে, তাই তারা বন্ধ করছেন এ উৎসব। হাসতেও ভুলে।গেলাম যেন। বন্য শূয়োরদের আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না, সে দায়ভার সাধারণ শিক্ষার্থীদের উৎসবকে বলি করে নিতে হবে? আপনি ব্যর্থ, আপনার প্রশাসন ব্যর্থ, তার দায়ভার কেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা বহন করবে? পহেলা বৈশাখে অপ্রীতিকর ঘটনা হয়, তাহলে সেটাও বন্ধ হোক। দূর্গাপূজায়, ঈদের উৎসবের মধ্যেও কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে, তাহলে সেগুলোও বন্ধ হোক। বাংলাদেশে আর কোনো উৎসবই আর না হোক। সবাই ঘরে ঢুকে দরজা আটকে বসে থাকুক। এভাবে সমস্যার সমাধান করতে চাইছেন? আসলেই?

কঠিন বাস্তবতা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় এখন আর সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের নেই। দলীয় নেতাকর্মীদের চোটপাট, প্রশাসকদের রক্তচক্ষুর মধ্যে এখানে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারে, এমন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমশ কমে কমে 'নাই' হয়ে যাচ্ছে। এরপরেও দুয়েকটা উৎসব থাকে, যেখানে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা নিজেদের মত করে বিশ্ববিদ্যালয়'কে উপলব্ধি করতে পারে। সেটাও যদি উপরমহল এর সহ্য না হয়, তাহলে আমি আসলেই সন্দিহান, এই বিশ্ববিদ্যালয় আমাদেরই তো! নাকি, রাখতে হয় বলে আমাদের রেখেছেন? যদি পারতেন, দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিতেন?

প্রশাসনের কাছে একটাই কথা বলার, এরকম ভুল করবেন না। আপনারা একটি দায়িত্বশীল অবস্থানে আছেন। অবিবেচকের মতন কথাবার্তা ও দুগ্ধপোষ্য শিশুদের মতন চিন্তাভাবনা আপনাদের থেকে কামনা করিনা। খোঁজ নিয়ে দেখবেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর একটা ছেলেকে প্রথম বর্ষে গনরুমে থেকে কী পরিমাণ নির্যাতন হজম করতে হয়। খোঁজ নিয়ে দেখবেন, দলীয় নেতাকর্মীদের ত্রাসে কতটা ভীতসন্ত্রস্ত থাকে একটা সাধারণ শিক্ষার্থী। তাদের জন্যে ভাবেন। পারলে তাদের জন্যে কিছু করেন৷ ছাত্রছাত্রীদের 'র‍্যাগিং সংস্কৃতি' বন্ধ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে 'টর্চার সেল' বন্ধ করেন। মেয়েদের জন্যে ক্যাম্পাসের পরিবেশ আরেকটু সুন্দর করে। এগুলো নিয়ে কাজ করেন। লাইব্রেরিতে বইয়ের সংখ্যা বাড়ান, ক্যাফেটেরিয়ার খাবারের মান বাড়ান, ক্লাসরুমে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহন বাড়ান। এগুলো নিয়ে কাজ করেন।

হুট করে যেকোনো কিছু বন্ধ আপনারা করতে পারেন না। সে অধিকারও আপনাদের নেই। যে অবস্থানে আছেন, সে অবস্থানটার 'ভার' একটু বুঝতে চেষ্টা করেন, প্লিজ। যে পদে আছেন, সে পদ'টাকে এমনিতেও অনেক ডুবিয়েছেন। আর ডোবাবেন না দয়া করে। মানুষের হাসাহাসির পাত্র আর নাই বা হলেন।

আপনাদের সুমতির উদয় হোক৷ আপনারা স্বাভাবিক চিন্তা করতে শিখুন। আপনাদের মস্তিষ্ক সুগঠিত হোক৷

সুস্থ চিন্তা আসুক আপনাদের মাথায়।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা