এই অসহিষ্ণুতার পৃথিবীতে একজন রইস উদ্দিন ভূঁইয়া বড় বিরল প্রজাতির মানুষ। নিজের ঘাতককে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে আনতে যিনি প্রাণান্ত লড়াই করে যান!
কেউ একজন আপনাকে বিনা কারণে থাপ্পড় দিলো, কী করবেন আপনি? উল্টো তাকে দুটো ঘুষি মেরে বসবেন, এইতো? অথবা তার সঙ্গে লড়ার শক্তি না থাকলে দুটো গালি দিয়ে সটকে পড়বেন।
তবে একজনের গল্প শোনাতে পারি আপনাদের, এক উন্মাদ আক্রমণকারীর শটগানের গুলিতে মুখমণ্ডল ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল তাঁর, এক চোখের দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিলেন চিরদিনের মতো। চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়ে পথে বসেছিলেন প্রায়। অথচ এই মানুষটাই সেই ঘাতকের মুক্তির দাবীতে রাস্তায় নেমেছিলেন। সেই উন্মাদ লোকটার মৃত্যুদণ্ডের রায় বাতিল করতে ছুটে গিয়েছেন মানবাধিকার কমিশন থেকে হাইকোর্ট- সব জায়গায়। ক্ষমা, মহানুভবতা আর ভালোবাসার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করা এই মানুষটার নাম রইস উদ্দিন ভূঁইয়া, জাতীয়তায় তিনি বাংলাদেশী।
সিলেট ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ছিলেন রইস, দারুণ মেধাবী এই মানুষটা উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পরে যোগ দিয়েছিলেন বিমানবাহিনীতে। তবে বিমানের উচ্চতায় নয়, রইসের স্বপ্নের মেঘগুলো খেলা করতো আরো অনেক উঁচুতে। সেই স্বপ্নপুরণের তাগিদে বিমানবাহিনীর চাকুরী ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছিলেন স্বপ্নের দেশ আমেরিকায়। রইসের মনে তখন দেশে রেখে আসা ভালোবাসার মানুষটাকে নিজের করে পাবার কল্পনা, সেটার জন্যে খুব দ্রুতই নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মতো কিছু করতে হবে।
নিউইয়র্কের জীবনযাত্রা বেশ ব্যয়বহুল। খরচ কমানোর জন্যেই রইস নিউইয়র্ক ছাড়লেন, পাড়ি দিলেন আমেরিকার পশ্চিম দিকের রাজ্য টেক্সাসে। সেখানে একটি ফিলিং স্টেশনে কাজ নিলেন রইস। এরমধ্যে ঘটে গেল আমেরিকার ইতিহাসের আলোড়ন সৃষ্টিকারী টুইন টাওয়ার হামলা। নিহত হলেন শত শত মানুষ, আল-কায়েদা দায় স্বীকার করলো এই হামলার। আর বিপাকে পড়লো আমেরিকায় বসবাসকারী মুসলমানেরা।
পুরো আমেরিকাজুড়েই হেট ক্রাইমের পরিমাণ বাড়লো আশঙ্কাজনক হারে, মুসলমানদের ওপর হামলা শুরু হলো পথে-ঘাটে, কর্মস্থলেও অপমানের শিকার হতে থাকলেন তাঁরা, মুসলমানদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুঁজে খুঁজে হামলা করাও হচ্ছিল তখন। সেই অস্থির সময়েই ঘটনাটা ঘটলো রইসের জীবনে।
দিনটা বাইশে সেপ্টেম্বর, ২০০১ সাল। মার্ক স্ট্রম্যান নামের এক মদ্যপ উন্মাদের আক্রমণের শিকার হলেন রইস। গ্যাস স্টেশনেই স্ট্রম্যানের শটগানের গুলিতে মুখমণ্ডল ঝাঝরা হয়ে গেল তাঁর, এতদিন ধরে মনের আকাশজুড়ে উড়তে থাকা স্বপ্নগুলো ফিকে হয়ে গেল মূহুর্তেই। রইসের আগে-পরে স্ট্রম্যানের জিঘাংসার শিকার হয়েছিলেন আরো দুজন ব্যক্তি, একজন পাকিস্তানের নাগরিক, অন্যজন ভারতের। দুজনই মারা গিয়েছিলেন।
ভাগ্যটা খুব বেশী ভালো বলেই বেঁচে রইলেন এই বঙ্গসন্তান। রইসকে নিয়ে যমে মানুষে টানাটানি শুরু হলো এবার। মুখমণ্ডল থেকে শটগানের গুলির প্যালেট সরানোর জন্যে সার্জনের ছুরির নীচে যেতে হয়েছে চারবার, তাতেও দাগগুলো সারেনি পুরোপুরি। এক চোখের দৃষ্টিশক্তি একেবারেই হারিয়েছেন, সেখানে শুধু ক্ষীণ আলোর রেখাই ধরা পড়ে। ব্যয়বহুল চিকিৎসার খরচ চালাতে গিয়ে দেউলিয়া হবার দশা হয়েছে পরিবারের। ভালোবাসার মানুষটাকে দেয়া কথাও রাখতে পারেননি রইস, এই অনাকাঙ্খিত দূর্ঘটনার শিকার হয়ে।
তবে রইসের আসল লড়াইটা শুরু হলো ২০০৯ সালের পরে। চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে মা’কে নিয়ে হজ্জ করে সেবছরই আমেরিকায় ফিরেছেন রইস। ঘাতক মার্ক স্ট্রম্যান ধরা পড়েছেন ঘটনার পরপরই, আমেরিকার আদালত তার বিচারও করেছে ২০০২ সালে। দশ বছর কারাদণ্ডের পর তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করার রায় দিয়েছেন বিচারক। সেখান থেকে রইসের উল্টোপথে হাঁটা, স্রোতের বিরুদ্ধে যাত্রা।
যে মানুষটা চরম জিঘাংসার বশবর্তী হয়ে তাঁকে মেরে ফেলতে চেয়েছিলেন, তার মৃত্যুদণ্ডের রায় বাতিলের জন্যে রইস শুরু করলেন এখানে সেখানে তদবির, আশ্রয় নিলেন আইনের। ইসলাম ধর্মে আছে, আল্লাহ তা’আলা বলেছেন- “কেউ যদি একজনের প্রাণ রক্ষা করে, তাহলে সে যেন গোটা মানবজাতিকেই রক্ষা করল...” রইস নামলেন সমগ্র মানবজাতিকে রক্ষা করার মিশনে।
জনসমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে পথেঘাটে ঘুরতে শুরু করলেন রইস, ইন্টারনেটেও জনমত সংগ্রহ করার কাজ শুরু হলো। রাতারাতি তিনি হয়ে উঠলেন আমেরিকান মিডিয়ার পরিচিতমুখ। মৃত্যুদন্ডের সময় ঘনিয়ে আসছিল দ্রুত, ইতিমধ্যে নয় বছর জেল খেটে ফেলেছেন স্ট্রম্যান। তার আইনজীবিদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন রইস, কিন্ত আশার আলো ফুরিয়ে আসছিল চারদিক থেকেই।
দুইবার মৃত্যুদণ্ড বাতিলের জন্যে রিট আবেদন করেন রইস, কিন্ত দুবারই তাঁর আবেদন খারিজ করে দেয় মার্কিন আদালত। এরপর স্টেট গভর্নর অফিসের বিরুদ্ধে ভিক্টিম রাইটস আইনে মামলা করেন রইস। কিন্ত তাতেও সফলতা এলো না। স্ট্রম্যানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবার আগে তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছিলেন রইস। স্ট্রম্যান তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন, রইসের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আর মহানুভতা মুগ্ধ করেছিল স্ট্রম্যানকে। রইসকে তিনি বলেছিলেন-
“আমার জন্য আপনি যা কিছু করেছেন, সে জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমার অন্তর থেকে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।”
২০১১ সালের ২০শে জুলাই বিষাক্ত ইঞ্জেকশন প্রয়োগ করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় মার্ক স্ট্রম্যানের। সে যাত্রায় ব্যর্থ হয়েছিলেন রইস। নিজের ঘাতক স্ট্রম্যানের জীবন বাঁচাতে পারেননি তিনি। কিন্ত এই ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে, কারো জীবনে যেন রইসের মতো বিভীষিকা নেমে না আসে, কারো পরিণতি যেন মার্ক স্ট্রম্যানের মতো না হয় সেই উদ্দেশ্যে রইস উদ্দিন ভূঁইয়া গড়ে তুললেন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, নাম ‘World without hate’…
হেট ক্রাইমের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করলেন রইস, যে লড়াই চলছে এখনও। স্ট্রম্যানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবার দুই মাস পর এক সাক্ষাৎকারে রইস বলেছিলেন-
“এখনো পথেঘাটে অনেক মার্ক স্ট্রম্যান আছে। এই দেশে এবং পৃথিবীতে অনেক ঘৃণা আছে। তুমি যদি আমার গায়ের রঙ, আমার ধর্ম, আমার কথা বলার ভঙ্গি পছন্দ না করো, তবে আমার করার কিছুই নেই, কারণ আমি এগুলো নিয়েই জন্মেছি, আমি এগুলো বদলাতে পারব না।”
রইস নেমেছেন মানুষের মানসিকতা বদলের মিশনে। ঘৃণার পরিবর্তে তিনি পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে দিতে চান ভালোবাসা। স্ট্রম্যানের পরিবারের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ হয় তাঁর, স্ট্রম্যানের মেয়ে আর নাতিকে আর্থিকভাবে সহায়তাও করেছিলেন তিনি। হলিউডে তার এই গল্প নিয়ে সিনেমা বানানো হবে বলেও জানা গেছে।
এই অসহিষ্ণুতার পৃথিবীতে একজন রইস উদ্দিন ভূঁইয়া বড় বিরল প্রজাতির মানুষ। নিজের ঘাতককে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচিয়ে আনতে যিনি প্রানান্ত লড়াই করে যান! আটশো কোটির পৃথিবীতে আটশো জন রইস উদ্দিন থাকলেও পৃথিবীটা অনেক সুন্দর হয়ে যেত। একজন বাংলাদেশী হিসেবে রইস উদ্দিনকে নিয়ে অবশ্যই আমরা গর্বিত।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন