লকডাউনের মধ্যে কেন রাতের তিনটায় বারবিকিউ করতে ইচ্ছে করবে? কেন রাত একটায় ব্রণের ক্রিম বা ফেয়ার এন্ড লাভলি কেনার জন্য বাসা থেকে বেরিয়ে আসবে কেউ? কমনসেন্স বলে কোন বস্তু কি এদের মধ্যে ইন্সটল করে দেয়নি কেউ?

ঢাকার পূর্ব রাজাবাজারে লকডাউন কার্যকর করতে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করছেন প্রায় দেড়শো জন। তাদের মধ্যে একজন বলছিলেন, 'আমি শুনেছি করোনার বিরুদ্ধে এটা নাকি যুদ্ধক্ষেত্র। কিন্ত জীবনে কোনদিন শুনিনি, যুদ্ধাবস্থায় কারো রাত বারোটার পর পটেটো চিপস খেতে মন চেয়েছে! কিংবা রাত তিনটায় বারবিকিউ করার জন্যে যুদ্ধের মধ্যে কেউ মুরগী কিনতে বেরোয় বলে শুনিনি কখনও।'

রেডজোন ঘোষিত হওয়া প্রথম এলাকা হিসেবে ঢাকার পূর্ব রাজাবাজারকে আনা হয়েছে প্রোপার লকডাউনের আওতায়। প্রবেশ ও বের হবার আটটি পথের মধ্যে সাতটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, একমাত্র রাস্তাটি দিয়েও যাতায়াত করা যাচ্ছে সীমিত আকারে। তিন শিফটে দেড়শো জন স্বেচ্ছাসেবী কাজ করছেন পুরো এলাকায়। কেউ যাতে বাসা থেকে বের না হন, সেই ব্যবস্থা করাই তাদের কাজ। এলাকার প্রত্যেকের কাছে কয়েকটা ফোন নাম্বার দিয়ে দেয়া হয়েছে, কারো কিছু দরকার হলে এই নাম্বারে কল দিলেই স্বেচ্ছাসেবীরা সেটা ঘরের দরজায় পৌঁছে দিচ্ছেন। সবটাই করা হচ্ছে করোনা সংক্রমণ রোধ করার জন্য।

মিঃ হাইজিন: জীবাণুমুক্ত হাতের প্রতিশ্রুতি

কিন্ত আমাদের শিরায় উপশিরায় তো শয়তানীর বীজ বোনা। মানুষের ভালোর জন্য যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তাতে বাম হাত না ঢোকালে তো পেটের ভাত হজম হবে না অনেকের। তাই রাতের তিনটায় স্বেচ্ছাসেবীদের ফোন করে কেউ বলছেন, তার ব্রণের ক্রিম দরকার, খুব জরুরী, এক্ষুণি না পেলে প্রাণ সংশয় হয়ে যাবে! সেই ক্রিমের দাম কত সেটাও তিনি জানেন না, অথচ সেটা নাকি তিনি নিয়মিত ব্যবহার করেন! 

রাত বারোটার পরে একজন ফোন করেছেন, তার ব্রয়লার মুরগী লাগবে। কারন বাসায় নাকি তিনি বারবিকিউ পার্টি করবেন! করোনার এই ক্রান্তিকালে পেট ভরে ভাত খাওয়াটা যেখানে অনেকের জন্য স্বপ্নের মতো ব্যপার, সেখানে রেডজোনে বসে এই অমানুষেরা বারবিকিউ খেতে চায়- গোটা ব্যাপারটা শুনলে মনে হয় করোনা বলে কোন বস্তু কোথাও নেই, দুনিয়ার প্রতিটা কোণে বুঝি শুধু আনন্দ ঝরে ঝরে পড়ছে! 

আবদারের তো শেষ নেই। রাতের তিনটায় কারো কোকের দরকার হচ্ছে, কারো চিপস খেতে মন চাইছে, কেউবা বলছে সমুচা-নাগেট অথবা পিৎজা এনে দিতে! কেউ আবার সন্ধ্যেবেলায় লিচু খাওয়ার আবদার করছে! ঘরে টিভি আছে, ক্যাবল কানেকশন আছে, ফোনে ইন্টারনেট আছে, তবুও কারো প্রাণ কাঁদছে খবরের কাগজ পড়ার জন্য! মাঝরাতে কেউ ফোন করছে কনডমের জন্য- এমন সব অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবকরা, যেগুলোর কথা তারা মিডিয়ার সামনে বলতেও পারছেন না লজ্জায়। 

তবুও তারা মুখ বুঁজে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন, আপত্তি জানাচ্ছেন না। কারো আম-লিচু খেতে ইচ্ছে হলে তারা ফার্মগেট থেকে এনে দিচ্ছেন সেটা, পত্রিকার দরকার পড়লে আইবিএ হোস্টেলের সামনে থেকে কিনে বাসা পর্যন্ত পৌঁছে দিচ্ছেন। শুধু তাই নয়, বাজার করে দিচ্ছেন, মুরগী জবাই করে সেটার চামড়া ছিলে কেটে পর্যন্ত দিচ্ছেন, কারণ অনেকের বাসায় কাজের লোক নেই। 

অদ্ভুত সব আবদার শুনতে হচ্ছে স্বেচ্ছাসেবীদের!

এই স্বেচ্ছাসেবীদের অনেকেই পরিবারের আদরের সন্তান, নিজের বাসায় পানির গ্লাসটাও ধোয়ায় অভ্যাস নেই কারো কারো। অথচ মানুষকে সাহায্য করার জন্যে এসে জীবনে করেননি, এমন সব কাজ করতে হচ্ছে তাদের! আর প্রতিদানে শুনতে হচ্ছে অদ্ভুত সব আবদার। তবুও তারা হতাশ হচ্ছেন না, এসব পূরণ করেও যদি মানুষকে ঘরে রাখা যায়, সেটাই তারা করার চেষ্টা করছেন। 

গোটা উদ্যোগটা যে মানুষের ভালোর জন্যে নেয়া হয়েছে, সেটা রাজাবাজারের লোকজন বুঝতে পারছে না। পারলে তো আর এমন ইতর-অসভ্যের মতো আচরণ করতো না কেউ। সরকার লকডাউন করেছে এলাকায়, স্বেচ্ছাসেবীরা জানপ্রাণ এক করে খেটে মরছেন, মানুষের কাজ শুধু ঘরে বন্দী হয়ে থাকা- সেটা করতেই তাদের প্রবল আপত্তি। খেটে খাওয়া মানুষের কথা বাদ দিলাম, লকডাউনের মধ্যে কেন রাতের তিনটায় বারবিকিউ করতে ইচ্ছে করবে? কেন রাত একটায় ব্রণের ক্রিম বা ফেয়ার এন্ড লাভলি কেনার জন্য বাসা থেকে বেরিয়ে আসবে কেউ? মানুষ এতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন হয় কি করে? কমনসেন্স বলে কোন বস্তু কি এদের মধ্যে ইন্সটল করে দেয়নি কেউ?

অথচ এই লোকগুলোই আবার ফেসবুকে এসে বিপ্লবে যোগ দেবে, আইসিইউ নেই কেন, রোগীরা চিকিৎসা পাচ্ছে না কেন, এসব নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। সেন্সিবল লোকজন এই প্রশ্নগুলো করলে মানা যায়। কিন্ত আইন অমান্য করা, রাতের তিনটায় রেডজোনে বসে বারবিকিউ খেতে চাওয়া লোকের কি এসব প্রশ্ন তোলার অধিকার আছে আদৌ? করোনা মোকাবেলা করাটা সরকারের একার দায়িত্ব না, এখানে জনগনেরও একটা বিশাল রোল প্লে করতে হবে। এভাবে রাত তিনটায় বারবিকিউ আর ব্রণের ক্রিম চেয়ে যদি কেউ 'নাগরিক দায়িত্ব' পালন করতে চায়, তাহলে করোনা এই দেশ ছেড়ে যাওয়ার কথা কোনদিন ভাববে বলে মনে হয় না আর...


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা