রাজাকারের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধার নাম: বিজয় দিবসে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে রাষ্ট্রের উপহার!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী ভুলের দায়ভার নিতেই চাইলেন না, তিনি উল্টো দোষ চাপালেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর। তারাই নাকী এই তালিকা বানিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় শুধু সেটা প্রকাশ করেছে!
একজন মানুষের গল্প বলি। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ায় তাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করেছিল পাকিস্তানী সেনারা। মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় তার নামটা জ্বলজ্বল করছে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। গত আটচল্লিশ বছর ধরে তার স্ত্রী মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেয়ে আসছেন। তার ছেলেও অস্ত্র হাতে যুদ্ধে গিয়েছিল, তার নামও আছে মুক্তিযোদ্ধাদের গেজেটেড লিস্টে।
অথচ সেই শহীদ মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট সুধীর কুমার চক্রবর্ত্তীর স্ত্রী উষা রানী চক্রবর্ত্তী এবং সন্তান অ্যাডভোকেট তপন কুমার চক্রবর্তী, যিনি কীনা নিজেও গেজেটেড মুক্তিযোদ্ধা- তাদের দুজনকেই ঠাঁই দেয়া হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বানানো রাজাকারদের তালিকায়! বিজয়ের আটচল্লিশ বছর পূর্তিতে একজন মুক্তিযোদ্ধাকে এরচেয়ে বড় আর কী উপহারটাই বা দিতে পারতো রাষ্ট্র!
অনেক ঘটা করে রাজাকারদের নাম প্রকাশ করা হলো বিজয় দিবসের আগের দিন। এই দেশটার জন্মলগ্নে যারা বাধা দিয়েছিল, হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল, তাদের নামধাম-পরিচয় প্রকাশিত হবে, এটা স্বাধীনতার সপক্ষের মানুষের দীর্ঘদিনের চাওয়া ছিল। কিন্ত সেই তালিকা যে এমন বিতর্কের সৃষ্টি করবে, এতটা অপেশাদারী আচরণ করবে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়- সেটা ভাবা যায়নি।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর, যিনি কীনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিতে কাজ করেছেন, সেই মুক্তিযোদ্ধা গোলাম আরিফ টিপুর নাম এসেছে এই রাজাকারের তালিকাতে। কাদের মোল্লা বা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মতো সাজাপ্রাপ্ত রাজাকারের নাম নেই তালিকায়, অথচ আছে গন্যমান্য সব মুক্তিযোদ্ধাদের নাম! এই তালিকাকে চলন্ত কৌতুক বললে কি ভুল হবে খুব? মনে হচ্ছে না।
বরিশালের সিটি কর্পোরেশনের মেয়র পদে বাসদের প্রার্থী ছিলেন ডা. মনীষা চক্রবর্তী। শুরুতে যে শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কথা বলা হলো, সেই সুধীর কুমার চক্রবর্তী ছিলেন তার দাদা, আর তপন কুমার চক্রবর্তী মনীষার বাবা। ঠাকুমা আর বাবার নাম উঠেছে রাজাকারের তালিকায়, সেটাকে তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসা হিসেবেই দেখেছেন। মনীষার অভিযোগটা অতিরঞ্জিত মনে হতে পারে হয়তো, কিন্ত যারা তালিকা প্রণয়ন করেছে, তাদের এই ক্ষমার অযোগ্য অপরাধের কী কোন ব্যাখ্যা তাতে বেরিয়ে আসবে?
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী ভুলের দায়ভার নিতেই চাইলেন না, তিনি উল্টো দোষ চাপালেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর। তারাই নাকী এই তালিকা বানিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় শুধু সেটা প্রকাশ করেছে! তাকে জিজ্ঞেস করা হলো, মুক্তিযোদ্ধার নাম রাজাকারের তালিকায় আসায় সেই মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানহানী হলো কীনা- তিনি জবাব দিলেন, সম্মানহানী কেন হবে, তাদের তো সম্মান বৃদ্ধি পেয়েছে বরং! বাহ! এই না হলে বাংলাদেশের মন্ত্রী!
খুব স্বাভাবিক একটা প্রশ্ন- যে মানুষটার নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় আছে, তার নামই আবার রাজাকারের তালিকায় আসে কী করে? একটা জবাব হতে পারে, বাহাত্তরে দালাল আইনে যাদের নামে মামলা হয়েছিল, সেই তালিকাটাকেই রাজাকারের তালিকা হিসেবে উপস্থাপন করছে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়। কিন্ত সেই মামলার মধ্যে যে অজস্র ভুয়া মামলাও ছিল, সেটা তো কারো অজানা নয়। ব্যক্তিগত শত্রুতার কারণেও অনেকে মামলা করেছে। যারা এই কাজগুলো করেছে,তালিকা প্রণয়নের দায়িত্বভার যাদের ওপর ছিল, তারা কি ঘোড়ার ঘাস কেটেছেন? এটাকে ভুল বললেও ভুলের সংজ্ঞা পাল্টে ফেলতে হবে।
মুক্তিযোদ্ধার তালিকা নিয়ে একটা সময় এই দেশে প্রচুর ব্যবসা হয়েছে, ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সনদ দেয়া হয়েছে টাকার বিনিময়ে। সচিব পর্যায়ের লোকজনও মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সার্টিফিকেট বাগিয়ে বসে আছেন- এমন প্রমাণ এসেছে কিছুদিন আগেও। এবার তাহলে রাজাকারের তালিকা নিয়ে ব্যবসা হোক তালিকা থেকে নাম কাটানোর জন্যে টাকাপয়সা উড়বে চারদিকে। স্বাধীনতার সপক্ষের সরকার ক্ষমতায়, এই ২০১৯ সালে এসে এটাই বোধহয় দেখার বাকী ছিল!
এমন জঘন্য একটা কাজের পরে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীর আর দায়িত্বে থাকার অধিকার আছে কীনা- এই প্রশ্নের উত্তর তার ওপরেই ছেড়ে দিলাম। শাহবাগ মুভমেন্টের পর থেকে মজা করে যাকে তাকে বলতাম তুই রাজাকার, কেউ পাকিস্তান সমর্থন করলেও রাজাকার বলতাম, কেউ মতের বিরুদ্ধে গেলেও রাজাকার বলতাম। সেটা ছিল নিছকই বিনোদন।
কিন্ত আমাদের ঠাট্টার ব্যাপারটাকে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলিই নিয়ে নিয়েছে দেখা যাচ্ছে। তারা ভুলেই গেছেন যে, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, রাজাকার- এগুলো কোন ফাজলামীর বিষয়বস্তু না। রাজাকারের তালিকায় জায়গা পাবার জন্যে একজন মুক্তিযোদ্ধা অস্ত্র হাতে দেশ স্বাধীন করতে যাননি। তালিকা করার মুরোদ না থাকলে না করেন, কিন্ত বিজয় দিবসের প্রাক্কালে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করার অধিকার আপনাদের কে দিয়েছে?