রাজশাহীর কিছু আমবাগানে বেশ কয়েক বছর ধরেই বাসা বেঁধে বাস করছিল কয়েক হাজার শামুকখোল পাখি। আমবাগানের এক মালিক সেই পাখিগুলোর ঘরবাড়িশুদ্ধ ভেঙ্গে দেওয়ার তোড়জোড় করতেই বাধা দেয় এলাকার মানুষজন। শেষপর্যন্ত আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল বিষয়টা, সেই পাখিগুলো কেমন আছে এখন?

প্রখ্যাত শিল্পী ভূপেন হাজারিকার সেই গান বোধকরি আমাদের সবারই মনে আছে-

মানুষ মানুষের জন্যে
জীবন জীবনের জন্যে...

দ্বিতীয় লাইনকে যদি আমরা আরেকটু উদারভাবে বিশ্লেষণ করি, তাহলে স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করবো, সৃষ্টির সেরা জীব হওয়ার কারণে আমাদের কিছু দায়দায়িত্ব রয়েই যায় অন্যান্য অবলা পশুপাখির রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে। স্রষ্টার পক্ষপাতদুষ্ট প্রাণীকূলের জন্যে এটি অবশ্যকর্তব্য একটি বিষয়ই। প্রথম আলোর বরাতে সম্প্রতি এরকম এক মানবিক বিষয় লক্ষ্যও করি আমরা রাজশাহীতে। গল্প তা নিয়েই।

রাজশাহীর বাঘা উপজেলার খোর্দ্দ বাউসা গ্রামের কয়েকটি বাড়ির আমবাগানে বেশ ক'বছর ধরে বাসা বেঁধে থাকছে কিছু পাখি। শামুকখোল নামের এই পাখিরা বর্ষার শেষে এসে আমগাছের ডালে বাসা বানাচ্ছে বেশ কয়েক বছর ধরেই। এবারের বর্ষার শেষেও এসেছিলো তারা। বাচ্চাও ফুটিয়েছিলো। বাচ্চাগুলো বড় হয়নি এখনো। কিন্তু এসময়েই শুরু হয়েছে বিপত্তি।  আমবাগানের এক মালিক, ইজারাদারদের মাধ্যমে পাখির বাসা ভেঙ্গে দেওয়া শুরু করেছিলেন কিছুদিন আগে। অবশ্য আমবাগানের মালিকের এই সিদ্ধান্তের পেছনে কারণও আছে। 

হাজার হাজার পাখির বর্জ্য, ময়লা-আবর্জনাসহ নানা কারণে আমবাগানের বেশ কিছু আমগাছের প্রচুর ক্ষতি হচ্ছে।সে কারণেই, নিজের আমবাগানকে বাঁচানোর জন্যে সেই বাগান-মালিক নিয়েছিলেন এই সিদ্ধান্ত। সেদিক থেকে হিসেব করলে তার এই কাজকে ঠিক অমানবিকও বলা যায় না। পেশাদার মানুষ হিসেবে পেশার সাথে আপোষ তো চলে না। তাই ছোট ছোট পাখির বাচ্চাসহ বাসাগুলোকে ভাঙ্গা হচ্ছিলো। কিন্তু স্থানীয় পাখিপ্রেমী মানুষজন এই বিষয়টিতে বাধা দেন। অনুরোধ করেন, যাতে পাখির বাসাগুলোকে এভাবে ভেঙ্গে ফেলা না হয়।

পাখিপ্রেমীদের অনুরোধের ভিত্তিতে আমবাগানের সেই মালিক আর কোনো পাখির বাসা ভাঙ্গেন নি। তবে ১৫ দিনের একটা আল্টিমেটাম দিয়ে দেন তিনি। আল্টিমেটামে বলা হয়- পনেরো দিনের মধ্যে যদি পাখিরা বাসা না ছাড়ে, তাহলে তাদের সমূলে উচ্ছেদ করা হবে গাছ থেকে। মানুষ যখন বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়, তখন তাকে বলা হয় উদ্বাস্তু। পাখির ক্ষেত্রেও এরকম কোনো শব্দ আছে কী না, জানা নেই আমার। থাকলে ব্যবহার করা যেতো এস্থানে।

এই বিষয়টি আদালতের নজরেও আসে। সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবী এ বিষয়ে আদালতকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়ার আবেদনও জানান। পরিপ্রেক্ষিতে আদালত একটা সুয়োমোটো রুল জারি করে, যেখানে জানতে চাওয়া হয়- কেন ঐ এলাকাকে পাখির  অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হবে না। আদালত থেকে সে সাথে এটাও বলা হয়, যদি এলাকাটিকে পাখিদের অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হয় তাহলে সেই এলাকার বাগান মালিকদের মোট ক্ষতির পরিমাণ আদালতকে জানানোর জন্যে।

একটি কমিটি গঠন করা হয়। সে কমিটি আমবাগানগুলোতে গিয়ে সরেজমিনে তদন্ত করে। পাখির বাসার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কিছু গাছ সনাক্ত করে এবং মোট ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে আদালতকে জানায়। আদালত, প্রাপ্ত রিপোর্ট এর ভিত্তিতে আমবাগানের মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যবস্থা করেন। সাথে আমবাগানে পাখিগুলোর বাসা যাতে আর না ভাঙ্গা হয়, সেটারও আদেশ দেন। পাখিগুলোর অবাধ বসবাসের কারণে মানুষের যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, সেদিকেও লক্ষ্য রাখারও নির্দেশ দেওয়া হয়। পাখিদের শারীরিক সুস্থতা-অসুস্থতার বিষয়ে নজর রাখার জন্যে স্থানীয় মানুষজন মিলে একটা কমিটিও গঠন করেন সেখানে। 

এখন থেকে আমগাছে নিরাপদেই থাকবে এই পাখিরা! 

পাখির নিরাপত্তার জন্যে আদালতের এরকম সরব সিদ্ধান্তের নজির বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বেশ অভিনব ও সৃজনশীল। আমাদের যাপিত জীবনের প্রেক্ষাপটে আমরা আমাদের ছাড়া অন্যদের কথা ভুলেই গিয়েছি। সেখানে আদালতের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে দেওয়া এই রায় আসলেই নতুন কিছুর ইঙ্গিত দেয়। এবং যে ইঙ্গিত অবশ্যই ইতিবাচক। তবে নিন্দুকেরা এটাও বলতে পারেন, মানুষের নিরাপত্তার গ্যারান্টি নেই, পাখির নিরাপত্তায় কমিটি গঠন... এটা প্রহসন ছাড়া আর কী!

অবশ্য ভিন্নমত থাকবেই। সে নিয়ে ভাবলে চলেনা। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যে রকম একটি দৃষ্টান্ত আমরা দেখলাম এই ঘটনার মাধ্যমে, এরকম দৃষ্টান্ত আরো আসুক ক্রমশ। নির্জীব, জড়ভরত, মান্ধাতার আমলের ধ্যানধারণা থেকে বেরিয়ে আসুক সবকিছু।

সামাজিক নানা সংস্কারের পাশাপাশি জীব-বৈচিত্র‍্যের জন্যেই মঙ্গল বয়ে আনবে তা৷

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা