রাজশাহীতে গীর্জার ফাদারের বিরুদ্ধে উঠেছে কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগ, উপযুক্ত ব্যবস্থা না নিয়ে বরং অভিযুক্তকে পালানোর সুযোগ করে দেয়া হয়েছে, আর জিম্মি করা হয়েছে খোদ নির্যাতিতাকেই!

বলা হয়, ধর্মীয় উপাসনালয় নাকি মানুষের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। সেখানে স্রষ্টার বাস, আল্লাহ-ঈশ্বর-গড-ভগবান, যে নামেই ডাকি না কেন আমরা, তিনি থাকেন সেই উপাসনালয়ে- এমনটাই শেখানো হয় আমাদের। কিন্ত সেই শিক্ষার সঙ্গে বাস্তবের ফারাকটা অনেক। নইলে কি আর মসজিদের ভেতর আরবি শেখানোর নাম করে শিশু নিগ্রহের ঘটনা ঘটে? মন্দিরের ভেতর পুরোহিতের হাতে নির্যাতনের শিকার হয় কন্যাশিশু? অথবা গীর্জায় আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয় কিশোরীকে? 

শেষের ঘটনাটি একেবারেই তরতাজা। রাজশাহীর তানোর উপজেলার মুণ্ডুমালা মাহালীপাড়া এলাকার সাধুজন মেরী ভিয়ান্নী গির্জায় ঘটেছে এই ঘটনা। ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে গির্জাটির ফাদার প্রদীপ গ্যা গরীর বিরুদ্ধে। পনেরো বছর বয়সের এক কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে সেই ফাদারকে গীর্জা থেকে প্রত্যাহার করা হলেও, পরে আবার সেই কিশোরীর পরিবারকেই জিডি প্রত্যাহার করার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে। নির্যাতিতা কিশোরীকেও আটকে রাখা হয়েছিল অনেকটা সময়, হস্তান্তর করা হয়নি পরিবারের কাছে। পরে পুলিশ গিয়ে তাকে উদ্ধার করেছে। 

গত শনিবার সকাল ১০টায় গির্জার পাশে ঘাস কাটতে গিয়ে নিখোঁজ হয় ওই কিশোরী। অনেক খোঁজাখুঁজির পর তাকে না পেয়ে পরদিন থানায় জিডি করেন কিশোরীর ভাই। এরপর সোমবার দুপুরে জানা যায়, নিখোঁজ কিশোরী তিনদিন ধরে গির্জার ফাদার প্রদীপের রুমে বন্দি অবস্থায় আছে। এই ঘটনায় গ্রামের মোড়ল ও মুণ্ডুমালা সরকারি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক কার্মেল মার্ডির নেতৃত্বে সন্ধ্যায় গির্জার ভেতরে সালিশ বসে। সেখানে দোষ প্রমাণ হওয়ায় ফাদার প্রদীপকে অপসারণ করে রাজশাহীতে নিয়ে আসা হয়। ভুক্তভোগী কিশোরীকে রাখা হয় গির্জার ভেতরে সিস্টারদের কাছে।

গির্জা কর্তৃপক্ষ তখন কিশোরীর পরিবারকে জিডি প্রত্যাহার করে তাকে ফেরত নিতে বলে এবং সাবালিকা হওয়া পর্যন্ত কিশোরীর সব খরচ বহনের প্রতিশ্রুতি দেয়। পরে কিশোরীর ভাই জিডি তুলে নিলেও ওই কিশোরীকে গির্জা থেকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি। উল্টো সমাজচ্যুত করার হুমকি দিয়ে গির্জার প্রধান ফাদার প্যাট্রিক গোমেজ ও সালিশ বৈঠকের প্রধান কামেল মার্ডি ওই কিশোরীকে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত গির্জায় আটকে রাখেন। পরে পুলিশ গিয়ে মেয়েটিকে উদ্ধার করে থানায় নিয়ে আসে।

ধর্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে নির্যাতিতাকেই জিম্মি করা হয়েছে

যে অমানুষটা পনেরো বছর বয়স্ক কিশোরীকে ধর্ষণ করেছে, তার নিজের গায়ে ধর্ম প্রচারকের চাদর জড়ানো। গির্জার প্রধান ফাদার প্যাট্রিক গোমেজও ধর্ম প্রচার করে। আর সালিশের মোড়ল কামেল মার্ডি নিজে একজন স্কুল শিক্ষক। এক ধর্ম প্রচারক ধর্ষণের মতো ন্যাক্কারজনক একটা কাণ্ড ঘটিয়েছে, তার সাগরেদ এবং আরেক শিক্ষক মিলে সেটাকে ধামাচাপা দেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে। নির্যাতিতা মেয়েটার পাশে না দাঁড়িয়ে, তার পরিবারকে সাহায্য না করে বরং ধর্ষককে বাঁচানোর জন্য ভিক্টিমকেই জিম্মি করেছে, আসামী প্রদীপকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ দিয়েছে। 

এটা আসলে পুরো দেশের চালচিত্র। সিলেটের ধর্ষণকাণ্ডেও সঙ্গে সঙ্গে একদল হাজির হয়েছিল 'মিটমাট' বা 'মধ্যস্ততা' করে দেয়ার জন্য। এরা সব জায়গাতেই মজুদ থাকে। রাজশাহীতেও ছিল। ধর্ষক প্রদীপকে তো গ্রেপ্তার করতেই হবে, পাশাপাশি এই ফাদার প্যাট্রিক এবং কামেল মার্ডি নামের এই শিক্ষক সমাজের কলঙ্কটার কোমরেও দড়ি পরাতে হবে। এরা দুজনেই পটেনশিয়াল রেপিস্ট, ধর্ষককে যে বাঁচাতে চায়, পালানোর সুযোগ করে দেয়, ধর্ষিতাকে যারা আরেক দফায় শারীরিক বা মানসিকভাবে নির্যাতন করে- তাদের অপরাধও ধর্ষকের চেয়ে কম কিছু নয়। 

ফেসবুকে এক তরুণী তার বান্ধবীদের প্রশ্ন করেছিলেন, একটা দিনের জন্য যদি পৃথিবী থেকে পুরুষেরা গায়েব হয়ে যায়, তাহলে তুই কি করবি? অনেকেই অনেক রকমের উত্তর দিয়েছে সেখানে, তবে সবচেয়ে কমন উত্তর যেটা, সেটা হচ্ছে নিজের খুশিমতো ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা উপভোগ করবে মেয়েরা, রাত-বিরাতে ধর্ষণ বা ইভটিজিংয়ের ভয় এড়িয়ে রাস্তায় চলবে। সেসব উত্তর দেখে আবার পুরুষ সমাজের প্রতিনিধিদের কারো কারো খুব গায়ে লেগেছে। নারীর জন্য একটা নিরাপদ রাষ্ট্র গড়তে না পারা পুরুষ যখন প্রশ্ন করে যে, এরা পুরুষবিহীন পৃথিবী কেন চায়- তখন জবাবটা সেই প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে। 

একটা দেশে নারীরা মসজিদ-মক্তব বা মন্দির-গীর্জা কোথাও নিরাপদ নয়, এমনকি মাদ্রাসার শিক্ষক-মুয়াজ্জিন অথবা পুরোহিত-ফাদাররাও যখন ধর্ষণের মহোৎসবে নাম লেখায়- তখন সেই রাষ্ট্রের পুরুষদের প্রতিনিধি হিসেবে লজ্জায় মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার থাকে না...

তথ্যসূত্র কৃতজ্ঞতা- দৈনিক সমকাল

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা