সার্জিও র্যামোস: একজন গ্ল্যাডিয়েটর, কিংবা স্যাভিয়রের গল্প!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট

সার্জিও রামোস স্পেন ও রিয়াল মাদ্রিদ তথা বিশ্ব ফুটবলের সুবিশাল, গৌরবমাখা অধ্যায়ের নাম। যে অধ্যায় জন্ম দিয়েছে নানান ঐতিহাসিক মুহুর্ত, যে অধ্যায় অপার ভালোবাসা ও সাফল্যের প্রাচুর্যতায় ভরপুর।
সার্জিও রামোস। ফুটবল যারা ভালোবাসে তাদের এই লোককে না চেনার তেমন কোনো উপায় নেয়, হোক সেটা ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক অর্থে।
বিশ্বমানের রাইট ব্যাক থেকে পুরোদস্তুর বিশ্বসেরা সেন্টার ব্যাক, অসংখ্য লাল কার্ড থেকে সেই লিসবনের রাতের শেষ মিনিটের মহানায়ক হয়ে চ্যাম্পিয়নস লীগে সফলতম রিয়াল মাদ্রিদের এক যুগের অভিশাপ ঘুচানো, তারুণ্য থেকে নেতৃত্ব! আগ্রাসী ও হার না মানা মনোভাব থেকে শেষ মুহুর্তে বাজপাখির মতো ছো মেরে ছিনিয়ে আনা জয় বা সমতাগুলোর ত্রাণকর্তা। যেন হাজার রূপান্তরে ফুটবলের চিরসবুজ ঘাসে এভাবেই কেটে গেল পাগলাটে, ক্ষ্যাপাটে এক লোকের 'চৌত্রিশ বছর'। যে ঘাসের সাথে মিশে আছে ঘাম ও রক্ত মাখা তার অবিরাম পথচলা। সার্জিও রামোস স্পেন ও রিয়াল মাদ্রিদ তথা বিশ্ব ফুটবলের সুবিশাল, গৌরবমাখা অধ্যায়ের নাম। যে অধ্যায় জন্ম দিয়েছে নানান ঐতিহাসিক মুহুর্ত, যে অধ্যায় অপার ভালোবাসা ও সাফল্যের প্রাচুর্যতায় ভরপুর। যে অধ্যায়ে খানিকটা নেতিবাচকতার অংশটুকুও জুড়ে দেয়া হতে পারে সমালোচকদের আবদারে।
সহজ বাংলায়, সার্জিও রামোস হলেন এমন এক ফুটবল চরিত্র, যিনি ভিন্ন কিংবা বিপরীত দলের সমর্থকদের কাছে বাংলা সিনেমার ভিলেনের চেয়েও খারাপ। অপরদিকে নিজ দলের সমর্থকদের কাছে হলেন অনেকটা ভারতের দক্ষিণের সিনেমার নায়কের মতো, একাই যেন কয়েক মুহুর্তে সবকিছু বদলে দিতে পারবেন! তিনি এমন একজন যিনি রক্ষণভাগের খেলোয়াড় হয়েও দুমড়েমুচড়ে দিতে পারেন বিপক্ষ শিবিরকে। রক্ষণকে যেমন দুর্গে পরিণত করতে পারেন ঠিক তেমন ফ্রন্টে গিয়ে গোল করে বারবার দলকে রক্ষা করতে পারেন অসাধারণভাবে। এমন উদাহরণ তিনি তৈরি করে চলেছেন বারংবার। আবার প্রয়োজনে মাঠে নিজ দলের খেলোয়াড়দের প্রতিনিয়ত অনুপ্রাণিত করে যাওয়া যেমন তার অভ্যাস, ঠিক তেমন আগ্রাসন তার প্রতি রন্ধ্রে রন্ধ্রে! তাই স্পেন ও রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকদের কাছে সার্জিও রামোস একজন খেলোয়াড়ের চেয়ে বেশি হয়ে উঠেছেন দলনেতা হিসেবে।
ফিফপ্রো একাদশে অসংখ্যবার নাম উঠানো কিংবা লালীগার সেরা ডিফেন্ডারে একচ্ছত্র আধিপত্য কিংবা শ্রেষ্ঠ রক্ষণভাগের খেলোয়াড়ের কিংবা রেকর্ড সংখ্যক লাল কার্ড। প্রশংসা, তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা ও সমালোচনার দাবীদার হওয়ার সব যোগ্যতায় যেন তিনি বহন করে চলেছেন। ছিলেন স্পেনের বিশ্বকাপ, ইউরো জয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লীগ, লালীগা, কোপা ডেল রে শিরোপা সবকিছুই আছে ঝুলিতে। একজন খেলোয়াড় হিসেবে তার ব্যক্তি ও দলীয় সফলতা যেকারো জন্য ঈর্ষণীয় হওয়ার দাবী রাখে।

ক্লাব ফুটবলটা যেহেতু বারো মাসই চলে, সুতরাং সার্জিও রামোস এর নামটা নিলে বোধহয় রিয়াল মাদ্রিদের নামটাই সবার প্রথমে আসবে। তাছাড়া প্রতিটা ফুটবল সমর্থক জানে ও অনুভব করে রিয়ালের প্রতি রামোসের উজাড় করে দেওয়া একাগ্রতা, আবেগ ও ভালোবাসার অভিব্যক্তিকে। অপরদিকে এটাও খুব দৃঢ়ভাবে বলা যায়, রিয়াল সমর্থকদের কাছে রামোস দলনেতারও উর্ধ্বে। সেই লিসবনের রাতের পরে রামোস রীতিমতো হয়ে উঠেছেন রিয়ালের আভিজাত্যের রুদ্র প্রতীক। হয়ে উঠেছেন স্লোগানের মধ্যমণি। রিয়াল সমর্থকরা আত্মবিশ্বাসের সাথে কখনো গান জুড়ে দেন, 'Ramos will score a goal olo lolololo... Ramos will scores a goal!'।
কিংবা কখনো বিশাল ব্যানারে লেখা হয় "VIVA LA MADRE QUE TE PARIO, SERGIO", অর্থ্যাৎ সেই মা দীর্ঘজীবী হোক যিনি সার্জিওকে জন্ম দিয়েছেন (Long live the mother who gave birth to you Sergio)। এযেন কেবলই স্তব করা নয়, বরং অন্তর থেকে দেওয়া আশীর্বাদ, কৃতজ্ঞতা। জানান দেয়া, সার্জিও রামোস কতটা গর্বে বুক ফুলিয়েছেন বিশ্বব্যাপী রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থকদের। তাই বলা যায়, তিনি বনে গেছেন রিয়াল মাদ্রিদের 'সমার্থক' এবং চমৎকার এক অনুভূতি, যা মাপার কোনো প্যারামিটার নিশ্চিতভাবেই নেই।
আর বারবার ত্রাণকর্তা ভূমিকায় অবতীর্ণ রামোস হলো মাদ্রিদের সেই অংশ বা ব্যক্তি, যে কিনা একধরনের দর্শন বা চেতনা রিয়াল মাদ্রিদে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে গেছে যা আগামীতেও রিয়াল মাদ্রিদ নিশ্চিতভাবে ধারণ করে চলবে। আর তা হলো, 'The soul of Real madrid is to never give up, and we always show it!'

চ্যাম্পিয়নস লীগের ইতিহাসে আজ অবধি রিয়াল মাদ্রিদ একমাত্র দল যারা টানা তিনবার তথা হ্যাট্রিকবার ইউরোপ শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট অক্ষুন্ন রাখতে পেরেছিলো। রিয়ালের তৈরি করা এই ঐতিহাসিক জয়গাঁথার গল্প আরো দীর্ঘ সময়, হয়তো শত বছর ধরে অক্ষত থাকার প্রবল সম্ভাবনা আছে। আর সার্জিও রামোস হলেন সেই দলের অধিনায়ক ও সবচেয়ে বড় তারকাদের একজন। সুতরাং ফুটবলকে যেদিন বিদায় বলবেন সেদিন নিঃসন্দেহে বিবেচিত হবেন সর্বকালের সেরা রক্ষণভাগের খেলোয়াড়দের তালিকায়। তবে একজন অধিনায়ক কিংবা দলনেতা সার্জিও রামোসকেই সবাই মনে রাখবে বেশি। মনে রাখবে 'রামোস টাইম' এ বিপক্ষ দলের উদযাপনের শত আয়োজন ভেঙে দেয়ার উপাখ্যানগুলোকে। সার্জিও রামোস হয়ে থাকবেন কারো কাছে 'পার্টি ব্রেকার' আর নিজ দলের প্রিয় সমর্থকদের কাছে 'পার্টি ক্রিয়েটর', 'দ্যা গ্ল্যাডিয়েটর' কিংবা 'দ্যা স্যাভিয়র' বিশেষণে।
শুভ জন্মদিন সার্জিও রামোস (৯২ঃ৪৮)।