রঙ দে বাসন্তী: ২০২০ সালে এসেও যে সিনেমাটা ভীষণ প্রাসঙ্গিক!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
রঙ দে বাসন্তীর গল্পটার সঙ্গে আজকের ভারতকে মেলান, এখনও ছাত্ররা রাজপথে, সরকার তাদের কথা শুনতে চাইছে না, চাপিয়ে দিতে চাইছে ভেদাভেদের আইন। অনেকে তো বলছেন, সিনেমার সেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চরিত্রটা ভারতেরই এখনকার এক ঘাঘু রাজনীতিবিদের হুবহু প্রতিচ্ছবি! মেলাতে না চাইলেও রঙ দে বাসন্তী এই ২০২০ সালেও ফিরে ফিরে আসে বারবার!
কিছু কিছু সিনেমা মুক্তির পরে কালজয়ী হয়ে ওঠে। যতোবারই দেখা হোক না কেন, নতুনের মতোই লাগে সেগুলোকে। প্রতিবার দেখতে বসলেই যেন নতুন কিছু আবিস্কার হয়, আবেগের দৃশ্যগুলোতে মরচে পড়ে না কখনোই। রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরার 'রঙ দে বাসন্তী' সিনেমাটাও এমন কিছুই। তেরো বছর আগে আজকের এই দিনে মুক্তি পেয়েছিল রঙ দে বাসন্তী, শুধু সিনেমা নয়, সিনেমার চেয়েও বেশিকিছু ছিল যেটা। সিনেমার চরিত্রগুলো এখনও আমাদের কাছে চিরতরুণ।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে বর্তমানের সমাজব্যবস্থাকে এমন চমৎকারভাবে আর কেউই মেলাতে পারেনি এর আগে-পরে। সিনেমার শেষের অংশ দেখে চোখে পানি আসেনি, এমন সিনেমাপ্রেমী বোধহয় খুঁজেই পাওয়া যাবে না। অথচ সিনেমার নাম শুরুতে রঙ দে বাসন্তী ছিল না। নাম রাখা হয়েছিল আহুতি। পরে পরিচালক রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরা এবং বাকী দুই চিত্রনাট্যকারের মনে হয়েছিল, নামটা বড্ড সেকেলে হয়ে যাচ্ছে, বদলানো দরকার। তাই নাম দেয়া হলো 'দ্য ইয়ং গানস অফ ইন্ডিয়া'। সেটাও মনমতো হলো না,।এরপরে নাম দেয়া হলো 'রঙ দে বাসন্তী'। জাফরানী রঙ বলতে আমরা যেটাকে বুঝি, হিন্দিতে সেটার নামই বাসন্তী। আর সেই নামটাই টিকে গেল শেষমেশ।
আমির খানের স্ক্রিপ্ট সেন্স বরাবরই দুর্দান্ত(থাগস অফ হিন্দোস্তান বাদে)। ভালো স্ক্রিপ্ট বেছে নিতে তার সময় লাগে না। গল্পটা যদি তাকে আকর্ষণ করে, অন্য কিছু তিনি খোঁজেনও না। রঙ দে বাসন্তীর বেলাতেও সেটাই ঘটেছিল। রাকেশ আমিরের বাসায় গিয়েছিলেন সিনেমার গল্প শোনাতে। চা খেতে খেতে স্ক্রিপ্ট নিয়ে কথা বলছিলেন দুজনে। বিশ মিনিটের মাথায় আমির খান বলে দিলেন, এই সিনেমাটা আমি করবো। চিত্রনাট্যের অর্ধেকটাও শোনা হয়নি তখনও, এরমধ্যেই আমির খান বুঝে গিয়েছিলেন, রাকেশ একটা 'মাস্টারপিস' নিয়ে এসেছেন!
তবে আমির খান কিন্ত রাকেশের প্রথম পছন্দ ছিলেন না। দলজিত 'ডিজে' সিং চরিত্রে শাহরুখ, ঋত্বিক সহ আরও কয়েকজনকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন রাকেশ, কেউ রাজী না হওয়ায় শরণাপন্ন হয়েছিলেন আমিরের। আমিরের বয়স তখন চল্লিশের কাছাকাছি, পঁচিশ বছরের এক তরুণের চরিত্রে ফাটিয়ে অভিনয় করেছিলেন তিনিও। রঙ দে বাসন্তীতে অভিনয়ের জন্যে দুই মাসে দশ কেজি ওজন কমিয়েছিলেন আমির।
পরে শাহরুখকে রাকেশ প্রস্তাব দিয়েছিলেন, অজয় রাথোড়ের চরিত্রে অভিনয় করার জন্যে, অনেকটা এক্সটেন্ডেড ক্যামিও ক্যারেক্টার ছিল সেটা। শাহরুখ রাজী হননি, বা সময় দিতে পারেননি। আর তাই মাধবন সুযোগ পেয়েছিলেন সেই চরিত্রে। এই সিনেমার সংলাপগুলো এখনও, এই ২০২০ সালে এসেও কি ভীষণ জীবন্ত! 'কোন দেশ পারফেক্ট হয় না, দেশকে পারফেক্ট বানাতে হয়'- এই একটা সংলাপই তো শরীরের রক্ত গরম করে দেয়ার জন্যে যথেষ্ট। কিংবা অতুল কুলকার্নির কণ্ঠে সেই কবিতাটা- "সারফারোশি কি তামান্না, আব হামারে দিল মে হ্যায়..." শুনে আজও গায়ে কাঁটা দেয়!
হিন্দু-মুসলমানের ভেদাভেদ থেকে শুরু করে ডিফেন্স বনাম সাধারণ মানুষের ভাবনার ফারাক, কিংবা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং রাজনীতিবিদদের আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে থাকা- সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে এসেছে সিনেমায়। এ আর রহমান তিন বছর সময় ব্যয় করে নির্মাণ করেছিলেন এই সিনেমার গানগুলো। রঙ দে বাসন্তীর গল্পটার সঙ্গে আজকের ভারতকে মেলান, এখনও ছাত্ররা রাজপথে, সরকার তাদের কথা শুনতে চাইছে না, চাপিয়ে দিতে চাইছে ভেদাভেদের আইন। অনেকে তো বলছেন, সিনেমার সেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর চরিত্রটা ভারতেরই এখনকার এক ঘাঘু রাজনীতিবিদের হুবহু প্রতিচ্ছবি! মেলাতে না চাইলেও রঙ দে বাসন্তী এই ২০২০ সালেও ফিরে ফিরে আসে বারবার!
সিনেমায় গুরুত্বপূর্ণ একটা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সোহা আলী খান। তার মা শর্মিলা ঠাকুর তখন সেন্সর বোর্ডের প্রধান। তিনি কিনা নিজের মেয়ের ছবিই আটকে দিলেন! সিনেমায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে গুলি করে খুন করার একটা দৃশ্য ছিল, সেটাতেই আপত্তি জানিয়েছিলেন শর্মিলা। সেন্সর বোর্ড থেকে বলা হয়েছিল, এই দৃশ্যটা বাদ দিতে হবে, অথবা অন্যভাবে দেখাতে হবে। এটা নিয়ে বচসা চলেছিল বেশ কিছুদিন।
মন্ত্রীকে হত্যার এই দৃশ্যটা ছিল সিনেমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোর একটা, এটা ছাড়া ক্ল্যাইম্যাক্সে ঢোকা যাবে না কোনভাবেই। এই সিকোয়েন্সটা এসেছিল আমিরের মাথা থেকে। রাকেশ এবং আমির, দুজনেই নিজেদ্রর জায়গায় অটল রইলেন, দৃশ্যটা তারা বাদ দেবেন না কোনভাবেই। তাহলে কি করা যায়? আমির খান তখন সিনেমার একটা স্পেশাল শো আয়োজন করলেন, দর্শক প্রণব মূখার্জী। এই ভদ্রলোক তখন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি সিনেমাটা দেখলেন, এবং তার সুপারিশেই সেন্সর বোর্ড আনকাট সার্টিফিকেট দিলো রং দে বাসন্তীকে!
২০০৬ সালে চল্লিশ কোটি রূপি বাজেটে সিনেমা বানানোটা বিলাসিতার শামিল। সেই কাজটাই করেছিলেন রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরা এবং তার সহ-প্রযোজক রনী স্ক্রুওয়ালা। এর বাইরেও আট কোটি রূপি তারা খরচ করেছিলেন প্রচারণার জন্যে! প্রায় পঞ্চাশ কোটির কাছাকাছি গিয়েছিল সিনেমার ব্যয়, এই বিশাল অঙ্কের টাকা বক্স অফিস থেকে তোলা যাবে কিনা, এই শঙ্কাটা তো ছিলই। তবে রাকেশের পূরো বিশ্বাস ছিল নিজের কাজের ওপরে, তাই বাজেটের সঙ্গে আপোষ করেননি তিনি। ফলাফল? সিনেমা ব্লকবাস্টার!