আমাদের দাবা জগতের অবিসংবাদিত রানী, সাতাত্তর বছর বয়সেও যিনি প্রবল প্রতাপে জয়ের নেশায় খেলে চলেন, বয়স যার কাছে একটা সংখ্যামাত্র। কুইন্স গ্যাম্বিটে বুঁদ হয়ে থাকা আমরা নিজেদের কুইনের খোঁজ কি রেখেছি?

নেটফ্লিক্সে নতুন একটা সিরিজ এসেছে, নাম কুইন্স গ্যাম্বিট। দুনিয়াজুড়ে ভিউয়ারশিপের রেকর্ড গড়ছে সিরিজটা, নেটফ্লিক্সের ইতিহাসে ওলট পালট ঘটে গেছে। চারদিকে প্রচুর আলোচনা এই সিরিজ নিয়ে। কুইন্স গ্যাম্বিটের একটা বড় অংশজুড়ে আছে দাবা খেলা। নেটফ্লিক্সের এই সিরিজ আলোচনার খোরাক যুগিয়েছে বাংলাদেশেও, আর তার সূত্র ধরেই অনেকে স্মরণ করছেন রানী হামিদকে। হ্যাঁ, রানী হামিদ, আমাদের দাবা জগতের অবিসংবাদিত রানী, সাতাত্তর বছর বয়সেও যিনি প্রবল প্রতাপে জয়ের নেশায় খেলে চলেন, বয়স যার কাছে একটা সংখ্যামাত্র। কুইন্স গ্যাম্বিটে বুঁদ হয়ে থাকা আমরা নিজেদের কুইনের খোঁজ কি রেখেছি সেভাবে? 

রানী হামিদের সঙ্গে আমার পরিচয়টা প্রথম আলোর মাধ্যমে। তখন ক্লাস ফাইভ বা সিক্সে পড়ি, ঢাকা থেকে প্রায় দেড়শো কিলোমিটার দূরের এক মফস্বল শহরে আমার বাস। মাথায় তখন নতুন নতুন দাবার ভূত চেপেছে, খেলাটা শিখেছি ক’দিন আগেই। যেখানে দাবার খোঁজ পাই, ছুট লাগাই। বইপত্র পেলে গোগ্রাসে গিলতে থাকি, পত্রিকায় দাবার খবর তো মুখস্ত হয়েই থাকে। গ্যারি কাসপারভ থেকে অ্যানাতোলি কারপভ, রগচটা ববি ফিশার থেকে ওই সময়ের ক্রেজ বিশ্বনাথন আনন্দ- সবার নাম আমি জানি। স্বদেশী গ্র্যান্ডমাস্টার নিয়াজ মোরশেদ কিংবা জিয়াউর রহমানদেরও আমি চিনি। 

সেই সূত্রেই রানী হামিদের নাম শুনলাম, তিনি তখন মহিলা ফিদে মাস্টার। মধ্যবয়েসী এই মহিলা দেশের দাবা অঙ্গনের পরিচিত মুখ, বছর বছর তিনি চ্যাম্পিয়ন হন- তাই তার প্রতি আগ্রহ জাগাটাই স্বাভাবিক। তার ওপর যখন জানলাম ফুটবলার কায়সার হামিদ তার ছেলে, তখন আগ্রহের পরিমাণটা আরও বাড়লো। দাবার প্রতি আগ্রহটা কমে গেছে অনেক আগেই, জীবনের স্রোতে এখন খেলাটার স্থান প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্ত চারপাশে কুইন্স গ্যাম্বিট নিয়ে এত এত আলোচনার মাঝখানে রানী হামিদের নামটা মাথায় না এসে পারলো না। 

দাবা খেলায় মগ্ন রানী হামিদ

৭৭ বছর বয়েসে এসে একজন নারী কি করতে পারেন?- এই প্রশ্নটা যদি আপনার মনের মধ্যে কখনও উঁকি দেয়, তাহলে রানী হামিদের দিকে একবার তাকিয়ে দেখবেন। যে বয়সে আমাদের দেশের শতকরা আটানব্বই জন মানুষ কবরে এক পা দিয়ে রাখে, হাজারটা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে চলৎশক্তি প্রায় হারিয়ে বসে থাকে, এই ভদ্রমহিলা সেই ৭৬ বছর বয়সে এসে দাপটের সাথে দাবা খেলে যাচ্ছেন, এখনও দেশের মহিলা দাবাড়ুদের মধ্যে তিনি সবার ওপরে, তাকে হারাতে পারছে না কেউই! নামের মতোই দেশের দাবা অঙ্গনে তিনি রানীর মতোই রাজ্যপাট সামলাচ্ছেন। শুধু কি তাই? শিরোপা জেতার পরে তিনি কোথায় অবসরের ঘোষণা দেবেন, তা না করে রানী হামিদ উল্টো বলছেন, পরের বছরগুলোতেও চ্যাম্পিয়ন হয়ে গিনেজ বুকে নাম লেখাতে চান! একটা মানুষের ভেতর প্রাণশক্তি কি পরিমাণ থাকলে এমনটা সম্ভব? 

চার ভাই আর চার বোনের বড়সড় সংসারে রানী হামিদ ছিলেন তৃতীয়। সিলেটে জন্ম নেয়া রানী হামিদের খেলাধুলার প্রতি ঝোঁকের শুরুটা শৈশব থেকেই। বাবা মমতাজ আলী প্রতি সন্ধ্যায় বন্ধুদের নিয়ে দাবার আসর বসাতেন, সেখানে হাজির থাকতেন ছোট্ট রানীও। স্কুলজীবনে ভাল ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় ও এ্যাথলেট হওয়া সত্ত্বেও দাবাই ছিল রানীর প্রধান ভালবাসা। জীবনটা যে সেই ভালোবাসার হাত ধরেই কাটাতে পারবেন, সেই নিশ্চয়তা অবশ্য ছিল না তখনও। কারন বাড়ি থেকে বাইরে গিয়ে খেলাধুলার অনুমতি ছিল না। পঞ্চাশের দশকে একটা মেয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে খেলাধুলা করছে- এটা অকল্পনীয় ব্যাপার ছিল। 

১৯৫৯ সালে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন আবদুল হামিদের (সাবেক সেনা কর্মকর্তা, 'তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা' বইয়ের লেখক) সঙ্গে বিয়ে হলো রানীর, নামের সঙ্গে হামিদ পদবীটা জুড়ে গেল তখন থেকেই। রানী হামিদ হয়তো গৃহিনী হয়েই কাটিয়ে দিতেন জীবনটা, যদি ত্রিশ বছর বয়সে অদ্ভুত একটা ঘটনা না ঘটতো। একদিন ছোট্ট মেয়ে স্কুল থেকে এসে বলল, ‘মা আমার বান্ধবীর বাবা দাবা খেলে কত নাম করেছে, তুমি কেন সেরকম কিছু করছ না? দাবা তো তুমিও খেলতে জানো, তাই না?’ ছোট্ট মেয়েকে সেদিন রানী হামিদ বলেছিলেন, তোমার বান্ধবীর বাবাকে একদিন বাসায় আসতে বলো। 

স্বামী আবদুল হামিদের সঙ্গে রানী হামিদ

তারপর ডা. আকমল হোসেন একদিন বাসায় এলেন। সাদা-কালো ৬৪ খোপের কোর্ট নিয়ে বসলেন রানী হামিদ। নেশাটা আরও একবার ঢুকে গেল মাথার ভেতর। এবার সাপোর্টও পেলেন পাশে। স্বামী ছিলেন ভীষণ ক্রীড়ানুরাগী মানুষ, প্রতি সন্ধ্যায় ক্যান্টনমেন্টের টেনিস কোর্টে আর কেউ হাজির থাকুক বা না থাকুক, হামিদ সাহেবকে সেখানে দেখা যেতোই। তিনিই স্ত্রীকে উৎসাহ দিয়েছেন খেলাধুলার ব্যাপারে, দাবায় রানীর আগ্রহ আছে জেনে বিভিন্ন প্রতিযোগীতায় অংশ নিতে পাঠিয়েছেন। 

১৯৭৭ সাল থেকে ঢাকার প্রতিযোগীতামূলক দাবায় রানী হামিদ পরিচিত মুখ, প্রতিবারই দেখা গেছে তাকে। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের প্রথম মহিলা জাতীয় দাবা প্রতিযোগিতার আসর অনুষ্ঠিত হয়। অনেকের মতো সেখানে নাম লেখান রানী হামিদ। প্রথম অংশগ্রহণেই সবাইকে চমকে দিয়ে শিরোপা জিতে নেন তিনি। একবার-দু’বার নয়, টানা ছয় বছর ধরে জাতীয় মহিলা দাবায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন তিনি, এই রেকর্ডটা কেউ ভাঙত পারেনি এখনও, ধারেকাছেও যেতে পারেনি অন্যরা। এ পর্যন্ত মহিলা দাবা চ্যাম্পিয়নশীপের আসর বসেছে মোট ৩৯ বার, এরমধ্যে বিশবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন রানী হামিদ, অর্ধেকেরও বেশি শিরোপা জমা আছে তার ঘরে! 

নারী-পুরুষ মিলিয়ে বাংলাদেশের দাবার ইতিহাসে তার চেয়ে বেশি বার শিরোপা জিততে পারেননি আর কেউই। সব মিলিয়ে ১১ বার জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হয়ে পরের অবস্থানটি গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমানের। শুধু নারীদের মধ্যে হিসাব করলে রানী হামিদের পর সবচেয়ে বেশি জাতীয় শিরোপা সৈয়দা শাবানা পারভীনের; মাত্র ৫ বার। বয়স, বার্ধক্য, শারীরিক অসুস্থতা- কোনকিছুই তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। দাবার বোর্ডের সামনে বসলে তার মাথাটা মেশিনের মতো কাজ করতে শুরু করে আজও। বৃটিশ মহিলা দাবায় তিনবারের চ্যাম্পিয়ন তিনি, ১৯৮৪ সালেই ফিদে মাস্টার খেতাব অর্জন করেছিলেন আন্তর্জাতিক দাবা ফেডারেশনের তরফ থেকে। 

রানী হামিদের সমসাময়িক যারা ছিলেন, তারা তো খেলা ছেড়েছেন সেই কবেই। নব্বইয়ের দশকে যারা এসেছেন, তারাও অতীত হয়েছেন। গত দশকে যারা রানীর সঙ্গে খেলেছেন, তারা এখন সংসার-বাচ্চা সামলাচ্ছেন। অথচ রানী হামিদ এখনও খেলে চলেছেন, জিতে চলেছেন। এখন তার সঙ্গে যারা প্রতিদ্বন্দ্বীতা করে, এদের অনেকেই তার নাতনীর বয়েসী, তাদের সামনে অনুপ্রেরণার ভাণ্ডার হয়ে টিকে আছেন তিনি এখনও। ৭৭ বছর বয়সে এসেও রানী হামিদ এখনও খেলাটাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন, প্রতিটা ম্যাচেই তিনি জিততে চান, বোর্ডে শুরু থেকেই প্রতিপক্ষের ওপর আক্রমণের ছক কষেন। নিজের খেলা নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেন না, চান আরও ভালো করতে। 

প্রতিযোগিতামূলক দাবায় তখনও নতুন রানী হামিদ

বিশ্ব দাবা অলিম্পিয়াডে শুধু মহিলা দলই নয়, জাতীয় দলের হয়ে অংশ নিয়েছেন রানী হামিদ- যে সম্মান বিশ্বের খুব কম মহিলা দাবাড়ু-ই রয়েছে। নিজের বর্ণিল ক্রীড়া জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি লিখেছেন বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক দাবা খেলার ওপর বই 'মজার খেলা দাবা', তার লেখা আরেকটি বই হচ্ছে 'দাবা খেলার আইন কানুন'। অনেকেই অভিযোগ করে,মায়েরা কর্মজীবী হলে নাকি সন্তান বখে যায়। সেসব নিন্দুকদের মুখে ঝামা ঘষে দেয়ার কাজটাও করেছেন রানী হামিদ। তিনি শুধু একজন সফল দাবাড়ু-ই নন, একজন সফল মা-ও। তাঁর দুই ছেলে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের এক এক জন উজ্জ্বল নক্ষত্র, তার ছেলে ফুটবলার কায়সার হামিদ তো নিজেই একজন কিংবদন্তি। 

রানী হামিদের জন্ম ১৯৪৪ সালে, এখন তার বয়স ৭৭ বছর। ক্রীড়াক্ষেত্রে তার যে অর্জন, যুগের পর যুগ ধরে দেশের দাবা অঙ্গনে প্রভাবশালী বিচরণ, এসবের পাশাপাশি জীবনভর যে সংগ্রাম তিনি করেছেন, রক্ষণশীল সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে এগিয়ে যাওয়ার অন্যরকম এক গল্প লেখার যে সাহস তিনি দেখিয়েছেন, তাকে নিয়ে ডজনে ডজনে বই লেখা যায়, কয়েকটা সিনেমা বানানো যায়, স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচিতে তার জীবনী অন্তর্ভুক্ত করা যায়, যাতে সমাজে পিছিয়ে থাকা মেয়েরা রানী হামিদের গল্প থেকে অনুপ্রেরণা নিতে পারে। কুইন্স গ্যাম্বিট দেখে আফসোস বাড়ে, আমাদের নিজেদেরই দাবার এত বড় একজন রানী আছেন, অথচ তাকে নিয়ে কিছুই করা হয়নি এদেশে। 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা