যুদ্ধে হেরে যাওয়া সেনা কর্মকর্তাদের পদচ্যুত করা হয় বিশ্বজুড়ে। অথচ রাও ফরমান আলীকে কীনা পুরস্কৃত করেছিল পাকিস্তান সরকার! কেন জানেন? বুদ্ধিজীবি হত্যাকান্ড আর অপারেশন সার্চলাইটের মাস্টারমাইন্ড ছিল এই ঠান্ডা মাথার খুনিটা!

যুদ্ধে হেরে যাওয়া সেনাপতি বা সেনা অফিসারদের পদোন্নতি দেয়ার কোন নজির পৃথিবীর ইতিহাসে নেই। কোথাও এটা করা হয় না। পরাজিত সেনা কর্মকর্তাদের বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়, তাদের বেতন বা পেনশন কেটে রাখা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে পৃথিবীর আরও অনেক যুদ্ধে এমন উদাহরণ দেখা যাবে। ১৯৭১ সালে মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তানীদের কাছে আত্মসমর্পণের পর জেনারেল নিয়াজীকেও বাধ্যতামূলক অবসরগ্রহণ করতে হয়েছিল দেশে ফিরে গিয়ে। 

কিন্ত অদ্ভুত একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটেছিল  সেবার, নিয়াজীর অধীনে থাকা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীকে সসম্মানে চাকুরীতে বহাল রেখেছিল পাকিস্তান সরকার, পরে তো আরও অনেক দায়িত্বও দেয়া হয়েছিল তার কাঁধে। কিন্ত কারণটা কী? কী এমন করেছিলেন রাও ফরমান আলী, যার কারণে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পূর্ব বাংলার অধিকার হারানোর পরেও পাকিস্তানীরা তাকে মাথায় তুলে রেখেছিল? 

এই প্রশ্নের উত্তরটা ভীষণ নির্মম। অন্তত আমাদের জন্যে তো অবশ্যই। ১৯৭১ এর ১৩-১৪ আর ১৫ই ডিসেম্বরের কালো দিনগুলোতে ঢাকার বুকে যে পৈশাচিক গণহত্যা চালানো হয়েছিল, বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছিল বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান, নানা পেশার বুদ্ধিজীবীদের- সেই হত্যাকান্ডের মাস্টারমাইন্ড ছিল এই রাও ফরমান আলী নামের নরপিশাচটা। তার মাথা থেকেই বেরিয়েছিল বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার এই কুখ্যাত পরিকল্পনাটা। 

বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ডের হোতা ছিল এই রাও ফরমান আলী

বৃটিশ ভারতের পাঞ্জাবে জন্ম নেয়া রাও ফরমান আলী বৃটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির আর্টিলারি রেজিমেন্টে কমিশন্ড অফিসার হিসেবে যোগ দেয় ১৯৪২ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বৃটিশদের পক্ষে লড়াই করেছিল সে। সাতচল্লিশের দেশ ভাগের পরে রাও ফরমান আলী চলে গেল পাকিস্তানে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে মিলিটারি পুলিশ বিভাগে যোগদান করলো সে। চাকরিজীবনে বিভিন্ন সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিভিন্ন বিভাগে দায়িত্ব পালন করেছে রাও ফরমান আলী, ১৯৬৫ সালের ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে তার ভূমিকা সম্পর্কে অবশ্য কোন ডকুমেন্ট পাওয়া যায়নি। 

১৯৬৯ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে নিয়োগ দেয় রাও ফরমান আলীকে। পরের বছর মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হয় সে। স্বাধিকার আর স্বাধীনতার দাবীতে বাঙালি যখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে, তখন পাকিস্তানের জান্তা সরকার হিংস্র হয়ে উঠলো। আর বন্দুকের গুলিতে বাঙালির তাজা রক্ত দিয়ে হোলি খেলার নীল নকশা সাজালো রাও ফরমান আলী। পঁচিশে মার্চের অপারেশন সার্চলাইটের পুরোটাই তার পরিকল্পনা, ঢাকা শহরটাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়ার খুনে আইডিয়াটা তার মাথা থেকেই বেরিয়েছিল।

অপারেশন সার্চলাইটের নামে সেই ঘৃণ্য গণহত্যার মিশনটা বাস্তবায়িত হয়েছিল রাও ফরমান আলীর কারণে। বাঙালির স্বাধীনতার বিরোধীতা করা জামায়াতে ইসলামীকে কাজে লাগিয়ে দেশজুড়ে রাজাকার আলবদর আর আল শামস বাহিনী গঠিত হয়েছিল তার নির্দেশেই। ধূর্ত মস্তিস্কের রাও ফরমান আলী বুঝতে পেরেছিল, স্থানীয় লোকজন কাউকে হাত করতে না পারলে ঘরের খবর বের করা যাবে না। আর সেকারণেই আল-বদর আর আল শামসের জন্মটা তার হাত ধরেই হয়েছিল। 

বৃদ্ধ রাও ফরমান আলীর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে ২০০৪ সালে

নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের শেষপ্রান্তে পাকিস্তানীদের পরাজয়টা যখন সময়ের ব্যাপার মাত্র, তখনই ঘৃণ্য এক চাল চেলে বসলো রাও ফরমান আলী। বাঙালি জাতির মেরুদণ্ডটা ভেঙে দেয়ার জন্যে তালিকা বানিয়ে হত্যা করলো জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। শহীদ বুদ্ধিজীবিদের নাম লেখা তার ডাইরিটা পাওয়া গিয়েছিল গণভবনে, মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় ভীত হয়ে সেটা গণভবনে রেখেই পালিয়ে গিয়েছিল রাও ফরমান আলী। 

পরে মিত্রবাহিনীর সদস্যরা সেই ডাইরি উদ্ধার করেন, সেখানে লেখা নামগুলোর মধ্যে এক-দুইজন কেবল বেঁচে গিয়েছিলেন ভাগ্যগুণে। বাকীদের কারো লাশ পাওয়া গিয়েছিল, কাউকে খুঁজেই পাওয়া যায়নি কখনও। পুরো মিশনে তাকে সাহায্য করেছিল আলবদর কমাণ্ডার চৌধুরী মইনুদ্দিন, নিজামী, আশরাফসহ কয়েকজন শীর্ষ জামায়াত নেতা। অথচ এই কোল্ড ব্লাডেড মার্ডারারটিই আবার ১৩ই ডিসেম্বরের বিমান হামলার পরে প্রাণ বাঁচানোর জন্যে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আশ্রয় নিয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলেছিল- 'যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই!' এ যেন ভূতের মুখে রাম নাম! 

এভাবেই রাও ফরমান আলীর মতো নরপিশাচেরা একটা জাতিকে ধ্বংস করে দেয়ার মিশন বাস্তবায়ন করে ফেলে, সেই দেশেরই কিছু অমানুষ কুলাঙ্গারের সাহায্য নিয়ে। তাদের মিশন তো সফল, কারণ মুক্তিযুদ্ধের চার যুগ পরে এসেও একদল মুর্খ অম্লান বদনে দাবী করে, পাকিস্তান আমলেই নাকি দেশ ভালো ছিল, বুদ্ধিজীবিরা নাকী পাকিস্তানের প্রতি অনুগত ছিল, নইলে ডিসেম্বরের ১৪ তারিখ পর্যন্ত কেন তারা ঢাকায় থাকবেন? বাঙালি জাতিকে মেধাগত দিক দিয়ে দেউলিয়া করার কাজটা তো সেই একাত্তরেই করে গিয়েছিলেন, ২০১৯ সালে এসে আমরা যে এমন প্রশ্ন তুলছি, তাতে আর অবাক হবার কী আছে!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা