পাহাড়ে ঘরে ঢুকে মাকে মারধর করে মেয়েকে গণধর্ষণ- এখানে মূখ্য কী? সেক্স না গায়ের জোর? এমসি কলেজে স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে গণধর্ষণ- এখানে সেক্স মূখ্য নাকি গায়ের জোর? নোয়াখালীর ভিডিও তো দেখলেন- কী মনে হয়? সেক্স মূখ্য ছিল?

সিলেটের যে এলাকায় আমার বাড়ি, সেই ইউনিয়ন বা আশেপাশের ১৫-২০ টা গ্রামে ধর্ষণের কোনো ইতিহাস নেই। ধর্ষণ দূরে থাক, ইভটিজিং জিনিসটাও এখানে নেই বললেই চলে। এই পোস্ট লেখার আগে আমি কয়েকজনের সাথে কথা বলে নিশ্চিত হয়েছে নিকট অতীতে আমাদের এই এলাকায় কোনো ইভটিজিং এর ঘটনা ঘটেনি।

একটু অবাক করার মতো ব্যাপার, তাই না? কিন্তু এটা সত্যি। আমি এই এলাকায় থেকে ইন্টার পর্যন্ত পড়ালেখা করেছি। এখনো এলাকার সাথে খুব ভালোভাবে কানেক্টেড। ইভটিজিং, রেইপ বা অপহরণের ঘটনা এখানে ঘটে না বললেই চলে।

প্রশ্ন আসতে পারে অনেকগুলো। প্রথম প্রশ্ন, আমাদের এই এলাকার মানুষজন কি খুব বেশি সভ্য? উত্তর হলো, না। এখানকার মানুষকে এই ইস্যু বাদ দিয়ে অন্য কোনোভাবে খুব বেশি সভ্য বলার সুযোগ কম। গড়পড়তা অন্য এলাকার মানুষের মতোই জীবন এখানে।

এখানে কি তবে মাদক নেই? প্রচণ্ড পরিমাণে মাদক আছে। ইন ফ্যাক্ট এই এলাকা মাদকের একটা রুট। মাদক ব্যবসাই সম্ভবত এখানকার সবচেয়ে বড়ো অর্থনীতি। যতটা ব্যবসা হয় ততটা মারাত্মক  পরিমাণে  মাদকসেবী হয়তো নেই, কিন্তু মাদককে এখান থেকে আলাদা করা যাবে না। (আমাদের এলাকার মাদক সমস্যা নিয়ে দীর্ঘ একটা লেখা আমার টাইমলাইনে আছে)

তাহলে কি এখানকার মেয়েরা সবাই হিজাব পর্দা করে? না, সবাই হিজাব পর্দা করে না। বাংলাদেশের এমন কোনো এলাকা নাই যেখানে শতভাগ মেয়ে পর্দা ফলো করে। দশ পার্সেন্টের মতো হিন্দু মেয়ের হিসেব তো আলাদা। তাছাড়া গত বিশ বছর ধরেই দেখছি আমাদের স্কুলগুলোতে ভালো রকমের গান বাজনা হয়। মেয়েরা পাব্লিক মঞ্চে গান করে, নাচ করে। স্কুলের মাঠে খেলাধূলা করে। বাজারের পাশে স্কুল, শত শত মানুষ সেটা দেখে। 

তাহলে কি আমাদের এলাকা অতি আধুনিক? প্রগতির উদারতা উপচে পড়ছে? পর্দা নিয়ে হুজুর বা সাধারণ মানুষ কিছু বলে না?

এই এলাকাকে মোটেও অতি আধুনিক বলার সুযোগ নেই। প্রগতিবাদ কী সেটা অধিকাংশ মানুষই বুঝে না। বরং এটা এভারেজের চেয়েও বেশি কনজারভেটিভ এরিয়া। এজ ইউজুয়াল, অন্য এলাকার মতোই এখানে হুজুরেরা পর্দা নিয়েই বেশিরভাগ ওয়াজ করেন। মসজিদ মাদ্রাসার মাইকে যেসব গজল বা ইসলামি সংগীত গাওয়া হয় সেখানে "পর্দা না করলে বেহায়া বানাইবে শয়তানে, মা বোন থাকিয়ো সাবধানে" ধরনের গানগুলোকে জাতীয় সংগীত বলা যায়। মার্কেটে মেয়েরা যাচ্ছে বলেই যে দেশ ধ্বংস হচ্ছে- চায়ের দোকানে এইটা মোটামুটি জনপ্রিয় একটা আলাপ। 

পর্ণ? পর্ণ কেমন চলে? পর্ণ দুনিয়ার সব জায়গাতেই সমান চলে ভাই। যেখানেই এক্সেস আছে পর্ণের, সেখানেই তার চর্চা আছে। এখানকার মোবাইল সার্ভিসিং দোকানে পর্ণ সাপ্লাই নিয়ে একবার লিখেছিলাম। ঢাকা বা অন্য অনেক জায়গার মতো পর্ণ নিয়ে ওপেন আলোচনা শুনিনি তবে পর্ণ ভালোমতোই আছে এখানে এটা আন্দাজ করা যায়।

আর কী বাকি থাকে?

ভিলেজ পলিটিক্স- তীব্রভাবে আছে।
জায়গা জমি নিয়ে বিরোধ- নাই মানে!
বউ পেটানো- সেটাও আছে। ও হ্যাঁ, প্রেম পীরিতের কথা তো বলতে ভুলেই গেছি। ইভটিজিং নেই শুনে হয়তো অনেকে ভাবতে পারে এখানকার ছেলে মেয়েরা বেশ আলাভোলা, প্রেম কী বুঝেই না।

ভাইরে ভাই, এবার দীর্ঘদিন বাড়িতে থাকার পর দেখলাম এই জিনিসের চর্চা কত মারাত্মকভাবে এখানে হচ্ছে। এমনও সিএনজি ড্রাইভার নাকি আছে যারা মেয়ে তুলে আনা ছাড়া অন্য কোনো ট্রিপই নেয় না। মেয়ে তুলে আনা বিশেষজ্ঞ ড্রাইভারদের ইনকাম নাকি বেশ ভালো।

বিয়ে ঠিক হয়ে যাবার পরও বহু মেয়ে পালাচ্ছে। মাথায় চপচপে সরিষার তেল নিয়ে সিথি দেয়া আপাত আলাভোলা ছেলেদেরও দেখা যায় কীভাবে জানি মেয়ে ভাগিয়ে নিয়ে এসেছে। মানে হলো, এই ইভটিজিং মুক্ত এলাকা বা এলাকার মানুষ গড়পরতা অন্য সব এলাকার মতোই। ব্যবধান কেবল একটাই, এখানে পলিটিক্যাল ক্ষমতা চর্চা খুবই কম। যদি বলি একেবারেই নেই, সেটাও খুব বেশি ভুল বলা হবে না।

আমি বিএনপির আমল খুব ভালোভাবেই দেখেছি। বিএনপি বা জামাতের নাম ভাংগিয়ে এখানে কেউ মাস্তানি করেনি। আওয়ামীলীগার কারো বাড়ি ঘরে হামলা হয়নি। এখন আওয়ামী সময়ে বিএনপি বা জামাত কর্মীরা মোটামুটি নিরাপদ। রাজনৈতিক মামলা আছে, ধর পাকড় আছে। কিন্তু একজন বিএনপি করে বলে বা জামাত করে বলে বিপক্ষ পার্টির লোকে তাকে মাইর দিয়ে দিয়েছে অথবা তার বাড়িতে-ব্যবসায় হামলা করেছে এমন নজির নাই এখানে। ন্যূনতম মৌখিক অপদস্তও করা হয় বলে আমি জানি না।

ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবীতে আন্দোলন চলছে দেশজুড়ে

আওয়ামীলীগের কমিটি আছে, ছাত্রলীগের কমিটি আছে। কিন্তু চিরাচরিত ক্ষমতার দাপট একদম নাই। ক্ষমতার দাপট বিচ্ছিন্নভাবে অনেকেই দেখায় তবে সেখানে পলিটিক্যাল কানেকশন থাকে না। এটা ব্যক্তিগত বা পারিবারিক দাপট। নারীকেন্দ্রিক কোনো হয়রানিতে এই এলাকার মানুষ কখনোই রাজনীতিকে প্রশ্রয় দেয়নি। 

আমি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করি, রেইপ বা ইভটিজিং এর মূল কারণ পাওয়ার প্র‍্যাক্টিস। সুনির্দিষ্টভাবে বললে পলিটিক্যাল পাওয়ার প্র‍্যাক্টিস। পাওয়ার প্র‍্যাক্টিস ছাড়া ধর্ষণের পেছনে যত ইলিমেন্টকে দায়ী করা হয়, তার সবই এখানে আছে। কিন্তু তাও রেইপ নাই, ইভ টিজিং নাই।

কারণ এই একটাই, এখানে পলিটিক্যাল পাওয়ার প্র‍্যাক্টিস নাই। এখানকার নেতা বা ছাত্রনেতারা নিজেদের সর্বেসর্বা ভাবে না। সবাই জানে, সে যদি আজকে ইভ টিজিং করে, যার ছেলেই হোক কালকে সামাজিকভাবে তার বিচার নিশ্চিত করা হবে। আমরা যখন স্কুলে পড়তাম তখন দুএকজনে ইভটিজিং এর দায়ে শাস্তি দেয়া হয়েছে। সত্যি বলতে অনেকেই তখন লঘু পাপে গুরু দণ্ড পেয়েছে। হয়তো একটা মেয়েকে দেখে শিষ বাজিয়েছিল, পরের দিন জুতা গলায় দিয়ে তাকে ঘুরানো হয়েছে পুরো স্কুল। কেউই এদেরকে বাঁচানোর কোনো চেষ্টা করেনি।

নারীর প্রতি যে কোনো সহিংসতার মূল কারণ ক্ষমতা। যে পুরুষটি বউ পেটায়, সেও এই ক্ষমতার জোরেই পেটায়। যে রেইপ করে, ক্ষমতার জোরেই করে।

ভাই, রেইপ কোনো সেক্সুয়াল ইন্সিডেন্স না, রেইপ পাওয়ার শো অফ। এখানে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জোর খাটানোর দরকার পড়ে। একেবারে রেয়ার ব্যতিক্রম ছাড়া প্রতিটা ধর্ষক ধর্ষিতার চেয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশি ক্ষমতাশালী৷ এই মার্জিনটা আপনাকে বুঝতে হবে।

একটা মেয়ে খোলামেলা পোশাক পরলে একটা ছেলের যৌন বাসনা তৈরি হতেই পারে। কিন্তু সেই বাসনা তৈরির মানেই রেইপ করা এমন না। যৌন বাসনা তৈরি আর রেইপের মাঝখানে অনেক অনেক স্টেপ রয়ে যায়। এখন ইন্টারনেট-ফেসবুক হাতে হাতে। মানুষ চাইলেই মিউচুয়ালি যৌন সম্পর্ক করে ফেলছে। ধর্ষকদের সবাই অবিবাহিত না। এসকর্ট সার্ভিস, প্রস্টিটিউশন, মাস্টারবেশন...কত কী রয়ে যায় মাঝখানে।

দেখুন, বিচারহীনতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার, এই দুইটা ফ্যাক্টর বাদ দিয়ে বাজারে যতগুলো অন্য ফ্যাক্টর আলোচিত তার একটাও অপ্রাসঙ্গিক না। আপনি যদি ইসলামিস্ট হোন, আপনি ইসলামের বেসিক পয়েন্ট পর্দা নিয়ে কথা বলবেন- এটা খুবই স্বাভাবিক। যে কোনো মানুষ ভোগবাদী সমাজের বিরোধীতা করতে পারে। এটা সমস্যা না।

সমস্যা হলো, রেইপের কোনো ইন্সিডেন্স আসার পরই সেখানে পোশাক টেনে নিয়ে আসা। রেইপ ইজ অল এবাউট পাওয়ার, অল এবাউট পাওয়ার। এই পয়েন্টে প্লিজ একমত হোন। অশালীল পোশাক, ফ্রি মিক্সিং, ব্যাভিচার... এই সবকিছুকেই সমস্যা হিসেবে ধরে নিয়ে আপনি আলোচনা করেন। প্রয়োজনে আন্দোলন করেন। কিন্তু প্লিজ, একটু বুদ্ধি ও বিবেক খাটিয়ে রেইপ সমস্যাটাকে আইসোলেট করেন।

পাহাড়ে ঘরে ঢুকে মাকে মারধর করে মেয়েকে গণধর্ষণ শেষে ঘর লুট- এখানে মূখ্য কী? সেক্স না গায়ের জোর? এমসি কলেজে স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে গণধর্ষণ, গয়না লুট, গাড়ি জব্দ করে টাকা দাবী- এখানে সেক্স মূখ্য নাকি গায়ের জোর?

কুষ্টিয়ায় পারিবারিক কলহের জের ধরে ভার্সিটি ছাত্রীকে তিন ভাই, মামা ও মামাত ভাই  (মানে বাবা ছেলেও ছিল) মিলে গণধর্ষণ, লাশ ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে রাখা- এখানে সেক্স মূখ্য নাকি গায়ের জোর? নোয়াখালীর ভিডিও তো দেখলেন- কী মনে হয়? সেক্স মূখ্য ছিল? তার আগে ধানের শীষে ভোট দেয়ায় যে নারীকে গণধর্ষণ করা হয়েছিল, সেটা কী সেক্সের জন্যই করা হয়েছিল?

বাংলাদেশে এক সময় এসিভ সন্ত্রাস মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছিল। সেটা থামাতে বেশিদিন লাগেনি। কেন লাগেনি? কারণ একটা কার্যকরী আইন করা হয়েছিল, পাশাপাশি দেশের সব মানুষ এটাকে ক্রাইম হিসেবে দেখেছিল। ধর্ষণকে ক্রাইম হিসেবে দেখেন, ভিক্টিম ব্লেইম বন্ধ করে- সমস্যার তাতেই সমাধান হবে না। কিন্তু সমাধানের পথ বের হবে।

পোশাক ব্যাপারে যারা কনসার্নড, আপনাদের প্রতি আমার ব্যক্তিগত কোনো সমস্যা নেই। আমি বা আমার পরিবারের কেউই আপনাদের ভাষায় যেটা অশালীন বা উগ্র পোশাক সেটা পরি না। উগ্র চলাফেরা, কথা বলার অভ্যাসও নেই।

আমি আপনার সাথে একটা জায়গাতেই একমত না। আমি পোশাককে ধর্ষণের কারণ মনে করি না। অন্তত বর্তমানে যে ধাঁচের রেইপ হচ্ছে তার সাথে পোশাক তো আরো যায় না। দুএকটা কেসে যদি কারণ হয়েও থাকে, যদি কিছু ক্ষেত্রে এর ক্ষুদ্রতম ভূমিকা থেকেও থাকে, আসল কারণের চেয়ে এটা এতই ক্ষুদ্র যে এই নিয়ে আলোচনা করে মূল পয়েন্টকে হালকা করতে চাই না।

আপনি আজকে ধর্ষণের মতো গুরুতর একটা অপরাধকে বুঝে না বুঝে, বেশি লাইক পাবার আশায় বা ইসলামি সেন্টিমেন্টকে ভুলভাবে নিয়ে পোশাকের ওপর দিয়ে দিচ্ছেন।

নিশ্চিত থাকেন, ভিক্টিমের কান্না ও কষ্টের একটা দায়-অভিশাপ আপনার ওপর পড়বে। আপনি পটেনশিয়াল রেপিস্ট- এমন সরল সমীকরণে যাব না। তবে অবশ্যই আপনি রেপিস্টকে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় সাহায্য করছেন।

আমার আইডি ফেইক না। আমার স্কুলের ৫-৬ জন টিচার এই আইডিতে আছেন। আলেম, ব্যবসায়ী, সকল দলের পলিটিশিয়ান...এলাকার সব শ্রেণীর কমপক্ষে অর্ধ হাজার মানুষ এই আইডিতে যুক্ত। এলাকা নিয়ে কিছু ভুল বললে তারা ধরিয়ে দেবে।

১৫/২০ বা ২৫ টা গ্রাম দেশের তুলনায় সামান্য অংশ। আবার ২৫ টা গ্রাম একেবারে কম জায়গাও না। এটাকেই একক হিসেবে ধরে নিতে পারেন।

আপনি আমার এলাকায় অপরিচিত মানুষ হিসেবে আসেন। পরিচিত একটা মেয়েকে নিয়ে রাস্তা ধরে হেঁটে যান। মানুষ ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকবে এটা সত্যি। কিন্তু আমার বিশ্বাস কেউ আপনার সাথের মেয়েটিকে "মাল" বলবে না। ওড়না টানবে না। মানুষ "টানা দেয়া" ক্ষমতার চর্চায় এখনো অভ্যস্ত হয়নি। এলাকা নিয়ে অনেক কারণেই বিতৃষ্ণা কাজ করে। তবে এই একটা কারণে এখানকার মানুষকে ভালো লাগে।

আমাকে আনফলো করেন, হেটার বনে যান কোনো সমস্যা নেই। কেবল মূল সমস্যাটা একটু বোঝার চেষ্টা করুন। সমস্যা অবশ্যই আপনি এক সময় বুঝবেন, সেটা যেন খুব বেশি দেরি না হয়।

ছবি কৃতজ্ঞতা- ঢাকা ট্র্রিবিউন

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা