ক্যাপশনটা দেখে কি জ্বলে পুড়ে উঠছেন? আমাকে শাপশাপান্ত করছেন? একটু বাকিটুকু পড়ুন। এরপর আমার সাথে সাথে নিজেকে, চারপাশের সমাজকেও বক্রোক্তি করবেন আশা করি।
অর্ণব ভট্টাচার্য্য: ক্যাপশনটা দেখে কি জ্বলে পুড়ে উঠছেন? আমাকে শাপশাপান্ত করছেন? একটু বাকিটুকু পড়ুন। এরপর আমার সাথে সাথে নিজেকে, চারপাশের সমাজকেও বক্রোক্তি করবেন আশা করি।
চলন্ত বাসে ধর্ষণের পর খুন হওয়া রুপার সংগ্রামের কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছিলাম। কৃষকের মেয়ে রুপা তার বেতন বৃদ্ধির খবরে মাকে চমকে দিবে ভেবেছিল। আজ রুপা কিছু 'গর্বিত পুরুষের বদান্যতায়' পরপারে, মা সংজ্ঞাহীন।
আজ এই ধর্ষণের বিরুদ্ধে কিছু লিখা হচ্ছে, খবরের কাগজে হেডলাইন হচ্ছে। কিন্তু কেন? আজ যদি বাসের বদলে অন্য কোন জায়গায়, 'স্বাভাবিকভাবে' ধর্ষণ হত তাইলেও কি এতোটা নিউজ হত? আবার আমার মানবিকতা নিয়ে শাপশাপান্ত করবার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন। খবরের কাগজে দৈনিক ধর্ষণের খবর আসবেই, এ এক নিয়তি আমাদের। আর এগুলোকে ধর্ষণের অভিযোগ নাম দিয়ে পত্রিকাগুলো ভেতরের পৃষ্ঠায় স্থান দেয়। কাহাতক এক খবর পাঠকের ভালো লাগে!
তাই একটু সাহস করেই বলি, আজ রুপার মত কোন মেয়ে যদি এতোটা নৃশংসভাবে ধর্ষিত না হত, এটা আর দশদিনের মত স্বাভাবিক ঘটনাই থেকে যেত। বড়জোর দুইএকজন পত্রিকার ভেতরের পৃষ্ঠার খবর শেয়ার দিত আর আমার মত চুনোপুঁটিরা এংগরি রিএকশন দিয়ে নিজের কাজে মেতে উঠতাম। ঝামেলা করল, এই বাসটা, তাই না?
তাই বলি, মুল সত্যকে স্বীকার করুন, আমরা এতোটাই বুনো পুরুষ জাতি যেখানে নিয়ত ধর্ষণের খবর আসবেই। আপনি হয়ত ডেটা নিয়ে এসে আমরা অমুক দেশের চেয়ে ভালো এই প্রমানে ব্যস্ত হবেন কিন্তু সত্য হল আপনি নিজেও জানেন আপনার মেয়ে বাইরে গেলে আপনি কতটা ভীত থাকেন এই বুনো পশুদের থেকে।
এখন আসি মুল পয়েন্টে, ধর্ষণ কিভাবে থামানো যায়? অন্যতম উত্তর হবে কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে, যতটা দ্রুত সম্ভব বিচার কাজ শেষ করতে হবে (সব হাইপথেটিক্যাল কথাবার্তা)। আর সাথে আমি অ্যাড করি- সামাজিক প্রতিরোধ করতে হবে এবং আমার মতে এটাই সর্বাধিক জরুরি, আর এমন কিছু যা আমরা প্রত্যেকে নিজেরা চাইলেই একটু একটু করে পারব। নিচে বিস্তারিত বলছি।
একটা প্রশ্ন করি, মানুষের 'ধর্ষক' হয়ে ওঠা কিভাবে ঠেকাবেন? কি একটু অবাক হচ্ছেন? কেন? ধর্ষক তো আমার আপনার মতই এই সমাজেই থাকে, জন্ম নেয় মানুষ হিসেবে। কালক্রমে ধর্ষক হয়। আমাদের সমাজ নারীদের কখনও মানুষ মনে করে না, বরঞ্চ তারা পুরুষের অধস্তন, তাদের উপর খবরদারি করা যাবে- এটাই ম্যাস পাব্লিক পারসেপশন। এই খবরদারি থেকে জন্ম নেয় পাওয়ার এক্সারসাইজ। ধর্ষণকে বলা যেতে পারে পাওয়ার এক্সারসাইজের জঘন্যতম, নিকৃষ্ট পরিণাম। আমরা সবাই ধর্ষণকে ছিঃ ছিঃ করছি, কিন্তু এর আগের স্টেপগুলোকে কিন্তু পিঠ চাপড়ে বাহবা দেই। আমার সুলেখক ছাত্রের স্ট্যাটাস থেকে কিছু অংশ দেই-
"এইখানে, ছেলেদের একটা কৃতিত্ব হল মেয়েদের কত সহজে- ইফ আই এক্সাক্টলি ইউজ দ্য টার্ম- 'খেয়ে ছেড়ে দেয়া যায়।'
দুই দিন পর পর আট মিনিট, দশ মিনিটের ভিডিওগুলো ভাইরাল হয় কেন জানেন? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শোনা যায়- বয়ফ্রেন্ড জেলাস হয়ে এই কাজ করেছে। ছেলেটা জানে, তার ক্ষমতা আছে একটা মেয়েকে নষ্ট করে দেয়ার। এবং খুব সহজে।এটা তার ক্ষমতা, তার পুরুষত্ব।মিনমিনে হলে তো মান নেই, দশ বারোটা মেয়েকে ব্যবহার করতে না পারলে বন্ধুমহলে দাম নেই। "
এইভাবে আমরা পাওয়ার এক্সারসাইজকে সামাজিকভাবে বৈধতা দিচ্ছি এবং এহেন ঘটনার কোন অভিযোগ এলে আগে মেয়েদের কাঁধে সব দোষ চাপিয়ে দিয়ে, আরেহ বয়সকালে ছেলেরা এগুলো করেই- এসব বলে মামলা ডিসমিস করে দিচ্ছি। তাই এই সমাজে মেয়েদের হ্যারাজ করা কোন অপরাধ না। শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ব্যবসায়ী, শিক্ষক কেউ বাদ নেই। ফেসবুকে তারকার পেজে কমেন্ট বক্স থেকে পত্রিকার সংবাদ- সবখানেই মা তুলে গালাগালি। যেকোন ধর্ষিত নারী বিচার চাইতে গিয়ে দ্বিতীয়বার ধর্ষিত হয় সমাজের কাছে, তার কি কাপড় ঠিক ছিল, মেয়ের কি চরিত্র ভালো, সে ঐসময়, ঐখানে একা গেল কেন?, নাহ এর মধ্যে নিশ্চয়ই সমস্যা আছে, মেয়েদের কাজ ঘরে বসে থাকা, বাইরে বের হবে কেন- ব্যস, শুরু হয়ে গেল সামাজিক ধর্ষণ। এমনকি একাত্তরের পাকিস্তানীদের হাতে ধর্ষিত নারীরাও রেহাই পাইনি, হালের মেয়েরা কোন ছাড়! দেজ থিংগস আর দিস কমন ইন দিস কান্ট্রি!
এই শাস্তির বিষয়ে আরেকটা কথা মনে পড়ল। পুজাতে মেয়েদের গায়ে হাত দেয়া এক অভয়ারণ্য। সেখানে আশেপাশে যদি ধরেন, তখন রিকুয়েস্ট আসবে ছেড়ে দেন দুইটা থাপ্পড় মেরে। 'ছোট মানুষ'। সাকিব যখন তার বউয়ের উত্যক্তকারীকে পিটিয়েছিল, আমরাই তাকে বেয়াদব বলে গালাগাল করেছি! আইনের চেয়ে বড় হল সমাজ কিভাবে দেখে। আইনের বাস্তবায়নের জন্যই তা জরুরি। আমাদের সবার নিজ নিজ জায়গা থেকে সমাজের এই 'ডগমা' গুলোকে চ্যালেঞ্জ করা উচিত।
আজ এই ডগমাগুলো আপনি লালন করছেন বলেই, আপনি হাজারে হাজারে হ্যারাজমেন্টকারী তৈরি করছেন। এর একটা অংশ তো সুযোগ পেলেই টিজ করবে, মেয়েদের শরীরে হাত দিবে। পাব্লিক প্লেসে সুযোগ পেলেই অপকর্ম করে বেড়াবে। আবার এদের একটা অংশ তো আলটিমেট ধর্ষক হবেই- একেবারে সিম্পল পিরামিড স্ত্র্যাকচার। তাই আপনি যখন শুরুর দিককার হ্যারাজ করাকে বয়সের দোষ মানছেন তখনই আরেকজন ধর্ষক তৈরির মঞ্চ প্রস্তুত হয়ে গেল, সে আপনি মানুন আর নাই মানুন।
তাই বলি, এই ধর্ষক হবার মঞ্চ বন্ধ করুন। হ্যারাজ করার সামাজিক ইমিউনিটি রদ করুন। মেয়েদের বেশি না, মানুষ ভাবতে শেখান। বন্ধুমহলে বাজে মন্তব্যকারীদের কোণঠাসা করুন। প্রয়োজনে পাব্লিক শেমিং করুন, তাও কিছু একটা করুন। বিশ্বাস করুন, এভাবেই চেঞ্জ আসে। আমি আপনি চাইলেই আদালতে মামলার গতি বাড়াতে পারব না, কিন্তু স্বদিচ্ছা থাকলেই নিজে সচেতন হতে পারব, অন্যকে সচেতন করতে পারব, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারব। আমাকে বলা একটা কথা আমি আমার চারপাশকে বলার চেষ্টা করি-
'তুমি যদি কোন মেয়েকে শুধুমাত্র এই কারণে হ্যারাজ না কর কারণ সেখানে আইন কড়া, তুমি ধরা পড়ে যাবে, তাইলে বুঝবে তুমি মানুষ না, পশু। হায়েনার মত লকলকে জিব বের করে অপেক্ষা করছ, ঝাঁপিয়ে পড়বে সুযোগ পেলেই!'
আসুন, নিজে মানুষ হই, সমাজকে মানুষ হবার বার্তা দেই। এটা এখন আমাদের নিজ পরিবারের নিরাপত্তার জন্যই প্রয়োজন।