একমাত্র ধর্ষণের সংবাদের নিচেই দেখবেন, ধর্ষকের প্রতি মায়া আর সহানুভূতির স্টল খুলে বসেছে একদল অকালকুষ্মাণ্ড। জানিনা ধর্ষকেরা এই অমানুষগুলোর আত্মীয় হয় কিনা, অথবা এসব কমেন্ট করে ধর্ষকদের ডিফেন্ড করার জন্য এরা টাকা পয়সা কিছু পায় কিনা...
যখনই দেশে কোন ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে আলোচনা ওঠে, খুব অবাক হয়ে আবিস্কার করি, একদল অমানুষ খুব নির্লিপ্তভাবে ভিক্টিম ব্লেমিংয়ে নেমে পড়ে। একজন নারী বা শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন, তাকে প্রাণে মেরে ফেলা হয়েছে, এমন জঘন্য ঘটনার খবরের কমেন্টবক্সে কী দেখি জানেন? দেখি সেই নারীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলতে। তার পরনের কাপড় নিয়ে প্রশ্ন তুলতে। তার চরিত্রের দিকে আঙুল তুলতে। জানিনা এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত ধর্ষকেরা এই অমানুষগুলোর আত্মীয় হয় কিনা, অথবা এসব কমেন্ট করে ধর্ষকদের ডিফেন্ড করার জন্য এরা টাকা পয়সা কিছু পায় কিনা। ধর্ষণের মতো জঘন্য কাজের সঙ্গে যে লোকটা জড়িত, তার প্রতি বাংলার মানুষের এমন মায়া কেন কাজ করে- এই প্রশ্নের কোন উত্তর খুঁজে পাই না আমি।
ঢাকার কলাবাগানে গতকাল সতেরো বছরের একটা মেয়েকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ এসেছে। মেয়েটার চার বন্ধু বা সহপাঠীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে তার মৃত্যুর সঙ্গে জড়িত সন্দেহে। হত্যাকান্ডের মূল অভিযুক্ত দিহান ইতিমধ্যেই নিজের অপরাধ স্বীকার করে জবানবন্দী দিয়েছে, আদালতে ১৬৪ ধারায় তার বয়ানও রেকর্ডও করা হয়েছে। বাকি তিনজনকে এখনও জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।
হত্যাকান্ডের শিকার কিশোরীর ময়নাতদন্ত করেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ। তিনি বলেছেন, বিকৃত ও কুরুচিপূর্ণ যৌনাচারের শিকার হয়েছিলেন সেই কিশোরী। একারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ থেকে তার মৃত্যু হয়। জিজ্ঞাসাবাদে দিহান পুলিশকে জানিয়েছে, ধর্ষণের পরিকল্পনা আগেই করা ছিলো। নিহত তরুণীর সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক ছিল বলেও দাবী করেছে আসামী। গ্রুপ স্টাডির নাম করে সেই কিশোরীকে ফোন করে কলাবাগান লেক সার্কাসের একটি বাসায় ডেকে নেয় দিহান। দুপুর ১২ টা থেকে একটার মধ্যে জোরপূর্বক ভিক্টিমকে ধর্ষণ করে সে। দুপুর একটার দিকে কিশোরীর রক্তক্ষরণ বন্ধ না হলে সে অচেতন হয়ে পড়ে কলাবাগান থানা পুলিশকে সে জানিয়েছে যে সে একাই ধর্ষণ করেছে মেয়েটিকে। তার ফোন পেয়ে বাকিরা এসেছে।
মামলাটা এখন পুলিশের হাতে, তদন্ত হবে আরও, জিজ্ঞাসাবাদও চলবে অনেক, নতুন নতুন তথ্য হয়তো বেরিয়ে আসবে ভবিষ্যতে। সেসব নিয়ে আমরা আপাতত কথা না বলি। বরং অন্য ভিক্টিম ব্লেমিং নিয়ে কথা বলি। আমরা কথা বলি ধর্ষকদের প্রতি কেন এই জাতির একটা বড় অংশের মায়া উপচে পড়ে, সেই অমীংসিত রহস্যটা নিয়ে। অভিযুক্ত যেখানে নিজের অপরাধ স্বীকার করে নিয়েছে, নিজের মুখেই বলেছে যে ধর্ষণের পরিকল্পনা তার আগে থেকেই করা ছিল- তবুও কেন 'করোনার সময় কীসের গ্রুপ স্টাডি', 'আরে এটা তো মিউচুয়াল সেক্স', 'এইসব বারোভাতারি মেয়েদের সঙ্গে এরকমই হওয়া দরকার' বা 'সতেরো বছরের মেয়ে এত নির্লজ্জ কেন, ডাকলেই বন্ধুর বাসায় কেন যাবে' টাইপের স্টেটমেন্ট কোত্থেকে আসে? কীভাবে আসে? কেন আসে?
বেশিদিন আগের কথা নয়, গত বছরের একটা ঘটনা মনে করাই। মজনু নামের এক ভবঘুরে মাতাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে কুর্মিটোলা এলাকায় ধর্ষণ করেছিল। সেই মজনুর প্রেমে যে পরিমাণ মানুষকে দিওয়ানা হতে দেখেছি, সেটা একটা অবিশ্বাস্য অভিজ্ঞতা ছিল। মজনু যখন গ্রেপ্তার হলো র্যাবের হাতে, তখন এদেশের লাখ লাখ মানুষ তাকে ধর্ষক হিসেবে বিশ্বাসই করতে পারেনি। রোগাপটকা একটা লোক, ওপরের পাটির দাঁত ভাঙ্গা- এমন কাউকে ধর্ষক হিসেবে মেনে নিতে ঘোর আপত্তি ছিল সুবে বাংলার ফেসবুক ব্যবহারকারীদের। তারা হয়তো মানসপটে ধর্ষক হিসেবে ছয় ফুট লম্বা, সিক্স প্যাক বডির হৃত্বিক রোশান টাইপের কাউকে কল্পনা করে রেখেছিল। সেটার সঙ্গে ইমেজটা মেলেনি দেখেই হয়তো মজনুর জন্য মায়া ঝরে পড়েছিল অজস্র মানুষের।
একটা ধর্ষকের প্রতি যে মানুষ এতটা ভালোবাসা জমিয়ে রাখতে পারে, সেটা মজনুর ঘটনাটা না ঘটলে জানা হতো না। তবে সেটাই শুরু বা শেষ নয়। এরকম ঘটনা এর আগেও ঘটেছে, এর পরেও ঘটবে এদেশে। একটা খুনের খবরের কমেন্টবক্সে আপনি যান, সবাইকে দেখবেন খুনির মুণ্ডুপাত করতে। একটা চাঁদাবাজি, রাহাজানি বা দেশের টাকা বিদেশে পাচারের খবরে যান, সেখানেও দেখবেন অপরাধীকে গালাগাল করছে সবাই। কিন্ত একমাত্র ধর্ষণের সংবাদেই দেখবেন, ধর্ষকের প্রতি মায়া আর প্রেমের স্টল খুলে বসেছে একদল অকালকুষ্মাণ্ড।
এরা দেখে মেয়েটার সোশ্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড কি, তার পেশা কি, ধর্ষণের সময়টা দিন ছিল নাকি রাত ছিল, ধর্ষিতার পরনে কী ছিল- সেসব বিচার বিশ্লেষণ করে খুব সুচারুভাবে দোষটা ধর্ষিতার ঘাড়ে চাপায়। তাদের ভাষাটা হয় এমন- ধর্ষণ কোনোভাবেই কাম্য নয়, কিন্ত মেয়েটারও উচিত হয়নি বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাওয়া। অর্থাৎ তারা সার্টিফিকেট দিয়ে দিচ্ছে, যে মেয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যায়, যে মেয়ে বন্ধুর বাসায় গ্রুপ স্টাডি করতে যায়, তাকে ধর্ষণ করা যাবে।
সবকিছু দেখেশুনে আমার মনে হয়েছে, ভিক্টিম ব্লেমিংয়ে বাঙালির যে পারদর্শীতা, সেটা দুনিয়ার আর কোন জাতির নেই। দুইদিন আগে এক উঠতি অভিনেত্রী ট্রাকের নিচে পিষ্ট হয়ে মারা গেলেন মিরপুরে, রাত এগারোটা বা সাড়ে এগারোটার দিকের ঘটনা। সম্ভবত প্রেমিক বা পরিচিত কারো বাইকে চড়ে বাসায় ফিরছিলেন, পথে নির্মম মৃত্যু। সেই মৃত্যু নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই, খবরের কমেন্টবক্স ভর্তি একটাই থিওরিতে- রাত এগারোটা-বারোটায় একটা মেয়ে কেন অচেনা পুরুষের সাথে বাইকে থাকবে? নিশ্চয়ই লিটনের ফ্ল্যাট থেকে 'খেলাধুলা' করে ফিরছিলো। এরকম মেয়ের মরাই উচিত। মেয়েটার মৃত্যুটা গুরুত্বপূর্ণ নয়, তাকে বহনকারী বাইকের চালক যে ভুলভাল তথ্য দিচ্ছেন সেটাও গুরুত্বপূর্ণ নয়, গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মেয়েটা কেন এত রাত অব্দি বাইরে ছিল- সেটা!
এই হচ্ছে বাঙালি যুক্তিবিদদের থিওরি। এই থিওরি কিন্ত সব জায়গায় পাবেন না, শুধু যেসব অপরাধের ক্ষেত্রে নারীরা সহিংসতার শিকার, যেমন ধর্ষণ- সেসব ক্ষেত্রেই এই আহাম্মকদের দেখা পাবেন। গ্রুপ স্টাডি করতে গেছে কেন, তাকে ধর্ষণ করা উচিত। স্টাইলিশ জামাকাপড় পরেছে কেন, তাকে ধর্ষণ করা উচিত। শাড়ি পরেছে, পেট দেখা যায় কেন, এরকম 'বেহায়া' মেয়েদের ধর্ষণ করা উচিত। সন্ধ্যার পর বাইরে বেরিয়েছে কেন, এই মেয়েকে তো ধর্ষণ করা উচিত। ছেলে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়? মাথায় টিপ পরে? পার্কে-রেস্টুরেন্টে প্রেম করতে যায়? রাত পর্যন্ত অফিসে কাজ করে? দেরী করে বাড়ি ফেরে? আরে এরা 'ভালো মেয়ে' নাকি? এরা তো রেপড হওয়ার জন্য রেডি হয়েই থাকে।
অথচ ধর্ষণের জন্য যে ধর্ষকের বিকৃত মানসিকতা আর বিচারের অভাব ছাড়া অন্য কোনোকিছুই দায়ী নয়, সেই সহজ সত্যিটা আপনি এদের কোনোভাবেই বোঝাতে পারবেন না। এই মানসিকতার ঝাঁকে ঝাঁকে পঙ্গপালের দেশে বসে যদি আপনি আশা করেন নারীরা নিরাপদে থাকবে, একদিন দেশ থেকে ধর্ষণ বিদায় নেবে- তাহলে আপনার মতো বোকাচণ্ডী এই গ্রহে আর দ্বিতীয়টি নেই।