এত সব বেআইনী কার্যক্রম চালানো, ভুলভাল করোনার রিপোর্ট দেয়া, লাইসেন্স ছাড়াই রিজেন্টের মতো হাসপাতাল পরিচালনা, এসব তো মুখের কথা নয়। কাদের ছত্রছায়ায় মোহাম্মদ সাহেদের মতো ধুরন্ধররা এমন বেপরোয়া হয়ে ওঠে?
বন্ধুদের আড্ডায় কারো মেধা বা প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে আমরা মাঝেমধ্যেই উচ্চারণ করি না, এই লোক একটা জিনিস! সেরকমই এক পিস জিনিসের সন্ধান পাওয়া গেছে গতকাল। মেধাবী, প্রতিভাবান, সুযোগের সদ্ব্যবহারকারী এই লোকটার নাম মোহাম্মদ সাহেদ। উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান তিনি। গত ছয় বছর ধরে তিনি লাইসেন্স ছাড়াই হাসপাতাল চালিয়ে আসছেন! তার এই হাসপাতালে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়ার কপথা ছিল, অথচ তিনি রোগীপ্রতি লাখ টাকা করে বিল নিয়েছেন, তারপর আবার সরকারের কাছে এক কোটি ৯৬ লাখ টাকা বিল পাঠিয়েছেন, দুইশো করোনা রোগীকে সেবা দিয়েছেন এই মর্মে।
এখানেই থেমে থাকেননি মোহাম্মদ সাহেদ, রিজেন্ট হাসপাতালে ভুয়া করোনা পরীক্ষা করে প্রায় ৪২০০ রোগীকে ভুল রেজাল্ট দেয়া হয়েছে। এতসব মহান কর্মসাধনের পরেও পুলিশ তাকে ছুঁতে পারেনি, ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে তিনি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে নিজেকে নির্দোষ দাবী করে চলেছেন! এই লোককে ট্যালেন্ট না বললে ট্যালেন্ট শব্দটাকেই তো অপমান করা হয়!
এতসব গোমর ফাঁস হয়েছে গতকাল। বেলা দুইটা থেকে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলমের নেতৃত্বে একটি দল প্রথমে উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর সড়কে অবস্থিত রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযান চালায়। সেখান থেকে আটজনকে আটকের পর র্যাবের দলটি মিরপুরে রিজেন্টের অন্য শাখায় অভিযান পরিচালনা করে। তারপর বেরিয়ে আসে থলের বেড়াল, কিংবা কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে খুঁজে পাওয়া গেল আজদাহা অজগর!
অভিযান চলার সময় র্যাবের ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, রিজেন্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তিন ধরনের অভিযোগ ও অপরাধের প্রমাণ তারা পেয়েছেন। প্রথমত, তারা করোনার নমুনা পরীক্ষা না করে ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করত। এ ধরনের ১৪টি অভিযোগ র্যাবের কাছে জমা পড়ে, যার পরিপ্রেক্ষিতে এই অভিযান।
দ্বিতীয়ত, হাসপাতালটির সঙ্গে সরকারের চুক্তি ছিল ভর্তি রোগীদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার। সরকার এই ব্যয় বহন করবে। কিন্তু তারা রোগীপ্রতি লক্ষাধিক টাকা বিল আদায় করেছে (এ সময় সারোয়ার আলম গণমাধ্যমকর্মীদের বিলের নথি দেখান)। পাশাপাশি রোগীদের বিনা মূল্যে চিকিৎসা দিয়েছে- এই মর্মে সরকারের কাছে ১ কোটি ৯৬ লাখ টাকার বেশি বিল জমা দেয়। সারোয়ার আলম বলেন, রিজেন্ট হাসপাতাল এপর্যন্ত শ দুয়েক কোভিড রোগীর চিকিৎসা দিয়েছে।
সারোয়ার আলমের ব্রিফিং থেকে আরও জানা যায়, রিজেন্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তৃতীয় অপরাধ হলো সরকারের সঙ্গে চুক্তি ছিল ভর্তি রোগীদের তারা কোভিড পরীক্ষা করবে বিনা মূল্যে। কিন্তু তারা আইইডিসিআর, আইটিএইচ ও নিপসম থেকে ৪ হাজার ২০০ রোগীর বিনা মূল্যে নমুনা পরীক্ষা করিয়ে এনেছে।
সারোয়ার আলম আরও বলেছেন, অভিযানে দেখা গেছে, রিজেন্ট হাসপাতালের লাইসেন্স ২০১৪ সালে শেষ হয়ে গিয়েছে। এরপর আর লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি। কীভাবে সরকার এমন একটি হাসপাতালের সঙ্গে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা চুক্তিতে গেল, তা খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
চিন্তা করুন গোটা ব্যাপারটা। ঢাকার বুকে বড়সড় একটা হাসপাতাল তাদের কয়েকটা ব্রাঞ্চ চালাচ্ছে, শত শত রোগী প্রতিদিন সেবা নিচ্ছে, কোটি কোটি টাকার ব্যবসা করছে তারা, অথচ সেই হাসপাতালের লাইসেন্সের কিনা মেয়াদই নেই! এবং এটা একদিন দুইদিনের ব্যাপার নয়, এই তামাশা চলছে গত ছয় বছর ধরে। র্যাবের অভিযানটা গতকাল না হলে এভাবেই চলতো সবকিছু, নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে।
সবকিছু ম্যানেজ করে এতসব বেআইনী কার্যক্রম চালানো, রিজেন্টের মতো হাসপাতাল পরিচালনা, এসব তো মুখের কথা নয়। মোহাম্মদ সাহেদ নামের ধুরন্ধর ব্যক্তিটি এই কাজই করে আসছেন বছরের পর বছর ধরে। কাজেই তিনি যে ভীষণ কর্মপটু, তাতে কোন সন্দেহ নেই। এখানেই কিন্ত তার প্রতিভার শেষ নয়, হাসপাতালে র্যাব অভিযান চালাতে পারে, এমন আশংকায় অভিযানের দুইদিন আগেই তিনি থানায় গিয়ে জিডি করেছেন, বলেছেন, তার সুনাম নষ্ট করার জন্য নাকি কে বা কারা তার নাম ব্যবহার করে অপকর্ম করছেন!
প্রথম আলোর খবরে পড়লাম, মোহাম্মদ সাহেদ নিজেকে নির্দোষ দাবী করে তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। সেটা অবশ্য যুদ্ধাপরাধী গোলাম আজম বা সাঈদীও করেছে, সব অপরাধীই করে। সাহেদ সাহেব বলেছেন, তিনি ভুয়া পরীক্ষার ব্যাপারে কিছুই জানেন না। তিনি ষড়যন্ত্রের শিকার। এ নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। এত নাটক সাজানোর পরেও যদি মোহাম্মদ সাহেদের মতো এমন দুর্লভ প্রতিভার পরিচর্যা আমরা করতে না পারি, সেটা জাতি হিসেবে আমাদেরই ব্যর্থতা।
গতকাল থেকে সোশ্যাল মিডিয়াতে একটা ছবি ভাইরাল হয়েছে। সেই ছবিতে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যানের সাথে দেখা যাচ্ছে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সচিব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, পরিচালক (যার কাজ বেসরকারী হাসপাতালগুলোর লাইসেন্সের ব্যাপারগুলো দেখাশোনা করা) সবাইকে। ছবিটা দেখে অবাক হইনি। মোহাম্মদ সাহেদের মতো লোকেরা কোত্থেকে এত বাটপারি করার সাহস পায়, কিভাবে পায়, সেটা তো কারো অজানা নয়। ওপরের আশীর্বাদ না থাকলে কোটি কোটি টাকার এমন দুই নম্বুরি, সাধারণ মানুষকে এভাবে ঠকানোটা যে অসম্ভব, সেটা পাগলও বোঝে।
একদিকে মানুষ চিকিৎসা না পেয়ে মরছে, করোনা পরীক্ষার নেগেটিভ সার্টিফিকেট না থাকায় অন্য রোগের চিকিৎসাও করাতে পারছে না অজস্র রোগী। হাসপাতালের সামনে ছোট্ট সন্তানকে বুকে নিয়ে বসে আছেন মা, তার বিশ্বাস হচ্ছে না, এভাবে একটা অসুস্থ বাচ্চাকে কেউ চিকিৎসা না দিয়ে ফিরিয়ে দিতে পারে! আমরা সেসব ছবি দেখছি, হাহুতাশ করছি। তারপর চোখে পড়ছে মোহাম্মদ সাহেদের হাস্যোজ্জ্বল ছবি, তার পাশে মন্ত্রী-সচিব-মহাপরিচালক, সবাই হাসছেন। সেই হাসিতে মিশে থাকে জনগনের প্রতি বিদ্রুপ আর বিতৃষ্ণা, সেটা আমরা দেখেও চুপ করে থাকি। চুপ করে বসে থাকা ছাড়া আমাদের কিছু করারও নেই বোধহয়...