বিডিআর বিদ্রোহের পর হায়দার হোসেন গান লিখেছিলেন, 'নির্মমতা কত দূর হলে, জাতি হবে নির্লজ্জ'
দু-তিন দিন ধরে কেন জানি এই একটা লাইন বারবার কানে বাজে। যতবার রিজেন্ট হাসপাতালের মাফিয়া শাহেদের একেকটা কুকীর্তির খবর আসে মিডিয়ায়, যতবার হেভিওয়েট রাজনীতিবীদদের সাথে তার ছবি দেখি এবং যখন তার ব্যক্তিগত ফেসবুক প্রোফাইলটি থেকে ঢুঁ মেরে আসি, প্রত্যেকবার এই লাইনটা শেল হয়ে বুকে আঘাত করে।
ইচ্ছে করে একবার সুপ্রিম কোর্টের সামনে গিয়ে চিৎকার করে বলি, শাহেদের বিচার করার ক্ষমতা কি নেই হে বিচারালয়? ইচ্ছে করে মিন্টো রোডের বিখ্যাত কার্যালয়টার পাশে গিয়ে হাঁক ছেড়ে বলি, শাহেদকে কেন গ্রেফতার করা যায় না হে নিরাপত্তা বাহিনী? ভীষণ ইচ্ছে করে গণভবন নামক প্রাসাদের রাজফটকে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলি, এই লোকটাকে যথাযোগ্য শাস্তি দেবার মতো শক্ত হাত কি আপনার নেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী?
এই লোক কী অপরাধ করেছে এই প্রশ্ন করার চেয়ে কী অপরাধ করেনি সেটা বললেই বরং উত্তর ছোটো হয়। এই লোকের ঠাণ্ডা মাথার অপরাধ, করোনার ফলস রিপোর্ট দেয়ার কারণে দেশে ফিরে আসতে হলো ১২৫ জন ইতালি প্রবাসীকে। ইতালির পত্রিকার হেডলাইনে চলে এলো বাংলাদেশ, ব্যান করা হলো বাংলাদেশী ফ্লাইট। ইতালির পাশাপাশি চীন, সাউথ কোরিয়া ও জাপানও ব্যান করে রেখেছে বাংলাদেশকে।
কত ভয়ানক এই তথ্য কেউ কি বুঝতে পারছেন না? এক ঘরে হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। দুনিয়া জুড়ে প্রচার হয়ে গেছে আমাদের অপকর্ম। বাংলাদেশ থেকে করোনা নেগেটিভ সার্টিফিকেট নিয়ে ইতালি যাওয়া লোকদের মধ্যে ৭০% কেই পজেটিভ শনাক্ত করা হয়েছে। পুরো পৃথিবী জেনে গেছে, বাংলাদেশীরা মিথ্যাবাদী। এদের বিশ্বাস করা যায় না। দেশের ভাবমূর্তিকে মাটিচাপা দেয়া এবং হাজার হাজার প্রবাসীদের পরিবারের রুটি রুজিকে হুমকির মুখে ফেলা দেয়ার একটা অপরাধেই তো শাহেদকে ধরে ক্রসফায়ারে দিয়ে দেয়া যায়।
অথচ আমরা কী দেখতে পাচ্ছি, শাহেদকে ক্রসফায়ার দূরে থাক, গ্রেফতার পর্যন্ত আজও করা হচ্ছে না। লোকটা স্ত্রীকে ফোন করে জানাচ্ছে, 'যেখানে আছি, সেইফ আছি।' এই চার শব্দ যেন নিছক শব্দ না, ভুক্তভোগী মানুষ ও ১৮ কোটি জনতার প্রতি নির্মম রসিকতা। এই চার শব্দের ফ্রেমের ভেতর বন্দি হয়ে যায় প্রশাসন, আদালত, সংবিধান। (আমি মোটেও ক্রসফায়ার নীতির পক্ষে না। কিন্তু আমরা জানি এই দেশে খুব স্বল্প অপরাধ কিংবা অধিকাংশ সময়ে বিনা অপরাধে প্রচুর ক্রসফায়ার করা হচ্ছে। এই সেন্স থেকে এখানে ক্রসফায়ারের প্রসঙ্গ তোলা।)
এই লোক কেবল করোনার ফলস রিপোর্ট তৈরি করা এবং টিপিক্যাল লুটপাটে সীমাবদ্ধ থাকলে তাও একটা কথা ছিল। কিন্তু আমরা ক্রমশ দেখলাম এক ম্যানিয়াকের কীর্তিকলাপ। শাহেদের এক অধস্তন কর্মকর্তার নাম ছিল আরিফুর রহমান সোহাগ। সোহাগ নামের ভদ্রলোক শাহেদের বিভৎস চেহারা দেখে বিবেকের তাড়নায় চাকরি ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন। শাহেদ চাকরি ছাড়তে দেয়নি। বেচারা সোহাগ অবশেষে দেশ ছেড়েই মালয়েশিয়া পালিয়ে গেলেন।
তাতেও রক্ষা হলো না। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের হস্তক্ষেপে সোহাগকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসে শাহেদ। সোহাগ তো বটেই, সোহাগের বাবা ও ভাইও রক্ষা পেলেন না এই ম্যানিয়াকের মামলা ও নির্যাতন থেকে। পয়েন্ট টু বি নোটেড মাই লর্ড, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নাম ভাঙানো!
বিবেকের দায়ে প্রাণ নিয়ে মালয়েশিয়া যাওয়া লোকটা ও তার পরিবারের ওপর এই যে নির্মমতা, সেটা কি কেউই জানত না? প্রশাসন? পুলিশ? রাজনীতিবিদ? কেউই জানত না? এটা বিশ্বাস করতে বলেন? আচ্ছা বাদ দিলাম আরিফুর রহমান সোহাগকে। গাড়ি ড্রাইভার ভাড়া করে রাস্তার নিরীহ পথচারীদের উপর গাড়ি তুলে দিয়ে আহত করা এবং জোর করে রিজেন্টে ভর্তি করিয়ে মোটা অংকের বিল আদায় করার যে লোমহর্ষক ঘটনা, এটাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
এই লোকটা নিছক ক্রিমিনাল না, এই লোক সাইকোপ্যাথ। টাকার পাহাড় করার অনেক অনেক রাস্তা আছে এই দেশে। কিন্তু রাস্তার পথচারীকে আহত করে তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তিতে বাধ্য করে টাকা আদায়...অবিশ্বাস্য নির্মমতা।
আচ্ছা আপনি কি বলবেন এসব ঘটনাও কেউ জানত না? কেউই না? লোকটার ফেসবুক প্রোফাইলে গিয়েছেন আপনি? যদি না যান, প্লিজ একবার চেক করে আসুন এই সাইকোপ্যাথের অনলাইন জগত। চমকে যাবেন আপনি। না না, হাইপ্রোফাইল লোকের সাথে তার ছবির কথা আমি বলছি না। এমন জঘন্যদের সাথে হাইপ্রোফাইলরা না মিশে কি আমাদের সাথে মিশবে? আমি বিস্মিত হয়েছি তার লেখা পড়ে।
অনলাইনের মো. শাহেদ একজন জনদরদী মানুষ। এই শাহেদ করোনা বিষয়ে সচেতন করার জন্য প্রতিদিন পোস্ট দিয়েছে। এই শাহেদ তার হাসপাতাল থেকে রোগী রিলিজের সময় ডাক্তার-নার্সকে দিয়ে স্ট্যান্ডিং অভিয়েশন করিয়েছে। রাস্তায় বসে থাকা পাগলকে খাবার ও চিকিৎসা দিয়েছে শাহেদ। এই শাহেদই তার স্কুলের শিক্ষার্থীদের বেতন মওকুফ করে দিয়েছে। এই প্রতারক, মাফিয়া, ম্যানিয়াক দুর্নীতির দায়ে বহিষ্কৃত ঢাকা সিটির দুই ইঞ্জিনিয়ার নিয়ে মক করেছে। এদের শিকড় উৎপাঠনের আহবান জানিয়েছে।
শাহেদ টক শো করেছে দেদারসে। দুনীতির বিরুদ্ধে অভিযান চলাকালীন সময়ে টিভিতে দীপ্ত স্বরে হুংকার দিয়ে বলেছে, জননেত্রীর দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে কারো ছাড় নেই। শেখ হাসিনার দেশে কেউ ছাড় পাবে না। কোনোভাবেই না। ব্যাপক আড়ম্বরপূর্ণ তার এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ডের খবর কেউ জানত না বলে আমাকে বিশ্বাস করতে বলেন? এই লোকটার কোনো খুঁটির জোর না থাকাতে টিভিতে হুংকার ছেড়ে কথা বলতে পেরেছে সেটা মেনে নিতে বলেন আমাকে?
আচ্ছা মেনেই নিলাম আপনার কথা। মেনে নিলাম প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাথে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না। আরিফুর রহমান সোহাগ হিপনোটাইজড হয়ে দেশে এসে শাহেদের হাতে ধরা খেয়েছে। মেনে নিলাম সোহাগের মতো করে আরও অনেকটা টর্চার করার যে সব ছবি অনলাইনে ভেসে বেড়াচ্ছে সেটা নিয়েও কেউ জানত না। মেনেই নিলাম আমাদের গোয়েন্দা বাহিনী খুব খুব খুব দুর্বল বলে তার অপকর্ম ব্যাপারে কিচ্ছু জানতে পারেনি। তারা পাপিয়া নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেয়া যুবক বা প্রধানমন্ত্রী নিয়ে পোস্ট দেয়া কিশোরকে ডিজিটাল আইনে গ্রেফতার করার ব্যস্ততায় এদিকে সময় দিতে পারেনি।
এখন তো সবাই সবই জানে। তাও কেন গ্রেফতার হচ্ছে না এই সাইকোপ্যাথ? কার ভরসায় সে স্ত্রীকে বলতে পারে, 'যেখানে আছি ভালো আছি'?....
নাকি এখনো বিশ্বাস করতে বলবেন গোয়েন্দারা তাকে ট্রেস করতে পারছে না? বাতাসে মিশে গিয়ে স্ত্রীর কানে কানে এসে সেইফ থাকার কথা বলেছে বলে ট্র্যাক করা যায়নি? নাকি ইন্ডিয়ান সিরিয়ালের মতো করে লোকটা প্লাস্টিক সার্জারি করে চেহারা পাল্টে নিয়েছে?
মহামান্য রাজ্যসভা, বিশ্বাস করেন শাহেদের পাপের ভার এই দেশ নিতে পারবে না। ইতালি প্রবাসী পরিবারগুলোর আশংকা-অনিশ্চয়তার ওজন আছে। দেশ এক ঘরে হয়ে গেলে যাদের চুলায় ভাত বসবে না তাদের ক্ষিদের ভার আছে। সোহাগদের মতো যারা শাহেদের টর্চার সেলে নির্যাতিত হয়েছে, তাদের কান্নার অভিশাপ আছে। রাস্তায় নিশ্চিতে হাঁটতে থাকা যে মানুষগুলো পঙ্গু হয়েছে, আহত হয়েছে তাদের আর্তনাদের মূল্য আছে।
শাহেদকে বাঁচিয়ে রাখার যে পাপ, সেটা করতে একটুও বুক কাঁপে না... যাদেরকে বলছি সেই মহামানবেরা? নির্মমতাকে আর কত দূর টেনে নিতে হবে? কতখানি নির্লজ্জ হতে হবে পুরো জাতিকে?
শাহেদকে গ্রেফতার করুন, বিচার করুন। আইওয়াশ বিচার না, সত্যিকারের বিচার। যারা তার সাথে গায়ে গা, গলায় গলা, হাত হাত, মাথায় মাথা রেখে ছবি তুলেছেন...লজ্জা থাকলে পাবলিকলি লজ্জিত হোন।
আর না হলে আমাদেরকে ছোট্ট একটা সুযোগ দিন। লজ্জা-ঘেন্না-অপমান-ক্ষোভে আমরা একবেলা গণভবন কিংবা সুপ্রিম কোর্টের গেটের সামনে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদতে চাই। এই অভিশপ্ত দেশে জন্ম নেয়ার পাপে আমাদেরকে এক বেলা কাঁদতে দেবেন, প্লিজ?
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন
যোগ দিন 'এগিয়ে চলো বাংলাদেশ' ফেসবুক গ্রুপে
আরও পড়ুন-