কত হাজার বছর ধরে গঙ্গার সমপরিমাণ প্রবাহের মতন সমান তালে এই উপমহাদেশে রক্ত বয়ে যাচ্ছে। হাজার হাজার বছর পেরিয়ে এসেও লড়ছি এখনো ধর্মের নাম করে, আসলে ধর্মের নাম যদি শান্তি হয়, ধর্মের বাণী যদি অহিংস হয়, তবে কেন এত উগ্রশক্তির দম্ভ? কার তরে এই লড়াই? কিসের জন্য হত্যা-খুনোখুনি! 

প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠেই দেখতে হয়, শুনতে হয়- ধর্মের গায়ে আঘাত লেগেছে, তাই এই হয়েছে, ওই হয়েছে, মানবদেহ নিথর হয়ে রাজপথে পড়ে রয়েছে। এসব দেখেও কিছু বলি না, এসব কিছু বোঝার মতন বোধগম্য কাউকেও দেখি না, সকলে স্বার্থের তরবারি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কিন্তু আর নয়, এবার আমাদের বলতে হবে, বুঝতে হবে, সত্য ন্যায় আর শান্তির পথে এগোতে হবে। যার জন্য এই লড়াই, যাদের জন্য এই লড়াই- তাদের ঘোর কাটাতে আজ এগিয়ে আসতে হবে। ধর্ম বা ধর্মীয় অনুভূতিতে যে আঘাত লেগেছে বলে এত ধ্বংস, এত প্রাণের বলি, এত ভেদাভেদ, এত বিদ্বেষ, এত হানাহানি, এসব কেন? কাদের জন্য?

বিশ্বের প্রতিটি প্রতিষ্ঠিত ধর্মই তাদের মূল বক্তব্যে হানাহানির বিরোধিতা করে এবং শান্তিকে প্রতিনিধিত্ব করে। তবে কেন প্রাচীনকাল থেকে আজকের এই বর্তমান বিশ্বেও ধর্মীয় পতাকা ব্যবহার করে লাখ লাখ প্রাণ কেড়ে নেওয়া, সমাজে শান্তির বদলে অশান্তি প্রতিস্থাপন করা, মাজহাব তরিকার কথা বলে হানাহানি বাঁধিয়ে দেওয়া, জাত-পাতের দোহাই দিয়ে প্রাণ নিয়ে নেওয়া, গরু না ছাগল উত্তম বলে শহরের পর শহর জ্বালিয়ে দেওয়া? 

কারো ঢাকের সুরে খুন চাপে আর কারো আজানের সুরে। কারো বাইবেল সেরা, আবার কারো কোরানই সর্বশ্রেষ্ঠ। এসব নিয়ে এখনো মানুষ নিজেরা নিজেদের প্রাণ নিচ্ছে, আবার জোর করে উদবাস্তু করে দিচ্ছে। এগুলো তো হবার কথা ছিল না কখনো, শিক্ষা এবং মূল্যবোধের এত বিকাশের পরে তো এসব হতে পারে না।

কেন এখনো ধর্মের নামে এত হিংসা ছড়ানো হয়? কেন ধর্মের নামে বন্ধু শত্রুতে পরিণত হয়? কেন ধর্মের নাম মুখে আনলেই মেরে ফেলতে হয়? কাদের আসলে ধর্মের ভাবমূর্তি নিয়ে এত ভয়? ধর্ম তো ঈশ্বরের, তবে সেদিক থেকে তা রক্ষার দায় এবং দ্বায়িত্ব উনারই। মানুষকে রক্ষা করতে বলা হয়েছে নিজেদের ব্যক্তিগত ঈমান এবং আমল, তবে আপনারা কার কথায় নিজেদের ধর্ম-কর্মের মূল বিষয়বস্তু বাদ দিয়ে ঈশ্বরের ধর্ম রক্ষায় নাক গলাচ্ছেন? কে আপনারা, আপনাদের তো এত খবরদারি করার কথা ঈশ্বর বলে দেননি!

ও, আচ্ছা! ধর্মীয় নেতার নামে এগুলো করছেন। তা এই ধর্মীয় গুরু-নেতা-পাদ্রী-পোপ-আলেম-ওলামা-পীরবাবা; তারা কি ধর্মের মালিক, নাকি ঈশ্বর  স্বয়ং ধর্মরক্ষার ইজারা দিয়েছেন তাঁদের? এরা স্বার্থান্বেষী উগ্রবাদী ভন্ড লোভী। তাদের ইশারায় নেচে আরেকজনের জান নিতে গিয়ে যে মহাপাপ করছেন, তারপরেও আপনারা নিজেদের সত্যিকারের ধার্মিক কী করে পরিচয় দেন!

ধরে নিলাম এসকল উগ্রবাদীরা মুখোশ পরে ধর্মের নামে ফায়দা লুটছে, কিন্তু এত আধুনিক যুগে থেকেও কোনো কিছু নিরপেক্ষভাবে যাচাই না করে অন্ধের মতো কেন বিশ্বাস করছেন, অবিবেচকের মতো কেন একপক্ষের কথাই শুনছেন! এরা তো কোনো ঈশ্বর প্রেরিত পুরুষ নন, তবে কেন এত পুরোনো বাজে অতীত ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও এসকল ভন্ড প্রতারকদের পাতা ফাঁদে পা দিচ্ছেন? কেন একবার বোঝার চেষ্টা করছেন না যে, ধর্মের গায়ে কখনো কেউ আঘাত দিতে পারে না এবং যে সত্যিকার ধার্মিক, তাঁর আঘাত লাগেও না। কারণ ধর্ম একটি নির্জলা অদৃশ্য অশরীরী বিশ্বাস।

কোনো ধর্মের বইতে কি বলা আছে অন্য ধর্মের মানুষকে আলাদা চোখে দেখো, কোথায় বলা আছে কেউ তোমার ধর্মের নামে বাজে কথা বললে তার ধর থেকে মস্তক ফেলে দাও, কোথায় বলা আছে কারো কাপড়-চোপর আমাদের ধর্মীয় বিধান মতো না হলে তাকে ধর্ষণ করে দাও! কোন ধর্মে বলা আছে গায়ের জোরে উম্মত-ভক্ত-সন্তান বৃদ্ধি করো! কোথাও মূলত এরকম লেখা নেই, আর যদি থাকে, তবে সেটা তার সঠিক দিক থেকে বিকৃত করে নেওয়া।

আচ্ছা, তবে যদি কেউ আপনার ধর্ম নিয়ে সমালোচনা করেই থাকে, তবে কি তাতে আপনার ধর্ম ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে নষ্ট হয়ে যাবে? কেউ বা কারো লিখায় কিংবা কারো ধর্মেরই কিছু আসবে-যাবে না। তবে আপনাদের দিয়ে ধর্মের নামে দাঙ্গা-হাঙ্গামা-খুন-লুটপাট-রাহাজানি করিয়ে পীর-ফকির-ওলামা-গুরু-নেতাদের অনেকটা ফায়দা হয়ে যাবে। ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্য কেন আন্দোলন করতে হবে? হিন্দুবাদী রাষ্ট্র গঠনের জন্য কেন মুসলিম তাড়াতে হবে? কেন কোনো রাষ্ট্রের নিয়ম-কানুন কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের মতেই হতে হবে কেন? যেখানে নানান মতের মানুষ, সেখানে কেন সংখ্যাগরিষ্ঠ আইন পাস করতে হবে? 

প্রকৃতপক্ষে আমরা অনেক সধারণ মানুষ এসব ভেদাভেদ চাই না, আমাদেরকে ধর্মের ভুল অপব্যাখ্যা শুনিয়ে, একদল সবসময় আমাদের দ্বারা তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করিয়ে নিচ্ছে।আর বর্তমানে এত কষ্ট করতে হচ্ছে না উগ্রবাদীদের তারা তাদের অনুসারীদের মাঝে সেই যে দীর্ঘকাল আগে প্রতিহিংসার বীজ বুনে দিয়েছিল, তা এখন আপনা আপনি গাছ হয়ে ফল দিচ্ছে, আগুন দিচ্ছে, ভাঙচুর করছে, গলা কাটছে। এই পৃথিবীটা আমাদের সবার, কিছু মানুষ ধর্মের নামে নিজেদের সম্রাজ্য গড়ার জন্য যে নোংরামি করে এবং কু-শিক্ষায় অন্ধ করে জাতিগত বিদ্বেষ ছড়িয়ে হাজারো মায়ের বুক খালি করছে তা সুস্থ মস্তিষ্কে হতে দেয়া যায় না। আজকে মুসলমানও আমাদের, হিন্দুরাও আমাদের, বৌদ্ধরাও আমাদের, ইহুদীও আমাদের, এবং যারা কোন নির্দিষ্ট ধর্মে বিশ্বাস করে না, সেই নাস্তিকরাও আমাদের পৃথিবীর সন্তান। তাই প্রতিবাদ হিসেবে আমরা কারো প্রাণ নিতে পারি না। কারো কথা, লেখা, চিন্তার জন্য তাকে হত্যা করতে পারি না। যদি একান্তই প্রতিবাদ করতে হয়, তবে তা সুস্থ কথা দিয়ে করুন, তরবারি আর হাত-পা দিয়ে প্রতিবাদ কোনো দিক দিয়েই সভ্য কিংবা মনুষ্যত্বের প্রতীক নয়।

যেমন কেউ শিব বা দেবী দূর্গাকে নিয়ে কটাক্ষ করলেই কি তাকে মেরে ফেলতে হবে, তারা এই দ্বায়িত্ব তাদের ভক্তদের দেননি। কারো আবার হযরত মুহাম্মদ (সা) কে ভালো না-ই লাগতে পারে, আর সে লোক যদি নবীকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে তার জন্য তার উম্মতরা কে ভাই সেই লোকটার গলা কেটে দেওয়ার? যীশু খ্রিস্টের মান অপমানের বিচার করার জন্য কোনো ক্যাথলিক ব্যাপ্টিস্ট দল উনি বানিয়ে যাননি। স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ যেখানে অহিংস পথকে নির্বাণলাভের পথ বলে গেছেন, উনার অনুসারী গুন্ডা মঙ্কদের কার্যক্রম তো সেটা বলে না। 

লেখাটা আবুল মনসুর আহমেদ এর 'আয়না' উপন্যাসের কয়েকটি কথোপকথন দিয়েই শেষ করি, "হাজি সাহেব আপনি পিতৃতুল্য আপনার কাছে গোপনীয় কিছু নাই। আহলে হাদিসের মত প্রচার করতে গিয়ে আমি বাজারের মামুলি পন্থা অবলম্বন করতে চাইনে। আপনি জানেন, আমি খ্রিস্টান মিশনারীদের প্রচার প্রণালী বহুদিন ধরে অধ্যায়ন করে আসছি। এ বিষয়ে আমি তাদের নীতিই শ্রেষ্ঠ বলে মনে করি। উদারতার ছদ্মবেশে সাম্প্রদায়িক মতবাদ প্রচারেই সাফল্যের আশা অধিক..."                                    


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা