মানুষ হয়ে সৃষ্টিকর্তার হিসেব-নিকেশ করতে যাবেন না, প্লিজ!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
ওই বয়েসে এত কিছু বুঝতাম না। তবে একটা কথা শুনেছিলাম ওই ছোট বয়সেই- আমরা সংখ্যায় কম, আমরা দুর্বল।
গ্রামের বাড়িতে বিদ্যুৎ থাকতো না অধিকাংশ সময়ই। বাইরে অন্ধকার হয়ে সন্ধ্যে নামার মুখেই কারেন্ট চলে যেতো, ফিরে আসতে আসতে রাত দশটা-এগারোটা। ঠিক দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম, কারেন্ট আসার। এরপরও না এলে ভাত খেতে বসে যেতাম। অল্পকিছু দিনের জন্যে বেড়াতে গিয়ে সারাদিন এদিক-সেদিক লাফালাফির পর সন্ধ্যে বেলাতেই খিদে খিদে ভাব চলে আসতো। সে হিসেবে রাত দশটা অনেক রাত।
সন্ধ্যা থেকে রাত দশটা-এগারোটা পর্যন্ত সময় কাটানো খুব সহজ ব্যাপার না। বিশেষ করে সেই সময়ে টিভি ছিল না সারা গ্রামের কোথাও। কোথাও মোবাইল ফোন ছিলো না- যে সময়ের কথা বলছি, তখন।
আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, তখন একঘেয়েমি বলতেও কিছু ছিলো না। এইযে তিন-চার ঘন্টা সময়, আমরা খেলতাম, ছুটতাম। ছেলেবেলায় গ্রামের বাড়ি কখনো গিয়ে থাকলে বুঝবেন, আর যা কিছুরই অভাব হোক- সেখানে বাচ্চার অভাব নেই! আপনি যে বয়সের চাইবেন, ঠিক সেই বয়সের পাঁচ-ছটা ছেলেমেয়ে আপনার বাড়ির আশেপাশে অধিকাংশ সময়ই থাকবে। আমি আমার কাছাকাছি বয়সী বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতাম। তিন-চার ঘন্টা, প্রতিদিন। অধিকাংশই মুসলমান, সম্ভবত সবই। সম্ভবত, কারণ এখনও ঠিক জানি না, তাদের ধর্ম কী ছিলো। সত্যি বলতে জানার প্রয়োজন মনে হয় নি তখন, এখনও; এমনকি কখনোই না।
আমি শুধু জানতাম, এ হলো রনি- এ ঠিকমতো গোসল করে না, এর গায়ে গন্ধ। আমি জানতাম, এ টিনা, এই মেয়ে অল্প কিছু হলেই কাঁদে, এর সঙ্গে খেলতে গিয়ে কোনোভাবেই ব্যথা দেয়া যাবে না। ব্যস, এইটুকুই। কে মুসলিম, কে হিন্দু, কে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ছে, কে সকাল-সন্ধ্যা মন্দিরে পূজো করছে এসব জানতাম না; জানার কথা মাথায় আসেনি তখন, কখনো। এসব কিছু না জেনে, না বুঝে এত সুখী ছিলাম- এখন কেউ কল্পনা করতে পারবেন না। বিশ্বাস করবেন কিনা, জানি না; কেবল আমি নই- সকলেই এত সুখে ছিলো, ভালো ছিলো।
এরপর, ধীরে ধীরে বড় হচ্ছি তখন। ঢাকায় যে বাসায় ভাড়া থাকতাম, তার নিচে গ্যারেজের পাশে খেলার একটু জায়গা ছিলো। খেলতাম বিকেলে প্রায়ই। কয়েকজনের সঙ্গে। একদিন এক ছেলে একটু ব্যথা পেল। আমার হাতে ব্যাট ছিল। বল ছুটে আসতে দেখে ব্যাটটা পেছনের দিকে নিয়ে সজোরে চালাবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। সেই পেছনে নিতে গিয়েই উইকেট কিপার হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটার কপালে একটু লাগলো। ফুলে গেল খানিকটা। যারা ছোটবেলায় খেলেছেন, তারা জানেন- খেলতে গিয়ে ব্যথা লাগাটা অস্বাভাবিক কিছু না। প্রায়ই লাগে, সেরেও যায়।
তবে ছেলেটির পরিবারের আচরণ অস্বাভাবিক ছিলো। ছেলেটির বাসার এক কর্মচারী, যার কাজ ছিল ওকে দেখাশোনা করা- সে বললো, 'এরা এই বাসায় ক্যামনে থাকে, আমি দেইখ্যা নিব।' এক কর্মচারী তার মালিকের ছেলের সঙ্গে খেলার সাথীকে এই কথা বলেছে, ভাবতে পারেন?
ওই বয়েসে এত কিছু বুঝতাম না। তবে একটা কথা শুনেছিলাম ওই ছোট বয়সেই- আমরা সংখ্যায় কম, আমরা দুর্বল। আমি বুঝতাম না, আমরা কারা, আর ওরা কারা। পার্থক্যটা ঠিক কী? আমরা দুর্বল কেন হব? ওরা সবলই বা কেন? আর সংখ্যাটাই বা কিসের? এখন বুঝি। বড় হবার সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই বুঝতে হয়। কিন্তু আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, না বোঝার দিনগুলো বড় ভালো। সত্যিই ভালো। এই সংখ্যার কম-বেশি, দুর্বল-সবলের রেষারেষি এসব কখনোই ভালো হতে পারে না।
সৃষ্টিকর্তা কখনো এই রেষারেষিতে খুশি হন না। আপনার সৃষ্টিকর্তা না, আমারও না। বিশ্বাস করেন ভাইলোক, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ির কিচ্ছু নাই। এই বাড়াবাড়ি আল্লাহ পছন্দ করেন না, ঈশ্বর না, গডও না। আপনার ধর্ম পালন আপনি করেন। অন্য কেউ মন চাইলে করবে, না চাইলে করবে না। আপনার বেহেশত আপনি পাবেন, অন্যের দোজখ অন্যে পাবে।
আপনি একটা নিয়ম মানেন, অমুকে মানে না- এর মানে এই না- তারে ফাঁসির আওতায় নিয়ে আসবেন। আপনি এই 'ঈমানী' দায়িত্ব পালন করবার কেউ না।
এইটা পুরোটা আল্লাহর হিসাব-নিকাশ। আপনি মানুষ হয়ে এই হিসাব-নিকাশ করতে যাবেন না প্লিজ। গুলিয়ে ফেলবেন।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন