রে মিস্টেরিও তার 'মিস্টেরিয়াস' মুখোশের আড়ালের রুপটাকে লুকিয়ে রাখার জন্য কম চেষ্টা করেননি। প্রায়ই মনে হয়, তিনি দেখতে কেমন আসলে যদি দেখা যেত?

রে মিস্টেরিও, রেসলিং জগতের অন্যতম চেনা মুখ। নাকি ভুল বললাম? তার মুখ চেনার তো উপায় নেই। কারণ, তিনি সর্বদাই মুখোশ পড়ে থাকেন। তার বিখ্যাত সেই মুখোশের জন্যই তাকে আলাদাভাবে মনে থাকে। রেসলিংপ্রেমীদের কাছে রে মিস্টেরিও ভীষণ জনপ্রিয় একজন রেসলার।

তার স্পেশাল একটা মুভ আছে, সিক্স ওয়ান নাইন নামে। এইরকম স্বতন্ত্র মুভ খুব কম রেসলারেরই থাকে। প্রতিদ্বন্দ্বী রেসলার রেসলিং রিংয়ের দড়ির মধ্যে মুখ থুবড়ে থাকেন। রে মিস্টেরিও ওপাশ থেকে দৌঁড়ে এসে দুইটি দঁড়ি শরীর বাঁকিয়ে ঘুরিয়ে যে কিকটা করেন সেটাই "সিক্স ওয়ান নাইন" মুভ নামে পরিচিত।

রেসলিং এবং রে মিস্টেরিওকে যারা একবার হলেও দেখেছেন, তারা নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন এতক্ষণে কোন স্টাইলটির কথা বলছি! রে মিস্টেরিও তার 'মিস্টেরিয়াস' মুখোশের আড়ালের রুপটাকে লুকিয়ে রাখার জন্য কম চেষ্টা করেননি। প্রায়ই মনে হয়, তিনি দেখতে কেমন আসলে যদি দেখা যেত?

রে মিস্টেরিও'র চরম ভক্ত হওয়া স্বত্তেও অনেকেই মনে মনে চেয়েছে, রে মিস্টেরিওর প্রতিদ্বন্দ্বী রেসলার যদি একবার তার মুখোশটা খুলে দিতো? মুখোশের আড়ালে কে দিনের পর দিন রে মিস্টেরিও হয়ে রেসলিংয়ের রিংয়ে খেলে যাচ্ছে সেটা জানার কৌতূহল কম লোকের না।

অল্প কিছুবার রে মিস্টেরিওর মুখোশ খোলার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু, কাজটা মোটেও সহজ নয়। দুই একবার মুখোশ যা খোলা হয়েছে তাতে রে মিস্টেরিও'র সম্পূর্ণ মুখমণ্ডল দেখা যায় না।

২০১৮ সালে ঘটে যাওয়া একটা উদাহরণই বলি। রেসলিং জগতে আরেক সুপারহিট রেসলার র‍্যান্ডি অরটন স্ম্যাকডাউন লাইভে ম্যাচ খেলেছেন রে মিস্টেরিওর বিপক্ষে। ম্যাচের শেষে র‍্যান্ডি বেশ এগ্রিসিভ মূর্তি ধারণ করেন। তিনি একপর্যায়ে চেয়ারের ফাঁকে রে মিস্টেরিওর মাথা আটকে ফেলে টেনে বের করে ফেলেন রে মিস্টেরিওর সেই বিখ্যাত মুখোশ!

রে মিস্টেরিও

যদিও রে মিস্টেরিওর চেহারা দেখা যায়নি। ক্যামেরা তার মুখের দিকে নেওয়া হয়নি। তিনি নিজেও দুই হাত দিয়ে তার মুখমণ্ডল ঢেকে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকেন। কিন্তু, এই মুখোশের আড়ালে রে মিস্টেরিও দেখতে কেমন? ব্যাক্তিগত জীবনে তিনি কেমন মানুষ? আসুন এই উত্তরগুলো খোঁজার চেষ্টা করা যাক।

রে মিস্টেরিও রিং নেইম হলেও এই ভদ্রলোকের আসল নাম হচ্ছে অস্কার গুটিরেজ। জন্মেছিলেন ক্যালিফোর্নিয়ায়, ১৯৭৪ সালে। মাত্র ১৪ বছর বয়সে তিনি রেসলিংয়ে নামেন। এজন্যে তাকে যেতে হয় মেক্সিকোতে। কারণ, এমেরিকায় এত কম বয়সে রেসলিং করার লাইসেন্স দেয়া হয়না কাউকে।

মেক্সিকোতে তার রিং নেইম ছিল 'কলিব্রি'। হামিংবার্ডের অন্য নামই কলিব্রি৷ যাইহোক, ১৮ বছর বয়স থেকে তিনি তার রে মিস্টেরিও জুনিয়র নামটি ব্যবহার করতে শুরু করেন। নামের শেষে জুনিয়র থাকার কারণ হলো, একই নামে তার এক চাচা ছিলেন যিনি আবার রেসলিং ট্রেনারও বটে। যদিও পরবর্তীতে তিনি নামের শেষের জুনিয়র অংশটুকু বাদ দিয়ে স্রেফ 'রে মিস্টেরিও' নাম ধারণ করেন।

আজকের দিনে সবাই রে মিস্টেরিও নামেই তাকে চেনে। তার উচ্চতা খুব বেশি না, একজন রেসলার হিসেবে নিতান্তই কম। মাত্র পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি। ওজনও খুব বেশি না। তবুও তিনি সমানে সমানে লড়ে যেতেন অন্যসব হেভিওয়েট রেসলারদের কাছে।

তার মুখোশ পড়া জিমিক এবং তার উড়ন্ত সব মুভের জন্য খুব দ্রুতই তার ফ্যানবেস তৈরি হয়ে যায়। তিনি সেইসব বিরল রেসলারদের একজন যাকে শিশু থেকে বুড়ো সবাই পছন্দ করে। ব্যাক্তিজীবনে তিনি বিবাহিত। দুই সন্তানের জনক। পারিবারিকভাবে তিনি মোটামুটি সুখী একজন মানুষ। অর্থনৈতিকভাবেও রে মিস্টেরিওর পরিবার বেশ ধনী।

তবে শারিরীক গড়ণের জন্যে তাকে খানিকটা সমস্যায় পড়তে হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। নাম তার অস্কার গুটিরেজ, কিন্তু রেসলিংয়ে তিনি আসবেন এটা নির্ধারণ হয় রে মিস্টেরিও নামক তার এক চাচার সান্নিধ্যে থাকার পরই। সে চাচা ট্রেনার এবং তার কাছ থেকেই তিনি বিশেষ মুখোশটি যেটা পরে তিনি পরবর্তী জীবনে খেলেন, সেটা সম্পর্কে জানতে পারেন।

তার কাছে এই মুখোশটা অনেকটা নিজেকে লুকিয়ে অন্য একটা কাল্পনিক জগতে ডুবে থাকার মতো ব্যাপার। 

যাই হোক, ১৯৯৫ সালে তার অভিষেক হয় ECWতে (এক্সট্রিম চ্যাম্পিয়নশিপ রেসলিং)। সেইসময় এই ECW তে খুব আক্রমণাত্মক রেসলিং খেলা হতো। এমনকি সেইবছরই ইসিডব্লিউ এরিনায় একজন রেসলার মারাও যায়। যাইহোক, এরপর তিনি যোগ দেন WCW কোম্পানিতে (ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ রেসলিং)। এখানে তিনি অল্পদিনে প্রধান রেসলারদের একজন হয়ে উঠেন।

এই কোম্পানিতে থাকাকালেই বেশ অনেকগুলো বিখ্যাত ম্যাচে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এখানে তিনি আন্ডারডগ হিসেবে প্রমোটেড হন। বড় বড় নামগুলোর বিপক্ষে তার জয় আসতে থাকে। কেবিন নাশ নামক সেইসময়ের বিখ্যাত এক রেসলারের বিরুদ্ধেও তার জয় সেটাই প্রমাণ করে।

এছাড়া, এডি গেরেরো, সাইকোসিস, আলটিমো ড্রাগন ইত্যাদি রেসলারদের বিরুদ্ধেও অসাধারণ কিছু ম্যাচ খেলেছেন রে মিস্টেরিও। WCW তে থাকার সময়ই রে মিস্টেরিও তার বেশভূষা, পোষাক, মুখোশ, ফ্যানদের সাথে সম্পর্ক সব কিছু মিলিয়ে দারুণ জনপ্রিয় হন।

কিন্তু, তার এমন আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার পরেও কোম্পানির প্রেসিডেন্ট এরিক বিশপ রে মিস্টেরিওকে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ ম্যাচ খেলার স্লটে প্রমোট করতে অস্বীকৃতি জানান। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, মিস্টেরিওর উচ্চতা কম, তার গ্রহণযোগ্যতা কম ইত্যাদি। বরং, রে মিস্টেরিওকে একটি অপমানজনক ম্যাচ খেলতে বাধ্য করা হয়।

একটি ম্যাচের আয়োজন করা হয়, যেখানে শর্ত থাকে রে মিস্টেরিও হেরে গেলে তার মুখোশ খুলে ফেলতে হবে! রে মিস্টেরিওকে সেই ম্যাচ হেরে যেতে বলা হয়। যথারীতি ম্যাচ হেরে রে মিস্টেরিও তার মুখোশটি খুলতে বাধ্য হন। মুখোশের আড়ালে সবাই দেখে ফেলে নিষ্পাপ দেখতে এক তরুণ রে মিস্টেরিওকে।

এটা ১৯৯৮ সালের ঘটনা।  ২০০২ সালের দিকে রে মিস্টেরিও আসেন সবচাইতে জনপ্রিয় রেসলিং কোম্পানি WWE তে (ওয়ার্ল্ড রেসলিং এন্টারটেইনমেন্ট)। এখানে একটা ঘটনা আছে। এই কোম্পানিতে রে মিস্টেরিওকে বলা হয়, আবার মুখোশ পড়া জিমিক নেয়ার জন্য।

কিন্তু, রে মিস্টেরিও যেই মুখোশটা পড়ে আগের কোম্পানিতে খেলেছেন, এই মুখোশটার একটা প্রেস্টিজিয়াস ব্যাপার আছে। যারা এই মুখোশটি পড়েন তাদের এই মুখোশটিকে বলা হয় "লুচা লিবরে" মুখোশ। এই মুখোশ দেয়ার জন্য একটা প্রতিষ্ঠানও আছে মেক্সিকোতে।

কিন্তু, যারা এই মুখোশটি একবার খুলে ফেলে তাদের জরিমানা হয় এবং দ্বিতীয়বার মুখোশ পায় না সাধারণত। রে মিস্টেরিও অবশ্য মেক্সিকোতে গেলে মুখোশ পড়তেন না ওইসময়টায়। পরে ২০০৬ এর দিকে মুখোশ পড়া শুরু করেন। তবে WWEতে তাকে মুখোশ পরে খেলতে দেখা যায়।

তিনি এই কোম্পানির স্ম্যাকডাউনে ক্যারিয়ার শুরু করেন। প্রথমেই তার ফিউড হয় লিজেন্ডারি রেসলার কার্ট এংগেলের সাথে! ২০০৫ সালের দিকে এডি গেরেরোর সাথে টিম হিসেবে খেলে ট্যাগ টিম চ্যাম্পিয়নশিপ অর্জন করেন রে মিস্টেরিও।

রে মিস্টেরিও

অবশ্য রেসলিংয়ে বেশিদিন ট্যাগ টিম থাকে না এবং বেশিরভাগ সময় দেখা যায়, নিজের টিম ম্যাটের সাথেই পরে গিয়ে লড়াই শুরু হয়ে যায়। এখানেও একই ঘটনা ঘটলো। এডি গেরেরোর সাথে টিম ভেঙ্গে গেল এবং তারপর ভয়ানক ফিউড চললো কিছুদিন।

২০০৫ এর সামারস্ল্যামে রে মিস্টেরিও এডি গেরেরোকে ল্যাডার ম্যাচে হারিয়ে দেয়ার পর এই ফিউড মোটামুটি শেষ হয়। এডি গেরেরোর কথা কেন টেনে আনলাম? কারণ, এডি গেরেরো সেই রেসলার যার সম্মানে রে মিস্টেরিও নিজের মুখোশ খুলে শ্রদ্ধা দেখায়।

২০০৫ সালের অক্টোবরে একদিন হোটেল রুমের মধ্যে দেখা যায়, এডি গেরেরো শুয়ে আছেন, মৃত। এডি গেরেরোর রহস্যজনক আচমকা মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে আসে রেসলিং এরিনায়। রে মিস্টেরিও রিংয়ে এডি সম্পর্কে ইমোশনাল স্পিচ দেন এবং তার সম্মানে নিজের মুখোশ খুলে শ্রদ্ধা দেখান।

যদিও তিনি মাথা এমনভাবে নিচু করে রেখেছিলেন যে, তার মুখ কেউ দেখতে পায়নি৷।

২০০৬ সাল ছিল রে মিস্টেরিওর জন্য সাফল্যের এক বছর। এই বছর তিনি রয়েল রাম্বল ম্যাচ জিতেন, যেখানে তাকে অনেক দীর্ঘ সময় ধরে রিংয়ে টিকে থাকতে হয়েছিল। প্রায় এক ঘন্টার মতো।

সেই একই বছর তিনি সবচেয়ে খাটো এবং কম ওজন সম্পন্ন ব্যাক্তি হিসেবে জিতে নেন ওয়ার্ল্ড হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপ। যাইহোক, WWE তে থাকাকালীন সবগুলো ম্যাচই তিনি খেলেছেন মুখোশ পড়ে। যদিও কয়েকবারই তার মুখোশ খুলে নেয়ার চেষ্টা করেছে তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা।

কিন্তু, কেউ তার মুখ পুরোপুরি দেখতে পারেনি। সর্বশেষ, র‍্যান্ডি অরটন এই সপ্তাহে তার মুখোশ খুলে নেন। কিন্তু, তিনি দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাখায় তার মুখমণ্ডল দেখা সম্ভব হয়নি। ২০১৫ সাল পর্যন্ত তিনি WWE কোম্পানিতে ছিলেন। তারপর চলে যান। অনেকে ভেবেছিল এটাই শেষ, রে মিস্টেরিও আর ফিরে আসবেন না ওয়ার্ল্ড রেসলিং এন্টারটেইনমেন্ট কোম্পানিতে।

কারণ, এখান থেকে বেরিয়ে তিনি মেক্সিকোর এক রেসলিং কোম্পানিতে যোগ দেন। সবাই কিছুটা আফসোস করে তার জন্য বিশেষ করে যারা নিয়মিত রেসলিং দেখেন তার মিস্টেরিওর আইকনিক মুভগুলোকে মিস করে ভীষণ। যাইহোক, সকলে যখন প্রায় ভুলে যেতে বসেছিল রে মিস্টেরিওর কথা, ঠিক তখনই তিনি আবার সারপ্রাইজ দিয়ে ফিরে আসেন এবছর, রয়েল রাম্বলে। এখন তিনি স্ম্যাকডাউনে খেলছেন।

রে মিস্টেরিও রেসলিংকে ভীষণ এন্টারটেইনিং করেছেন। যখন থেকে রেসলিং দেখি, তখন থেকে এই ভদ্রলোকের রেসলিং মুভগুলো আলাদা করে নজর কাড়ে চোখে। এরকম হাই ফ্লাইং মুভ, এত স্বতন্ত্র খেলার স্টাইল খুব কমই পাওয়া যায়।

তার মুখোশের আড়ালে থাকা চেহারা লুকিয়ে দিনের পর দিন তিনি নিজের প্রতি আকর্ষণটা ধরে রেখেছেন, একটা সাস্পেন্স রেখেছেন, এটাও তো কম অর্জন নয়। মিস্টার 'সিক্স ওয়ান নাইন' রে মিস্টেরিও কতদিন আর থাকবেন রেসলিং রিংয়ে তার নিশ্চয়তা নেই, তিন দশক ধরে তো খেলে যাচ্ছেন। আর কত! তবে, তিনি অবশ্যই থাকবেন রেসলিংপ্রেমীদের মনে, বিশেষ করে আমাদেরকে শৈশবে আনন্দ এবং রেসলিং দিয়ে বিনোদিত করার জন্যে হলেও তাকে মনে পড়বে! 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা