রিকশা আর্ট: বাংলাদেশের যে ঐতিহ্য ক্রমশ বিলুপ্তির পথে হাঁটছে!
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
একটা সময় প্রতিবাদ, সচেতনতা ও বিনোদনের নানা উপাদান ফুটে উঠতো রিকশার শরীরে। এককালের সেই বর্ণময় ঐতিহ্য সময়ের পাকচক্রে আজ মৃতপ্রায়। সরকারেরও নেই তাদের নিয়ে কোনো মাথাব্যথা...
'রিকশা' নামক বাহনটির জন্মস্থান যতই জাপানে হয়ে থাকুক না কেন, যতই 'রিকশা একটি জাপানি শব্দ' বলে বলে আমরা বিসিএসের সাধারণ জ্ঞান মুখস্ত করি না কেন, রিকশা কে আপন করে অধিকার করতে পেরেছি আমরাই৷ প্রখ্যাত লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর 'হাজার চুরাশি মা' উপন্যাসের একটি লাইন আমার বেশ প্রিয়-
দেয়ালে শ্লোগান তো সবাই লিখতে পারে। কিন্তু সে শ্লোগান বুকে ধারণ করতে পারে ক'জন?
তেমনিই রিকশার উৎপত্তি, ব্যুৎপত্তি, বিন্যাসের মানচিত্র নিয়ে আমরা হাজারো শব্দব্যয় করলেও সব শেষে গিয়ে এটাই ঠিক- বাংলাদেশই রিকশার আদি ও অকৃত্রিম আপনজন।
একসময়ের তুমুল গুরুত্বপূর্ণ বাহন 'পালকি'র বিকল্প হিসেবে আসা রিকশা এই উপমহাদেশে কম হাওয়াবদলের সাক্ষী নয়। প্রথম দিকের দু'চাকার রিকশা, মানুষে টানা যে রিকশাকে ডাকা হতো টানাগাড়ি; ছিলো কলকাতার এক বিস্ময়। তবে বাংলাদেশে রিকশায় আসতে আসতে সেটি হয়ে যায় পায়ে-চালিত। এখন তো রিকশায় ব্যাটারি-ইঞ্জিন-লাইট দিয়ে খুব একটা বাড়াবাড়ি অবস্থাই হয়ে গিয়েছে। মানে, রিকশায় অবয়বটাই শুধু থেকে গিয়েছে। রিকশায় উঠে বসলে রিক্সাচালকের প্যাডেলের সাথে সাথে মৃদু দুলুনি এখন আর টের পাওয়া যায় না। শীতের সন্ধ্যায় মফস্বলের মেঠোপথ দিয়ে রিকশা যাচ্ছে, দুইপাশে ঝিঁঝিপোকার কোরাস, আর রিক্সার নীচে দুলছে একটি ছোট্ট হ্যারিকেন, যার ভৌতিক আলোয় ঠাহর করে করে যাচ্ছে রিকশা... এ অনুভূতিগুলো প্রাচীন হলেও অপার্থিব। সময় যত পাল্টেছে, অপার্থিব অনুভূতিগুলো কমেছে। রিকশার আঙ্গিক আর কাঠামোগত বহু পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু এত পরিবর্তনের মধ্যেও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে রূপান্তর, সেটিই চোখে পড়েনি অনেকের।
রিকশা থেকে হারিয়ে গিয়েছে রিকশা-আর্ট। পঞ্চাশের দশকে যখন রিকশা এসেছে এ দেশে, তখন রিকশার প্রসারের পাশাপাশি জন্ম নিয়েছিলো আরেকটি পেশা; রিকশা-আর্টিস্ট। এই শিল্পী মানুষেরা রিকশাকেই বানিয়েছিলেন তাদের সচেতনতার, প্রতিবাদের, বিনোদনের ক্যানভ্যাস। কী না আঁকা হতো রিকশা-দেহে! সিনেমা, জীব-বৈচিত্র্য, মুক্তিযুদ্ধ, জীবনযাপন...সবকিছু তুলির ডগায় ফুটে উঠতো রিকশায়। একটা সময়ে সিনেমাহলের যারা পোস্টার আঁকতো, তাদের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। কারণ, প্রিন্টিং প্রেসেই তখন খুব অল্পসময়ে সিনেমার পোস্টার প্রিন্ট করা যাচ্ছিলো। তাই সিনেমার পোস্টার-শিল্পীদের রুটিরুজির সংস্থান বন্ধ হয়ে যায় এক ধাক্কায়। এই পোস্টার-আর্টিস্ট'রা তখন রিকশা-আর্ট এর পেশার সাথে যুক্ত হওয়া শুরু করেন। তখন রিকশা আর্টিস্টদের সোনালী সময় যাচ্ছে।
মাঝখানে একবার রিকশায় সিনেমার ছবি আঁকা নিষিদ্ধ করা হয়। সেই নিষেধাজ্ঞা পরে কেটে যায় আবার। যেসব সিনেমা একটু নামডাক করতো, আর্টিস্টেরা সেই সিনেমার বিভিন্ন টুকরো টুকরো দৃশ্য নিয়ে এঁকে ফেলতেন রিকশায়। একেকটা রিকশা হয়ে যেতো একেক খণ্ড সিনেমা, মুক্তিযুদ্ধ, সুন্দরবন অথবা আমাদের আশেপাশ।
সময়ের পরিক্রমায় সেই রিকশা-শিল্পীরা এখন আর রিকশায় ছবি আঁকছেন না। অনেকেই পেশা পরিবর্তন করেছেন। রিকশায় আজকাল প্রিন্ট করা ছবি লাগানো হচ্ছে বিস্তর। আমরা নিজেরাও ভুলে গিয়েছি রিকশা-আর্টের কথা। এখন আমাদের গন্তব্য বেড়েছে, সময় কমেছে, তাকিয়ে কিছু লক্ষ্য করার ফুরসতও নেই আর। সারাদিন রিকশা-আর্ট করে একজন রিকশা-আর্টিস্ট পান খুবই কম পারিশ্রমিক, স্বাভাবিকভাবেই তাই তারা সরে যাচ্ছেন এই পেশা থেকে। বর্তমানে হাতে গোনা অল্পকিছু মানুষ যুক্ত আছেন রিকশা-আর্ট পেশার সাথে সরাসরি। এর বাইরেও কিছু রিকশা-আর্টিস্ট আছেন, যারা এখনো আঁকছেন এই ছবিগুলো, কিন্তু তা রিকশার জন্যে না। ছবিগুলো এঁকে তারা ছড়িয়ে দিচ্ছেন দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তে, বিভিন্ন মাধ্যমে।
এরকমই এক মাধ্যম; ‘Rickshaw art in Bangladesh’ নামে একটি ওয়েবসাইট। যে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে দেশের রিকশা আর্ট গুলোকে বিক্রি করা হচ্ছে। ৯০-১০০ ডলারে এখানে বিভিন্ন আকারের রিকশা-আর্ট বিক্রি করা হয়। মূলত বিদেশের ক্রেতারাই এই আর্টগুলো নিয়মিত কিনছেন এই সাইট থেকে। এই উদ্যোগের সাথে যুক্ত আছেন কিছু রিকশা-আর্টিস্টও। তারা মোটামুটি ভালো আয় করছেন রিকশার আর্টগুলো এখানে বিক্রি করে। বিভিন্ন স্রোতে রূপান্তরিত ও পরিবর্তিত হয়ে ঠিক এভাবেই টিকে আছে এই শিল্প। তবে এভাবে আর কতদিন টিকবে এই শিল্প ও শিল্পীরা... প্রশ্নবোধক চিহ্ন এখানেই।
প্রযুক্তি ও যান্ত্রিক নগরায়নের গুঁতোগুঁতিতে রিকশা আর কতদিন অমলিন থাকবে এই ধূলোমলিন নগরে, জানা নেই কারো। রিকশা-আর্ট তো এখনই বিলুপ্তিরই পথে। একটি জিনিস খেয়াল করে দেখলে বিস্মিত লাগে, শৈশবে যে জিনিসগুলো আঁকড়ে ধরে বড় হয়েছি আমরা, সেই জিনিসগুলোই আমাদের সাথে সাথে আর বড় হতে না পেরে বেমালুম হারিয়ে গিয়েছে। আমাদের শৈশবের এক বড়সড় অংশজুড়েই ছিলো রিকশা। মাঝেমধ্যে ভাবলে অবাক হই, সামনে হয়তো এমন প্রজন্ম আসবে যারা এক রিক্সায় তিনজন চড়ে বসার সেই ঠাসাঠাসি রোমাঞ্চটুকু পাবেনা। প্রেমিকার সাথে হুডতোলা রিক্সায় সলজ্জ প্রেমের অনুভূতিটুকু তাদের জন্যে হয়ে থাকবে রূপকথা। এগুলো চিন্তা করলে হতাশাবোধে আক্রান্ত হই। মনে হয়, শিরোনামহীনের গানের ঐ লাইনটাই সত্যি-
নগরের প্রিয় চিরকুট সব জীবন ছেড়ে পালায়
প্রিয় প্রিয় চিরকুটগুলো আর রাখতে পারছি কই? ক্রমশই পালিয়ে যাচ্ছে তারা। নাগালের বাইরে। অসীমের ভেতরে। এটাই কী বাস্তবতা? হয়তো।
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন