ছেলেটা বললো, 'আব্বা নাই। আব্বায় মারা গেছে।' - আর কেউ নাই? - মা আছে শুধু। ১২ বছর বয়সী ছেলেটার রিকশার চাকায় চলছে তার পরিবার।

খেয়াল করিনি প্রথমে। পেছন থেকে ডাক দিলাম, ভাই যাবেন? বাসাবো? রিকশাওয়ালা পেছনে ঘুরে তাকাতেই, আমি থ! আমি খুব দ্রুতই জিজ্ঞেস করলাম, রিকশা আপনার, মানে আপনিই চালাবেন? সে বললো, হ উডেন। অবাক হওয়ার কারণ হলো, যাকে আমি আপনি আপনি করে বলছি সে অনেক ছোট, দেখতে মনে হচ্ছে নিতান্তই শিশু, বয়স হবে ৯/১০ বড়জোর।

আমি একবার ভাবলাম, উঠবো না এই ছেলের রিকশায়। সে এক্সিডেন্ট করে ফেলবে এমন কোনো ভয়ের কারণে না, আমি উঠবো না একারণে যে ব্যাপারটা কি এথিক্যাল হবে কি না এই ভেবে। কিন্তু, মনে হলো, ছেলেটার গল্প জানা দরকার। আমি না চড়লেও কেউ না কেউ ঠিকই চড়বে তার রিকশায়। আমার কেন যেন খুব কৌতূহল হচ্ছিল, ছেলেটা কী কারণে এত অল্পবয়সে রিকশা চালাচ্ছে জানতে ইচ্ছে করছে।

যেখান থেকে রিকশায় উঠেছি, মানিকনগর, সেখানে আমি নিজেই থাকতাম ২০১৫ সাল পর্যন্ত। প্রথমে জিজ্ঞেস করে জানলাম, ছেলেটা সেই এলাকাতেই থাকে। তার রিকশার গ্যারেজ, মানিকনগর উনিশ কাঠা বালুর মাঠের ওইদিকে। জেনে নিশ্চিন্ত হলাম, তার সাথে পরে আবার যোগাযোগ করা যাবে এই ভেবে। এইদিকে একজন ছেলেটাকে দেখে বললো, ওই শালা রিকশা চালাস ক্যান, তোরে তো পুলিশে ধরাই দেওনের কাম।

ছেলেটা জবাব দিলো না। সে নিজের মতো করে রিকশা চালাচ্ছে। মাঝে মধ্যে ছোট খাটো গালিও দিচ্ছে। 'ওই শালা বামে চাপা' টাইপ গালি। মানিকনগর থেকে বাসাবো খুব বেশি দূর না। তাই কী জিজ্ঞেস করবো ভেবে ইতস্তত লাগছিলো। যদি আমার কথায় অপমানিত হয় ছেলেটা, কিংবা কষ্ট পায় তাহলে আমার খারাপ লাগবে অনেক। রিকশা জ্যামে দাঁড়িয়েছে একটু। সবাই কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছেলেটার দিকে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, 'ভাই আপনি কতদিন ধরে রিকশা চালান?'

ছেলেটা আমার অনেক ছোট, কিন্তু প্রথমে আপনি বলেছি, তাই সেটাই রক্ষা করে আপনি করেই তাকে সম্ভোধন করলাম। এইটুকু বয়সে তার কর্মও তাকে এমনিতেই একটু বাড়তি মর্যাদা দেয়ার জায়গা করে দিয়েছে। 'দুই বছর।' ছেলেটা জবাব দিয়ে জানালো সে দুই বছর ধরে রিকশা চালায়! আমি শুনে রীতিমতো হতভম্ব। একটা এইটুকুন ছেলে দুইবছর ধরে রিকশা চালায়, কীভাবে সম্ভব! এখন তাহলে তার বয়স কত?

জিজ্ঞেস করার পর এক কথায় উত্তর আসলো, ১২! এখন ছেলেটার বারো বছর বয়স চলে। তারমানে ১০ বছর বয়স থেকে সে রিকশা চালাচ্ছে। খুব স্বল্পভাষী সে। কথা বলেই বোঝা যায়, নিজের সম্পর্কে খুব বেশি প্রকাশ করতে চায় না সহজে৷ শুধু আমাকে একবার বললো, 'ভাই শইলডা কাহিল লাগে। হেই দুপুরে বাইর হইসি..' কী বলেন! আপনি এতক্ষণ টানা রিকশা চালাইছেন? কতক্ষণ চালান প্রতিদিন? জবাব দিলো, 'মাঝে মইধ্যে সকালেও বাইর হই, সারাদিন চালাই। আইজকা দুপুরে বাইর হইসি, আরো চালামু৷'

কষ্ট হয় না? রিকশাটা অটোরিকশা। প্যাডেল মারতে হয় না, কিন্তু তবুও কষ্ট হবার কথা। জানতে চাইলাম। সে জবাব দিলো, 'কষ্ট হয়। কিছু করণের নাই। না চালাইলে সব থাইমা থাহে।' এই ছেলের পরিবারে কেউ নেই বোঝা যাচ্ছে। ব্যাক্তিগত প্রশ্ন করবো কি না দ্বিধায় আছি। কিন্তু, তবুও আমার কৌতূহল- এই বয়সী একটা ছেলেকে এভাবে রাতদিন রিকশা চালাতে হচ্ছে, কিন্তু কেন! বললাম, ভাই আপনার পরিবারে কে কে আছে? আপনার আব্বা কী করে? 

ছেলেটা বললো, 'আব্বা নাই। আব্বায় মারা গেছে।' - আর কেউ নাই? - মা আছে শুধু। ১২ বছর বয়সী ছেলেটার রিকশার চাকায় চলছে তার পরিবার। আমি প্রথমেই একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, পড়ালেখা করেন? ছেলেটা বলেছিল, না। এক দুই শব্দে জবাব দেয়া তার অভ্যাস। বাসার কাছাকাছি চলে এসেছি প্রায়। আমি বললাম, আপনার পড়ালেখা করতে ইচ্ছা হয়? 

সে শুধু মাথা ঝাঁকালো। মানে ইচ্ছে হয়। আমি বললাম, কেউ যদি আপনারে পড়ালেখার খরচ দেয়, তাহলে কি পড়বেন? উত্তর দিলো, 'পড়ালেখার সুযোগ পাইলে রিকশাই বেইচা দিমু...' আমি আর সারাটা পথ কথা বলতে পারলাম না। পথ বাকি ছিল অল্পই। একটা ছেলে, রিকশা চালাচ্ছে। সে হয়ত দেখে তার রিকশাতেই তার বয়সী শিশুদের নিয়ে বাবা-মা স্কুলে যাচ্ছে। যাওয়ার সময় বাচ্চাকে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। পড়ালেখা মন দিয়ে করতে হবে টাইপ আদরমাখা শাসন করে দিচ্ছে।

জীবনের মতোই অন্ধকার যে ছবি


এই ছেলেটার রিকশাতেই তো কত বাবা মা চড়ে, তাদের নিজেদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে ভাবতে দিনরাত একাকার হয়। এসব মানুষকে দেখলে কি এই ১২ বছর বয়সী ছেলেটার বাবাকে মনে পড়ে? মনে পড়ে কি তার এখন স্কুলে যাওয়ার বয়স, দূরের স্কুল হলে সে নিজেই রিকশায় চড়ে যেতো। কী পরিহাস! তাকে এখন রিকশা চালাতে হচ্ছে।

তাই, যখন পড়ালেখার কথা বললাম, তখন স্বল্পভাষী সে ছেলেটা সবটুকু আবেগেই বলে ফেললো- পড়ালেখার সুযোগ পেলে এই রিকশাটাই সে বেঁচে দিবে! বাসার সামনে এসে যেখানে রিকশা থেমেছে, সেখানটায় জমাট বাঁধা অন্ধকার। আমি কখনোই কারো ছবি তুলে রাখি না। কারণ, মানুষের দূর্বলতা, ইমোশনকে কাজে লাগিয়ে দুই চারটা লাইক পাওয়ার ইচ্ছে আমার খুব একটা হয় না। যাকে সাহায্য করতে পারছি না, তার ছবি রেখে সমাজের প্রতি হতাশা উগড়ে দিয়ে কোনো পরিবর্তন আনা কী সম্ভব!

কিন্তু মনে হলো, এই ছেলেটার ছবি রাখা দরকার। তাকে অনুরোধ করলাম, আপনার একটা ছবি তুলতে পারি? সে নিচের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো। যার মানে হচ্ছে 'না'। ছবি তোলা যাবে না।

আমি তবুও আবার অনুরোধ করলাম, বুঝিয়ে বললাম, যদি কেউ আপনাকে সাহায্য করে, আপনি তো পড়ালেখা করবেন? 'হ্যাঁ' সূচক উত্তর এলো। তাকে জানালাম, আমি আপনার কথা লিখতে চাই। যদি কেউ সাহায্য করে তাহলে আপনার সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিবো। অতঃপর সে অনুমতি দিলো। কিন্তু, আমার ফোনে খুব ভাল ছবি উঠলো না। মোবাইলের ফ্ল্যাশটাও জ্বলছিল না অজ্ঞাত কারণে। বাস্তবতার নির্মমতায় যার জীবনটাই অন্ধকারে, তারে কি আর শখের ফোনের ফ্ল্যাশ দিয়ে আলোকিত করা যায়!


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা