যারা মনে করছেন একজন নারী দেখেই মিন্নি এই পুরুষশাসিত সমাজে ন্যায় বিচার পেলেন না কিংবা এখনও যারা মিন্নিকে নিরাপরাধ ও মাসুম বাচ্চা মনে করছেন, তাদের জন্য আমার প্রেসক্রিপশান একটাই- প্যারাসিটামল দুই বেলা!

রিফাত হত্যাকান্ডের চার্জশীট যদি কেউ একবার মন দিয়ে পড়েন, তাহলে এই বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থা কিংবা পুলিশের ভূমিকা নিয়ে আপনার যত-যাই অভিযোগ থাকুক, আমি অন্তত নিশ্চিত করে বলতে পারি 'এই মামলায় পুলিশ অসাধারণ দক্ষতা রেখেছে এবং যাকে বলে কংক্রীট প্রমাণ, তদন্তে সেটি তাঁরা  করে দেখিয়েছেন', এমনটাই আপনি বুঝতে পারবেন।

এই মামলার চার্জশীট পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, এতো ডিটেইল, এত টু দা পয়েন্ট এবং এত রিসার্চড অভিযোগপত্র খুব কম সময়ে বাংলাদেশের ফৌজদারি মামলাগুলোতে দেখা যায়। এই মামলার ক্ষেত্রে আমার মনে হয়েছে পুলিশ এতো বেশী ফোকাসড ছিলো, কোনো ধরনের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক কোনো কিছুর প্রতি পুলিশকে আমার বায়াসড মনে হয়নি। আইনজীবি হিসেবেই আমার এইসব পর্যবেক্ষণ, তা বলা বাহুল্য মাত্র।

অনেকেই বিষ্মিত হয়েছেন, বিশেষ করে যারা এই হত্যাকান্ডের পর আয়েশা ওরফে মিন্নিকে এক ধরনের দায়মুক্তি দিয়েছিলেন ফেসবুক ট্রায়াল বিচারপতির মতন। এই বিচারপতিগণ এখনো মনে করছেন মিন্নি এক ধরনের ষড়যন্ত্রের শিকার এবং এই হত্যাকান্ডে অন্য কোনো রাঘব কিংবা বোয়াল জড়িত।

কিন্তু ঐ অংশের মন ভেঙ্গে দিয়ে শুধু একটা কথাই বলব, এই মামলায় আর কোনো রাঘবও নেই, যাদবও নেই, ইদরিসও নেই কিংবা নেই আর কোনো কুতুব। মেনে নিতে কষ্ট হলে দুই বেলা প্যারাসিটামল খাবার পরামর্শ দিয়ে গেলাম।

এই খুনের ঘটনায় পুলিশ এমন কিছু তথ্য আর প্রমাণ পেয়েছিলো যেগুলো দেখানো মাত্র-ই আসামীরা আসলে আর ট্যাঁ-ফোঁ করতে পারেনি। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে মূল আসামীর সাথে অন্য আসামীর কথপোকথন, টেক্সট ইত্যাদি। বলে রাখা ভালো আসামীরা ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দিয়েছেন। মানে ঘটনার স্বীকারোক্তি করেছেন।

মিন্নি মেয়েটা এতটাই ভয়ানক যে, এই নৃশংস খুনের সময় তার যে অদ্ভুত অভিনয়, রিফাতকে রামদা থেকে বাঁচাবার সেই তীব্র অভিনয়, এটি অনেক মানুষের ভেতর দাগ ফেলে দিয়েছিলো। ফলে যারা তাৎক্ষণিক ও পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় মিন্নিকে ক্লিনচিট দিয়ে তার পক্ষে পক্ষীভূত হয়েছিলেন, তাদের যে খুব বেশী দোষ দেয়া যায় সেটিও আসলে জোর দিয়ে বলা যায়না। 

এই রায় প্রত্যাশিতই ছিল

তবে এই মামলার রায় এবং আনুষঙ্গিক ঘটনার পর এই মেয়েটির পক্ষে কথা বলাটা রীতিমত বিষ্ময়ের। এটিকে এক ধরনের ঘাঊড়ামি কিংবা ঘাড় ত্যাড়ামি ছাড়া আর অন্য কিছু বলা যায় না। একটা খুনীকে আপনি প্রথমে ভালো মনে করতেই পারেন। কারন আপনি জানতেন না। কিন্তু জানার পর, প্রমানের পর তার পক্ষে হই হই করা হচ্ছে আপনার ইগো সমস্যার প্রকাশ। মানে আপনার কথা বা স্থান মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে, কিন্তু আপনি তা বুঝেও না বুঝার হাস্যকর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এটা অন্যায়।

মামলার চার্জশীট পড়লে কিংবা এই মামলার সাক্ষ্য-গ্রহনের সংবাদ বা প্রসিডিঙ্গসের তত্ত্ব-তালাশ যারা রেখেছিলেন তাঁরা বোধকরি বুঝবেন যে আদালতের জাজ খুব সঙ্গত ও প্রত্যাশিত রায়-ই দিয়েছেন।

এক নাম্বার আসামী নয়ন বন্ডকে ইনফ্যাক্ট আমি এই মামলার একজন ভিক্টিম মনে করি কিছু কারনের জন্য। যদিও তার অপরাধ ইমেন্স এবং এটা নিশ্চিত বেঁচে থাকলে তার ফাঁসী আমার কাম্য ছিলো। কিন্তু তারপরেও আমি তাকে ইন সাম কন্টেক্সট ভিক্টিম এই কারনে বলছি যে এই মিন্নি নয়ন ছেলেটাকে ও রিফাত, দুইজনকেই দেড় বছর আগে ও পরে বিয়ে করেছিলো। 

নয়নের সাথে আয়েশার সখ্যতা জানাজানি হবার পর রিফাত হেলাল নামের এক ছেলের কাছ থেকে একটা মোবাইল ফোন কেড়ে নেয় যেই মোবাইল ফোনে একটা ভিডিও ছিলো এমন যে মিন্নি নয়নের জন্মদিনে 'প্রধান অতিথি' হিসেবে যোগদান করে ও বক্তব্য রাখে।

সভা সমাবেশে 'প্রধান অতিথি' নামক ঘটনার ব্যাপার থাকলেও জন্মদিনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি জীবনে যদিও আমি প্রথমবারের মত শুনেছিলাম। যাই হোক, সেই মোবাইল ফোন যাতে রিফাতের থেকে নিয়ে নেয়া হয় এই ব্যাপারটা মিন্নি নয়নকে দিয়ে করিয়েছিলো বা করাতে চেয়েছিলো।

মিন্নি- নয়ন ও রিফাত দুইজনের স্ত্রী থাকলেও, রিফাতের সাথে থাকতো এবং  নয়নের সাথে ঘটনায় রিফাতের সাথে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে রিফাত মিন্নির তলপেটে একটা লাথি দেয় রাগের বশবর্তী হয়ে। আর এই লাথির প্রতিশোধ নিতে গিয়েই ঘটনা শেষ পর্যন্ত গড়ায় রিফাতকে নির্মম ভাবে কুপিয়ে খুনের মধ্য দিয়ে।

এই খুনের পুরো পরিকল্পনা সময়ে মিন্নি বার বার নয়নকে তাগাদা দিয়েছে, বার বার গিয়ে ফরাজী নামের আরেকটি ছেলেকে সহ নয়নকে প্রভাবিত করেছে। এমনকি যেদিন খুনের ঘটনা ঘটবে সেদিন মিন্নি- ফরাজী ও টিকটক হৃদয় নামের দুইটি ছেলেকে কলেজের গেটে একা পেয়ে রাগান্বিত হয়ে জিজ্ঞেসও করেছিলো যে 'তোমাদের জিনিস কই? জিনিস ছাড়া কিভাবে মারবা?'

জিনিস মানে রামদা। ভাবা যায়?

শুধু তা-ই নয় এই খুনের ঘটনা ঘটবার পরে মিন্নি যখন রিফাতের সাথে হাসপাতালে যায় তখন ডাক্তার-রা রিফাতকে অন্য হাসপাতালে স্থানান্তরের কথা বললে মিন্নি সেটা করতে অস্বীকৃতি জানায়। সে বলে তার গায়ে অনেক রক্ত লেগে আছে, সে থাকতে পারবে না। এই পুরো ঘটনার সাক্ষীরাও আদালতে তাঁদের জবানবন্দী দিয়েছেন ও ডিটেইল বলেছেন।

খুনের ঘটনার পর-পর একটু সুযোগ পেয়েই মিন্নি নয়নবন্ডকে পালিয়ে যাবার যে পরামর্শ দিয়েছিলো সেটার কল রেকর্ডও পুলিশ পেয়েছে। সোজা কথা, মিন্নি একক হাতে এই হত্যাকান্ডের ঘটনাটি সাজিয়েছে, খুনীদের প্রভাবিত করেছে সময়ে সময়ে এবং এই বর্বর হত্যাকান্ডের মূল দায় মিন্নির ঘাড়েই বর্তায় এবং আদালতে তা প্রমাণিত।

এই মামলার একটা ঘটনা আমকে ব্যাথিত করেছে আর সেটি হচ্ছে নয়ন বন্ডের কথিত ক্রসফায়ার। এটি ছাড়া আমি আর মামলার অন্য কোনো সমস্যা দেখিনা।

এই বিচারের পরে যারা এখনো মনে করছেন একজন নারী দেখেই মিন্নি এই পুরুষশাসিত সমাজে ন্যায় বিচার পেলেন না কিংবা এখনও যারা মনের গহীন থেকে মিন্নিকে নিরাপরাধ ও মাসুম বাচ্চা মনে করে হাহাকার করে কাঁদছেন বা ভেতরে রক্ত ক্ষরণ যাদের হচ্ছে, তাদের জন্য আমার প্রেসক্রিপশান ঐ আগের মতন-ই।

প্যারাসিটামল দুই বেলা।

(বিঃ দ্রঃ- এই লেখার সম্পূর্ণ মতামত এবংং দায়ভার লেখকের নিজস্ব)

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা