এক ইন্টারভিউতে ঋতুপর্ণ বলেছিলেন- 'এই শহর না আমায় নিতে পারবে, না ফেলতে পারবে।' আসলেই তো, বাঙালি না ঋতুপর্ণকে পুরোপুরি আঁকড়ে ধরতে পেরেছে, না চেষ্টা করেও তাকে উপেক্ষা করতে পেরেছে...

ঋতুপর্ণ ঘোষ। এই একটা নামের সাথেই জড়িয়ে রয়েছে গতানুগতিক ধারার বিপরীতে হেটে চলার অদম্য সাহস আর সেই সাহসে ভর করে নতুনভাবে জীবনকে দেখার সুযোগ। বাংলা সিনেমাকে নতুন রূপে দর্শকের সামনে প্রকাশ করার সাহস এবং ইচ্ছা দুটোই তার মধ্যে ছিলো। বলা যায় ঋতুপর্ণ ঘোষের হাত ধরেই বাংলা চলচ্চিত্র জগত একটি নতুন দিশা খুজে পেয়েছিলো। 

সমাজের তথাকথিত সংস্কার, চিন্তাধারা, রীতি-নীতি সব কিছুকে একপাশে সরিয়ে ঋতুপর্ণ চিরচেনা সবকিছু নতুনভাবে দেখার বা বোঝার সুযোগ করে দিয়েছিলো সিনেমাপ্রেমীদের। আর এই অদেখা নতুন জগতে ডুব দিয়েছিলো দর্শকেরা যার রেশ এখনো কাটেনি হয়তো কখনো কাটবেও না। নব্বই দশকের শুরুর দিকে অথবা আরো পরিস্কার করে বললে সত্যজিৎ রায় পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গের মধ্যবিত্ত বাঙালিদের হলমুখী করেছেন তিনি। বানিজ্যের পাশাপাশি শিল্পের মানদণ্ডেও তাঁর সিনেমাগুলো একেকটা মাইলফলক। নিজের মতো করে গল্প বলার মাধ্যমে তিনি সময়কে সেলুলয়েডে বন্দী করেছেন নিপুন দক্ষতায়। 

দুই দশকের কর্মজীবনে তার নির্মিত ১৯টি সিনেমার মধ্য ১২টিই পেয়েছে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভারতের জাতীয় পুরষ্কার। তবে শুধু দেশে নয় তার নির্মানের মুন্সিয়ানা দিয়ে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরষ্কারও জিতে নিয়েছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। গল্প এবং চিত্রনাট্য নির্ভর সিনেমার প্রকৃত উদাহরন তার সিনেমাগুলো। তার সিনেমা তথাকথিত বানিজ্যিক ঘরানার না হলেও বক্সঅফিসেও সফলতা পেয়েছিলো। তিনি নিজেও জানতেন শুধু শিল্পচর্চার নাম ধরে রেখে সিনেমা বানালে সেটা দীর্ঘস্থায়ী হবেনা সাথে সাথে প্রযোজকদের টাকাও ফেরত আনতে হবে। তাই বানিজ্য এবং আর্ট দুই ক্যাটাগরিতেই ফেলা যায় তার সিনেমাগুলোকে। একজন লেখক, পরিচালক বা অভিনেতা সবক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন সফল এবং শেষের দিকে এসে কিছুটা বিতর্কিতও। তবে বির্তক স্থায়ী হয়নি তার অসাধারন কাজের জন্য। অনেকের মতে বাঙালির মনোজগতকে সুনিপুনভাবে সেলুলয়েডে বন্দী করে আন্তর্জাতিক দর্শকের কাছে নতুন করে তিনিই পৌঁছে দিয়েছিলেন। 

অবাক করা বিষয় হচ্ছে, তাঁর সবকয়টা সিনেমাতেই  নারীর অন্তর্নিহিত নানা অনুভূতি উঠে এসেছে অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ভাবে। মনে রবীন্দ্রনাথকে এবং নির্মানে সত্যজিৎ রায়কে ধারণ করলেও তাদের কাজের ধরন বা মেলোড্রামাকে এড়িয়ে গিয়ে নিজের মত করে নির্মান করেছেন তার সিনেমাগুলি। অভিনেত্রীদের মনস্তত্ব বা নারীর দৃষ্টিকোন নিয়ে বাংলা সিনেমাতে তেমন কাজ হয় না বললেই চলে। নায়িকা বা অভিনেত্রীরা ছক বাধা হয়েই সিনেমার একটুখানি অংশ হিসেবে থেকে যায়। উপমহাদেশে এই কাঠামো অনুসরন করেই সিনেমা নির্মান হয়, তবে মাঝে মাঝে যে ব্যতিক্রম কিছু আসে নি তা নয়। তবে এই গৎবাধা ভাবনাটাকে প্রথমবার ভেঙেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ তার প্রতিটা সিনেমাতেই নারীদের মনস্তত্ত্বকে ফুটিয়ে তোলার মাধ্যমে। তবে তাই বলে পুরুষ চরিত্রকে হেলাফেলা করেননি কখনো। 

অর্থনীতির ছাত্র হয়ে প্রথমে বিজ্ঞাপন জগতে কাজ শুরু করলেও সিনেমার প্রতি ভালোবাসার কারনে পরবর্তীকালে পরিচালনার জগতে পা রাখেন তিনি। ১৯৯২ সালে তাঁর পরিচালনায় মুক্তি পায় প্রথম সিনেমা ‘হীরের আংটি’। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের একটি গল্প অবলম্বন করে নির্মিত এই সিনেমা আলোচনা এবং প্রশংসা সবই পেয়েছিলো। কলকাতা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি বুঝতে পেরেছিলো একজন স্বপ্নবাজ তরুনের আগমন ঘটেছে এই ইন্ডাস্ট্রিতে যিনি সামনে অসাধারন কাজ উপহার দিবেন। 

চিত্রাঙ্গদায় অভিনেতা ঋতুপর্ণ ঘোষ

না, হতাশ করেননি ঋতুপর্ণ। তাঁর পরিচালিত দ্বিতীয় সিনেমা ‘১৯শে এপ্রিল’ শুধু বাণিজ্যিক ভাবেই সফল হয়নি, জিতে নিয়েছিল জাতীয় পুরস্কারও। '১৯শে এপ্রিল' সিনেমায় মা-মেয়ের চরিত্রে অপর্ণা সেন এবং দেবশ্রী র‍্য তাদের অভিনয়ের মাধ্যমে দুর্দান্তভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন দুই নারীর মনস্তাত্ত্বিক দিক। সাথে ঋতুপর্ণ'র পরিচালনা, সংলাপ সব মিলিয়ে কলকাতার দর্শকেরা নতুন এক ধারার সাথে যুক্ত হয়ে গেলেন। এই সিনেমা দিয়েই সেরা অভিনেত্রী হিসেবে দেবশ্রী রায় জিতে নিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। 

আবার 'দহন' সিনেমায় সেই সময়ের বানিজ্যিক সিনেমার জনপ্রিয় দুই অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত এবং ইন্দ্রাণী হালদারকে নিয়ে এলেন। ঋতুপর্ণার মাধ্যমে মধ্যবিত্ত এক গৃহবধূর চরিত্রের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুললেন অপমানিত নারীর আর্তচিৎকার। সেই সময়ে সমাজ যেখানে মেয়েদেরকে দাবিয়ে রাখতেই পছন্দ করতো সেইসময় ইন্দ্রাণী হালদারের চরিত্রের মাধ্যমে দিলেন অন্য একরকম মেসেজ যে সমাজ বদলাচ্ছে, বদলাচ্ছে নারীর চিন্তা চেতনা। ঋতুপর্ণা আর ইন্দ্রাণী হালদারের চরিত্র দুটির মাধ্যমে দেখালেন নারীশক্তির সুফল কিংবা পুরানো সংস্কার সরিয়ে সমাজকে আবার নতুন করে চিন্তা করতে শেখানোর উপায়। এই সিনেমা দিয়ে ঋতুপর্ণা আর ইন্দ্রাণী হালদার দুজনেই সেরা অভিনেত্রী জাতীয় পুরস্কার যৌথভাবে জিতে নিয়েছিলেন। সুচিত্রা ভট্টাচার্যর লেখা গল্প সেলুলয়েডে এতো চমৎকারভাবে তুলে ধরলেন যে বক্স অফিস আর সমালোচক দুই মুগ্ধ। 

অন্যদিকে 'দোসর' সিনেমাতে নায়ক প্রসেনজিৎকে চিরায়ত ইমেজ থেকে বের করে এনে অভিনেতা হিসেবে চমৎকার ভাবে তুলে ধরেছেন ঋতুপর্ণ। সাথে কঙ্কণা সেনের অসাধারণ নিরব অভিনয়। সাদাকালো এই সিনেমায় দাম্পত্যের অনেক জটিল প্রশ্নের উত্তর খুব সহজে বলেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। হয়তো এভাবে বলাটা একমাত্র তার পক্ষেই সম্ভব ছিলো। 

আবার ‘বাড়িওয়ালি’ সিনেমাতে বলিউডের কিরণ খেরের মাধ্যমে কী চমৎকার নিঃসঙ্গ একজন বাঙালী নারীর বাড়িওয়ালি হয়ে উঠার গল্প বললেন ঋতুপর্ণ!! বাংলা না জানা কিরন খেরকে এতো বুদ্ধিদীপ্ত আর সুনিপুণ ভাবে ক্যামেরার ধারন করলেন যে বোঝার উপায় ছিলোনা তিনি বাংলা জানেন না। সাথে কাজের মেয়ের চরিত্রে সুদীপ্তা ও অসাধারন। একজন সেরা অভিনেত্রী অন্যজন সেরা পার্শ্ব অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার জয় করে চমকে দিয়েছিলো পুরো ভারতবর্ষকে। 

দেবশ্রী রায় এবং সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় বাবা-মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করেন ‘অসুখ’ সিনেমায়। মেয়ের পারিশ্রমিকের উপর নির্ভর করে থাকা এক বাবা এবং মেয়ের গল্প কি দক্ষতার সাথেই না তুলে ধরেছিলেন ঋতুপর্ণ। আবার বিপরীত মেরুতে যেয়ে ‘তিতলি' সিনেমাতে বাস্তব জীবনের মা-মেয়ে অপর্না সেন এবং কঙ্কণা সেনকে একসাথে ফ্রেমে উপস্থিত করে অসাধারন একটি সিনেমা উপহার দিলেন বাংলা ইন্ডাস্ট্রিকে।

চমৎকার গল্প, দক্ষ অভিনয়, নির্মানের মুন্সিয়ানা, সুন্দর সংলাপ সব মিলিয়ে দুই বয়সের দুই নারীর দৃষ্টিকোন দিয়ে জীবন এবং সময়কে দেখার সুযোগ। আবার ‘আবহমান’ সিনেমায় একজন পরিচালক ও তার সিনেমার অভিনেত্রীর গল্প কি দক্ষতার সাথেই না তুলে ধরলেন ঋতুপর্ণ! তাদের দুজনের সম্পর্ক এবং তাদের ব্যক্তিজীবনে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর প্রভাব, সমাজিক মতবাদ সব মিলিয়ে দীপংকর দে, মমতা শংকর, অনন্যা চট্টোপাধ্যায়, যীশু সেনগুপ্তর সাবলীল অভিনয় যেনো সেলুলয়েডে নয় ক্যানভাসে এঁকেছেন শক্তিশালী পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ। অনন্যা চট্রোপাধ্যায় এই সিনেমার কল্যানে জাতীয় পুরস্কার লাভ করেছেন। এটি পরিচালক হিসেবেও ঋতুপর্ণ ঘোষকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এনে দিয়েছিলো। 

পরিচালক হিসেবে যে সিনেমা তাকে প্রথমবার জাতীয় পুরস্কার এনে দিয়েছিলো সেটি হচ্ছে ‘উৎসব’। বনেদী বাড়ির দূর্গাপূজা উপলক্ষে একা বসবাস করা মায়ের কাছে ছুটে আসা বিভিন্ন শহরে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা বাড়ির সব ছেলেমেয়ের তাদের পরিবার নিয়ে কয়েকটা দিনের জন্য একত্রিত হওয়া এবং তাদের প্রত্যেকের নিজের গল্প নিয়েই এই সিনেমা। মাধবী চট্রোপাধ্যায়, প্রসেনজিৎ, ঋতুপর্নাকে ছাপিয়ে বাড়ির বড় মেয়ে পারুল চরিত্রে মমতাশংকর যেনো হয়ে উঠেছিলেন উৎসবের মূল আকর্ষন। এই সিনেমার সংলাপ এবং চিত্রায়ণ অসাধারন হয়ে ধরা দিয়েছিলো দর্শকদের কাছে। 

বিখ্যাত লেখক আগাথা ক্রিস্টির 'দ্য মিরর ক্র‍্যাকড ফ্রম টু সাইড' গল্পকে নিজের মত করে খানিকটা অদলবদল করে বলিউডের তিন অভিনেত্রী যাদের শিকড় বাংলায়- শর্মিলা ঠাকুর, রাখী গুলজার, নন্দিতা দাসকে নিয়ে বানালেন ভিন্নধরনের এক গোয়েন্দা গল্পের সিনেমা 'শুভ মহরৎ'। এককালের জনপ্রিয় নায়িকা এবং মধ্যবিত্ত এক নারী চরিত্রের মাধ্যমেও সাসপেন্স বা থ্রিল দেখানো যায় তা দেখিয়ে দিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। ‘রাঙা পিসি’র চরিত্রে রাখী গুলজার এই বয়সে এসে জয় করলেন সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার। 

তার আশেপাশের সবাই জানতেন যে, ঋতুপর্ণ ঘোষ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অন্তরে কতোটা জায়গা দিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের অমর সৃষ্টি ‘চোখের বালি’ অবলম্বনে নির্মান করলেন ‘চোখের বালি’ সিনেমা। কাস্টিংয়েই বড় চমক, বিশ্বসুন্দরী ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চনকে মূল চরিত্র বিনোদনী হিসেবে বাঙালী বিধবার চরিত্রে উপস্থাপন। সেই অবিভক্ত ভারতবর্ষের তখনকার বনেদী জমিদার বাড়ির অন্দরমহলের গল্প, বিধবাদের জীবনযাপন, ইংরেজ তাড়াও আন্দোলন সব মিলিয়ে এক ক্ল্যাসিক বাংলা সিনেমা উপহার দিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। প্রসেনজিৎ, টোটা রায় চৌধুরী এবং রাইমা সেন প্রত্যকেই অসাধারন অভিনয় করলেন। বিশেষ করে রাইমা সেনকে শক্তিশালী অভিনেত্রী হিসেবে এই সিনেমাতেই প্রথমবার দেখা গেলো। 

বলিউডের অজয় দেবগন এবং ঐশ্বরিয়া রাই বচ্চনকে নিয়ে মাত্র সতেরো দিনে শেষ করলেন অন্যরকম প্রেমের সিনেমা ‘রেইনকোট’। না প্রেমকে গতানুগতিক ভাবে দেখানোর পক্ষে কোনকালেই ছিলেন না ঋতুপর্ণ। এই সিনেমার সংলাপ, অভিনয় শিল্পীদের মনকাড়া এক্সপ্রেশন আর অভিনয় দিয়েই সেরা হিন্দি সিনেমা হিসেবে ওই বছরের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ। ঋতুপর্ণ যেনো নিজেকেই ছাড়িয়ে যাচ্ছিলেন দিনকে দিন। 

বলিউডের বিপাশা বসু শুধু গ্ল্যামারগার্ল নয় একজন অভিনেত্রীও সেটি প্রমান করেন ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’ সিনেমার মধ্য দিয়ে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার নানা সমীকরন ঋতুপর্ণ ফুটিয়ে তুলেছিলেন অসাধারন দক্ষতার মধ্য দিয়ে। সাথে প্রসেনজিৎ, পাওলি দাম, যীশু সেনগুপ্ত। মেগাষ্টার অমিতাভ বচ্চন, প্রীতি জিন্টাকে মূল চরিত্রে কাস্ট করে নির্মান করেন ইংরেজি ভাষায় ‘দ্যা লাস্ট লিয়র’। এই সিনেমাটিও সেরা ইংরেজি ভাষার সিনেমা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। বলা হতে থাকে ঋতুপর্ণ ঘোষ যেটাতে হাত দেন তাই যেনো সোনায় পরিনত হয়। 

একজন ঋতুপর্ণ ঘোষকে তিনটা ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। প্রথম ভাগ হচ্ছে 'হিরের আংটি' থেকে শুরু করে 'শুভ মহরৎ' এই সময়টাতে তার প্রতিটি সিনেমা সাধারন দর্শকের ভালবাসা এবং সমালোচকদের প্রশংসা, পুরস্কার সবই পেয়েছে। দ্বিতীয় ভাগ হচ্ছে, 'চোখের বালি' থেকে শুরু করে 'সব চরিত্র কাল্পনিক' এই ভাগে তার সিনেমায় বলিউডি তারকাদের দেখা গেছে হরহামেশা। বাজেট বা প্রযোজক, বক্স অফিস ফ্যাক্টর যখন তার নির্মানের সাথে জড়িয়ে পড়েছিলো। এবং তৃতীয় বা শেষভাগ হচ্ছে 'আবহমান' থেকে 'চিত্রাঙ্গদা' এই ভাগে পরিচালক হিসেবে নিজেকে ভাঙার সাথে সাথে  অভিনেতা হিসেবে তাঁর প্রতিভার ঝলক দেখার সৌভাগ্য ঘটেছে আমাদের।

ঋতুপর্ণ ঘোষ

‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ তে অভিনেতা হিসেবে এমনভাবে সমকামীদের মনস্তাত্বিক ব্যাপার, সামজিক বিধিনিষেধ বা তাদের দুঃখ-কষ্টের মতো সেন্সেটিভ বিষয় এতো সহজভাবে পর্দায় আনলেন ঋতুপর্ণ যে সবার কাছ থেকেই প্রশংসা আর আলোচনার জোয়ারে ভাসলেন। পরিচালক হিসেবে কৌশিক গাঙ্গুলি এই সিনেমায় তার মেধার জোর দেখালেন ঋতুপর্ণকে সাথে নিয়েই। ‘মেমোরিজ ইন মার্চ’ সিনেমাতেও তার অভিনয় প্রশংসা কুড়ায়। 'চিত্রাঙ্গদা' সেলুলয়েডে দেখার সময় বারবার মনে হয়েছে এটি তারই গল্প। পুরুষ থেকে নারী হয়ে উঠার যুদ্ধ,   ত্যাগ, বা সত্যিকারের ভালোবাসা পাবার আকুতি সবমিলিয়ে 'চিত্রাঙ্গদা' ঋতুপর্ণ ঘোষের পরিচালক এবং অভিনেতা হিসেবে ক্যারিয়ারের অন্যতম মাইলফলক। 

শুধুমাত্র একজন সফল চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসাবে নয়, কলকাতার একটি জনপ্রিয় ফিল্ম ম্যাগাজিনের সম্পাদক হিসাবেও দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। টেলিভিশন চ্যানেলে দুটি জনপ্রিয় টক শো পরিচালনা এবং সঞ্চালনা করেছিলেন তিনি। সবমিলিয়ে বলা যায় সিনেমা জগৎ থেকে শুরু করে বিনোদন জগতের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছিল তাঁর অবাধ বিচরন। একই সাথে গল্প, চিত্রনাট্য, ডায়লগ, গান, দৃশ্যায়ন সিনেমার সব শাখায় এমন দক্ষ নির্মাতা হাতে গোনা খুব কমই পাওয়া যাবে। সত্যজিৎ রায়, মৃনাল সেন, ঋত্বিক ঘটকের পর বাংলা সিনেমা বাংলা সাহিত্যের শেকড় থেকে অনেকটা দূরে চলে গিয়েছিলো সেটাকে ফিরিয়ে এনেছিলেন ঋতুপর্ণ দক্ষতার সাথেই। 

ঋতুপর্ণ ঘোষের পরিচালক হিসেবে আরেকটি গুণ হচ্ছে, যে কোন তারকা বা শিল্পীকে অভিনেতা বা অভিনেত্রী হিসেবে তুলে ধরা। আজকের প্রসেনজিৎ, ঋতুপর্না সেন, যীশু সেনগুপ্ত, কঙ্কণা সেন শর্মা, রাইমা সেন, বা পাওলি দামের নাম  নেয়া যায় এক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে।

তার নির্মিত যে কোন চলচ্চিত্র যদি দেখা থাকে তাহলে সেই চলচ্চিত্রের চরিত্র রূপায়নকারী নামগুলোর দিকে তাকালে আমাদের চোখে কোন নায়ক নায়িকার ছবি আসবে না, যেটা আসবে বা বলা যায় চোখে ভেসে উঠবে সেটি হচ্ছে সেই চরিত্রে অভিনয় করা অভিনেতা বা অভিনেত্রীর ছবি। পরিচালক হিসেবে এমন সফলতা আর কজনেরই বা আছে। 

সামাজিক, পারিবারিক এবং ব্যক্তিজীবনের  সম্পর্কগুলোর জটিল মনস্তাত্বিক টানাপোড়েনকে এতো সহজ ভাষায় ফুটিয়ে তুলিয়েছিলেন তিনি, যার কারনে সমাজের যে কোনো শ্রেণির দর্শক তাতে মুগ্ধ হতে বাধ্য। বাস্তবে হয়েছেও তাই। সাধারন দর্শক থেকে শুরু করে সমালোচক সবার মন জয় করেছেন তিনি। তাই একজন সত্যিকারের সিনেমাপ্রেমী হলে ‘ঋতুপর্ণ ঘোষ’ এর কাজ না দেখে থাকা, বা বাংলা সিনেমায় তাঁর আবেদন ও অবদানকে অগ্রাহ্য করা অসম্ভব কঠিন একটি কাজ। 

একটি ইন্টারভিউয়ে তিনি বলেছিলেন- 'এই শহর না আমায় নিতে পারবে, না ফেলতে পারবে'। আসলে হয়েছেও তাই, তার পুরুষ থেকে নারীতে রুপান্তর হওয়াটা ভালোভাবে নেননি অনেকেই তবে চলচ্চিত্র জগতে তার অমর সৃষ্টিগুলো চাইলেই কি অগ্রাহ্য করা যায়!! না যায়না যাবেওনা কোনদিন। আসলে শিল্পীদের কখনো মৃত্যু হয় না, তাঁরা অমর হয়। নিজেদের অসামান্য সৃষ্টির মধ্যেই তাঁরা আজীবন বেঁচে থাকেন, ঠিক যেমন ’ঋতুপর্ণ ঘোষ’ তার নির্মিত নান্দনিক  সিনেমাগুলোর মধ্য দিয়ে রয়ে যাবেন অনন্তকাল।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা