অভিনেতা রবিন উইলিয়ামসনের আত্মহত্যা নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি আজ পর্যন্ত। কিন্ত সত্যিই কি তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন? তার স্ত্রীর বক্তব্য কিন্ত ভিন্ন কোন ইঙ্গিতই দিচ্ছে...

কে না চেনে মানুষটাকে? তিনি হলিউডের বিখ্যাত অভিনেতা রবিন উইলিয়ামস। ১৯৯৮ সালে অস্কার জিতেছিলেন 'গুড উইল হান্টিং' সিনেমার জন্যে। অসম্ভব স্বতঃস্ফূর্ত একজন অভিনেতা ছিলেন ভদ্রলোক। তার অভিনীত দ্যা ডেড পয়েট সোসাইটি সিনেমা এখনো আমার চোখে মুখে লেগে আছে। আর গুড উইল হান্টিং সিনেমা থেকে পাওয়া অনুপ্রেরণা এখনো মাঝে মধ্যে স্মরণ করি৷ অনেকে এই মানুষটাকে কমেডিয়ান হিসেবেও জানে। রবিন উইলিয়ামস যে মানুষকে হাসাবার কাজও করতেন। কিন্তু, মানুষকে হাসিয়ে বেড়ানো মানুষটার জীবনের শেষটা খুব সুখকর হলো না। এক রহস্যময় মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ৬৩ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন তিনি। 

দিনটি ছিল ২০১৪ সালের ১১ই আগস্ট। ক্যালিফোর্নিয়ায় এদিন নিজের বাড়িতে পাওয়া গেল রবিন উইলিয়ামসের নিথর দেহ। তার মৃত্যুতে শোকাহত লাখো ভক্ত, সহসাই রবিন উইলিয়ামসের মৃত্যুর ঘটনা আলোচিত হয়ে যায় বিশ্বজুড়ে। পুলিশ ধারণা করে রবিন উইলিয়ামস আত্মহত্যা করেন। রবিন উইলিয়ামসকে ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে থাকা অবস্থায় পাওয়া যায়। 

সচরাচর সেলিব্রেটিদের ক্ষেত্রে যা হয়, রবিন উইলিয়ামসের 'আত্মহত্যা' নিয়েও সেরকম হৈ চৈ শুরু হলো। অনেকেই বিভিন্ন রকম জাজমেন্ট দেয়া শুরু করলো। কেন আত্মহত্যা করতেই হবে তাকে, কেন মারা যেতেই হবে কত শত প্রশ্ন উঠতে থাকলো। আবার অনেকেই আত্মহত্যা করবার জন্য রবিন উইলিয়ামসের প্রতি সিমপ্যাথিও প্রকাশ করতে থাকলো এবং সেটা যতটা না সিমপ্যাথি তার চেয়ে বেশি যেন ব্যাঙ্গ! আসলেই কি রবিন উইলিয়ামস আত্মহত্যাই করেছিলেন?

এখন যদি আপনাকে বলি রবিন উইলিয়ামস নিজেকে নিজে হত্যা করেননি? আপনি কি বিশ্বাস করবেন? নিশ্চয়ই খটকা লাগবে। কারণ ইতিমধ্যেই তিনি আত্মহত্যা করেছেন এই বিষয়টিকে আত্মহত্যা নিরোধের সচেতনতামূলক লেখায়, আলোচনায় অনেকবার ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। গোটা বিশ্ব জানে, রবিন সুইসাইডই করেছে। কিন্তু, রবিন উইলিয়ামসের মৃত্যুর আসল কারণটা কি সবাই জানে? তার স্ত্রী সুসানের অভিমত এই মৃত্যুটি নিয়ে আপনাকে নতুন করে এই মৃত্যু নিয়ে ভাবাবে। 

কেন আত্মহত্যা করেছিলেন রবিন উইলিয়ামস?

মৃত্যুর কয়েকবছর আগে রবিন উইলিয়ামস শেষবারের মতো বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন সুসান স্নেইডারের সাথে। এই নারী ছিলেন একজন গ্রাফিক ডিজাইনার। রবিন উইলিয়ামসের শেষ দিনগুলোতে তিনিই ছিলেন তার সঙ্গী। এই অভিনেতার মৃত্যুর পর সুসান একটি জার্নালে লেখা প্রকাশ করেন। সেই লেখায় রবিন উইলিয়ামসের মৃত্যু সম্পর্কে কিছু তথ্য উঠে আসে। সুসান লিখেছেন, "রবিনের মধ্যে সবসময়ই লার্জার দ্যান লাইফ স্পিরিটটা ছিল, থাকবে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে অন্য সবার মতোই সাধারণ মানুষ যার মানুষের মতোই একটা মস্তিষ্ক ছিল। আর সেই মস্তিষ্কের বিরল এক রোগে আক্রান্ত ছিল সে যা প্রতি ছয়জন রোগীর মধ্যে একজনের হয়।" 

মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে, মে মাসের ২৮ তারিখ, রবিনের রোগ ধরা পড়ে। সুসান এবং রবিন নিউরোলজিস্টের কাছে যান। জানতে পারেন, রবিনের উইলিয়ামস পারকিনসন রোগে আক্রান্ত। পারকিনসন একটি যন্ত্রণাদায়ক রোগ। এ রোগে আক্রান্ত হলে মস্তিষ্কের এমন অবস্থা হয় যে রোগীর হাতে, পায়ে কাঁপুনি হতে থাকে। রোগীর চলাফেরায় সমস্যায় দেখা দেয়। শরীরের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যায়। পারকিনসনে আক্রান্ত রোগী নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারায়। এমনও হতে পারে রাস্তাঘাটে সে চেতনা হারিয়ে পড়ে আছে, কোনো খবর নেই।

কিন্তু, রবিন উইলিয়ামস চিন্তিত ছিলেন অনেক বেশি। পারকিনসনের চেয়েও ভয়ানক কিছু রোগ তার দেহে বাসা বাঁধছে কিনা সন্দেহ ছিল তার। তিনি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তার কি আলঝেইমার হয়েছে কি না? তার কি ডিমেনশিয়া হয়েছে কি না, তিনি কি সিজোফ্রেনিয়ায় ভুগছেন? ডাক্তার যদিও বলেছিল, না, এসব কিছু নয়। কিন্তু, সত্যটা পরে বোঝা গেল। ডাক্তার আসলে রোগ নির্ণয়ে ভুল করেছিলেন। রবিন উইলিয়ামস নিজের শরীরে রোগের উপসর্গগুলোর গভীরতা টের পাচ্ছিলেন। কিন্তু, তিনি কাউকে বুঝতে দেননি। জানাননি। 

আলঝেইমার হলো স্মৃতিশক্তি ক্ষয়ে যাওয়া রোগ। এই রোগে আক্রান্তদের ডিমেনশিয়া হবার প্রবল সম্ভাবনা থাকে। যাদের ডিমেনশিয়া হয় তারা ভয়ংকর ভাবে স্মৃতিবিভ্রাটে পড়েন। এমনকি আপন মানুষদেরও চিনতে পারেন না কখনো কখনো। ছোট ছোট স্মৃতি তার মাথা থেকে মুছে যায়। ধরুন, কিভাবে কমলা খেতে হয় এই স্মৃতিটি আপনার মস্তিষ্ক থেকে মুছে গেল ডিমেনশিয়ার প্রভাবে। হতেই পারে। এই রোগে আক্রান্ত হলে চিন্তার গতি কমে যায়, ভাষার ব্যবহার সীমিত হয়ে পড়ে। একজন মানুষ যেন জীবিত থাকতেই ধীরে ধীরে মৃত হয়ে পড়েন। স্মৃতি না থাকলে মানুষ আর কিভাবে মানুষ থাকে! 

ডেড পোয়েটস সোসাইটি সিনেমায় রবিন উইলিয়ামস

রবিন উইলিয়ামস শুধু পারকিনসন নয় তিনি আসলে ডিমেনশিয়া রোগে আক্রান্ত ছিলেন। তবে তার ডিমেনশিয়ার ধরণও বিরল, তিনি যে ধরণের ডিমেনশিয়াতে আক্রান্ত ছিলেন এটাকে বলা হয় লিউ বডি ডিমেনশিয়া ( Lew Body Dementia)। একজন মানুষের জন্য সবচাইতে বাজে পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে এধরণের ডিমেনশিয়া। এটি আসলে পারকিনসন, আলঝেইমার দুটি রোগের সম্মিলিত রুপ। এই রোগে আক্রান্ত হলে অস্তিত্ব বলে কিছু থাকে না। মানুষ আর নিজের কোনো কিছুর সাথে কানেক্টেড ফিল করে না। সব কিছুর সাথে একটা দূরত্ব তৈরি হয়। মস্তিস্ক সব এলোমেলো করে দেয় একেবারে।

তিনি আসলে নিজেকে হত্যা করেন নি, শুধু সময়ের স্বাভাবিক হিসেবের তুলনায় একটু আগে চলে গেছেন। এটাকে স্বেচ্ছামৃত্যু বলা যেতে পারে। আত্মহত্যা এবং স্বেচ্ছামৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য আছে। মানসিক সমস্যার কারণে যারা আত্মহত্যা করে সেসব মৃত্যুর চাইতে এটি আলাদা। কারণ, এখানে রবিন উইলিয়ামস শারিরীকভাবে তার যন্ত্রণাদায়ক দিনগুলোর দীর্ঘায়িত করতে চাননি বলে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যে মৃত্যু আসলে তাকে তীব্র যন্ত্রণার হাত থেকে কিছুটা রেহাই দিয়েছে। 

তাই রবিন আত্মহত্যা করেছে এই কথা ভেবে খারাপ বোধের কিছু নেই, এই কথাকে ব্যবহার করে আত্মহত্যার আলোচনা করবারও মানে নেই। রবিন শুধু সেই কাজটাই করেছেন, যা তাকে পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়েছে। আত্মহত্যার সাথে রবিনের মৃত্যুর এটাই পার্থক্য। আর হয়ত একারণেই, তার স্ত্রী সুসান তাকে নিয়ে বলেছেন, "আমার কাছে রবিন পৃথিবীর সবচেয়ে সাহসী মানুষ। জীবনের নিয়ন্ত্রণ আবার হাতে নেবার জন্য রবিনের জন্য ওটাই সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল। আমি ভেবে দেখেছি, বিশ্বাস করুন। তার মাথায় অনেক কিছু চলছিল। অনেক কিছু ভেবেচিন্তেই সে সিদ্ধান্তটি নিয়েছে। এবং এ জন্য আমি তাকে দোষ দেবো না, একেবারেই না।"

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা