রকস্টার একটা মিউজিক্যাল জার্নি যার মাঝে প্রকৃতি ও মানুষ মিলেমিশে একাকার হয়েছে সুরেলা প্রতিবাদে। কিন্তু এই রকস্টারের মিউজিকই শ্রোতাকে নিয়ে যায় স্পিরিচুয়ালিটির জগতেও, স্রষ্টার খুব কাছে। আবার বিশ্বসংগীত, ফোকটেল ও রকস্টার জিম মরিসনের প্রতি ট্রিবিউটও এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

এই যে এখন যখন লেখা শুরু করলাম তখন সূর্যি মামা ছুটি নিচ্ছে, সুন্দর একটা নাম আছে এই সময়টার- গোধূলি লগন। সকাল থেকে লেখার খাতা খুলে বসে আছি, স্টিকি নোটসে লিখে রাখা আছে সব ফ্যাক্টস আর পয়েন্টস। এক মাস ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছি, মনে মনে তো ঠিক করে রেখেছিলাম এই লেখার কথা আরও বছর পাঁচেক আগেই। অথচ লিখতে পারছিলাম না। এই গোধূলি লগনে এসে বোধহয় গেরোটা ছিঁড়লো। 

গোধূলি নিয়ে কথা বলছিলাম, খুব সুন্দর একটা শব্দ কিন্তু এই গোধূলি। বিদায়ের ব্যথা যেমন আছে এতে, তেমনি আগমনের সুরও বাজে। কিন্তু সব সময় এমন যথাযথ সুন্দর শব্দ পাওয়া যায় না শত খোঁজ করেও নিজের মনের ভাবটা প্রকাশ করার জন্য। যখনই প্রকাশ করতে যাই তখনই মনে হয় মনের ভেতরের ভাবটায় যে গভীরতা ছিল, যে পিউরিটি ছিল, সেটি যেন হারিয়ে গেল ভুল শব্দের ভিড়ে।

যা-ই আমি বলতে চাই না কেন, নষ্ট করে দেয় সে শব্দগুলো। প্রতিটি মানুষই কিন্তু বলতে চায়, সেটা কথা দিয়ে হোক বা গান দিয়ে হোক বা ছবি এঁকে হোক বা ভিন্ন উপায়ে প্রকাশ করে। কিছু একটা বলার ইচ্ছা প্রতিটা মানুষেরই থাকে, এ আর রেহমানেরও ছিল। আল্লাহ্‌ রাখা রেহমান সংক্ষেপে এ আর রেহমান ২৩ বছর বয়সে যখন ইসলাম ধর্মগ্রহণ করলেন তার অনেক আগে থেকেই সংগীতের সাথে যুক্ত ছিলেন।

তার বাবা তামিল ও মালয়লাম চলচ্চিত্রের ফিল্ম স্কোরের সাথে যুক্ত ছিলেন, তাই ছোট বয়সেই কীবোর্ডে হাতেখড়ি হয় রেহমানের। কিন্তু মাত্র ৯ বছর বয়সে বাবাকে হারানোর পর রেহমানের ওপর অনেক দায়িত্ব চেপে বসে। মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট ভাড়া দিয়ে দিনাতিপাত করতে হতো তার ও তার পরিবারের সেসময়। পরবর্তীতে রেহমান ইল্লিয়েরাজার মতো লেজেন্ডারি সংগীত পরিচালকের সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন বলেই হয়তো সংগীত নিয়ে স্বপ্ন দেখা শুরু তার।

চলচ্চিত্রের ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর করতে করতেই প্রথম সংগীত পরিচালনার প্রস্তাব পান পরিচালক মণি রত্নমের কাছ থেকে সেই ১৯৯২ সালে। রেহমান বুঝতে পারলেন তিনি যা বলতে চান তা বলার সুযোগ হয়তো এটাই। ‘রোজা’ চলচ্চিত্রের জন্য রেহমান যে সংগীতের সৃষ্টি করেছিলেন তাকে কোন বিশেষণে বিশেষায়িত করা আসলে সম্ভব না। এখনো পর্যন্ত উপমহাদেশের অন্যতম সেরা মিউজিক এলবাম হিসেবে বিবেচিত হয় সেটি। 

রকস্টার চলচ্চিত্রের কিছু দৃশ্য 

প্রথম মুভিতে কাজ করে অবশ্য রেহমান হতাশই হয়েছিলেন কারণ তিনি যেভাবে সংগীতকে চলচ্চিত্রে কল্পনা করেছিলেন সেরকমটি ছিল না চলচ্চিত্রের জগত। তবুও রেহমান থেমে যাননি, সময়ে সময়ে বলে গিয়েছেন তার কথা তার সংগীতের মধ্য দিয়ে। রেহমানের যেকোনো একটা স্ক্র্যাচ শুনলেও মনে হবে শ্রোতার অদ্ভুত ধ্রুপদী কোন মায়াজাল। সেই রেহমান খোঁজ করতে লাগলেন এমন একটা চলচ্চিত্রের, এমন একটা গল্পের, যার প্রোটাগনিস্টের মুখ দিয়ে, গলা দিয়ে তিনি নিজের কথা বলবেন।

ঠিক এমনই এক সময়ে দেখা হয় তার ইমতিয়াজ আলীর সাথে। ইমতিয়াজ আলী তখন তার দ্বিতীয় মুভি ‘জাব উই মেট’ এর সফলতায় উদ্ভাসিত। কিন্তু ইমতিয়াজের মাথায় গল্প ঘুরছে অন্য কিছুর। একজন সাদামাটা এস্পায়ারিং গায়কের জীবনকাহিনী, যার মন ভেঙ্গে হয় চুড়চুড় আর সে সেই ভাঙা মন নিয়ে পাড়ি দিতে থাকে সংগীতজগতের মৃত্যুকঠিন পথ, হয়ে ওঠে রকস্টার। ইমতিয়াজ আলী যাকে গুরু মানতেন, সেই এ আর রেহমানের সাথে শেয়ার করলেন তার স্ক্রিপ্ট আইডিয়া।

এ আর রেহমানও খুব উচ্ছ্বসিত স্ক্রিপ্ট শুনে। তাগাদা দিতে লাগলেন ইমতিয়াজকে এই কাজটা করার জন্য। কিন্তু ইমতিয়াজ পথ হারিয়ে ফেললেন, আরও কয়েক বছর পার হয়ে গেল, ইমতিয়াজ আলী আরও একটা হিট মুভি বানালেন কিন্তু মনের ভেতর খচখচানি ছিলই। হৃদয়ের গহীন থেকে ডাক আসছিল- রকস্টার, রকস্টার। এবার আর দমলেন না, এ আর রেহমানের সাথে আবার বসলেন, সঙ্গে নিলেন প্রিয় বন্ধু গীতিকার ইরশাদ কামিলকেও।

রকস্টারের চরিত্রে কাকে নেয়া যায় ভাবতে ভাবতে পছন্দ হয়ে গেল তার রনবির কাপুরকে। রনবির তার আগেই এক বন্ধুর মুখে স্ক্রিপ্ট শুনে মুগ্ধ, আর এ আর রেহমান যেখানে মিউজিকের দায়িত্বে সেখানে মানা করার প্রশ্নই আসে না। সিনেমার সাথে যুক্ত প্রতিটি মানুষই কিছু না কিছু ব্যক্ত করতে চাচ্ছিল এই মুভি দিয়ে, মিউজিক দিয়ে। তাই যে যার যার অস্ত্র শাণিত করতে লাগলো। এ আর রেহমান কম্পোজ করতে লাগলেন তার বেস্ট কিছু কম্পোজিশন।

সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে ডাক পড়লো মাইকেল জ্যাকসনের ব্যান্ডের লিড গিটারিস্ট অরিয়ান্থি পানাগারিসের। অরিয়ান্থিকে নিয়ে রেহমান একটা সলো গিটার স্ক্র্যাচ বানিয়ে পাঠালেন লিরিসিস্ট ইরশাদ কামিলের কাছে। ইমতিয়াজ চাইছিলেন গানটা একটা রেবেলিয়ন এন্থেম হবে। তরুণ প্রজন্মের পালস ইমতিয়াজ ধরতে পারছিলেন, তারুণ্যের মাঝে প্রতিবাদ থাকবেই। আর সেই প্রতিবাদই যেন ব্যক্ত করতে চাচ্ছিলেন মূল চরিত্র জর্ডানের গানের মাধ্যমে।

ইরশাদ ইমতিয়াজের সাথে স্ক্রিপ্টের শুরু থেকেই ছিলেন বলে জানতেন এই চরিত্রের প্রতিবাদী রূপ কেমন হতে পারে। সাথে মেলালেন তরুণ অবস্থায় নিজের প্রতিবাদী মানসকে। সেই আশি-নব্বইয়ের দশকে তিব্বতের স্বাধীনতাকামী মানুষের আন্দোলন তাতিয়ে তুলেছিল যে কলেজপড়ুয়া ইরশাদকে, সে ইরশাদ আরও প্রতিবাদী হলেন কৃত্রিম প্রাকৃতিক আন্দোলনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। যেখানে প্রকৃতির দোহাই দেয়া সমাজের অধিপতিরা প্রকৃতি থেকে সবুজ মানুষ ছিনিয়ে নিচ্ছে সেখানে কীভাবে প্রকৃতি রক্ষা হয় ইরশাদ তা জানতে চান।

নিজের কলমের খোঁচায় সেই প্রতিবাদই ব্যক্ত হয় “সাড্ডা হাক এত্থে রাখ” (আমার অধিকার আমাকে দাও) গানে। বিশ বছর আগে শোনা পাঞ্জাবী ভাষার এই রেবেলিয়াস ট্যাগ লাইনই হয়ে যায় রকস্টারের ইউথ এন্থেমের প্রধান মুখরা। জর্ডান মুখরা গাওয়া শেষে বলে ওঠে- সে যেখানে গান গাচ্ছে সেখানে আগে ঘন-বিশাল জঙ্গল ছিল। সে জঙ্গল কেটে পরে মানুষ শহর বানিয়েছে। জঙ্গল কাটার সময় পাখিদের একটা দল উড়ে গিয়েছিল সেখান থেকে। সেই পাখিদের খোঁজ করছে সে।

কেউ কি সেই পাখিদের দেখেছে? এখানে ইরশাদ কামিল সেই উচ্ছেদিত পাখিদের সাথে জর্ডানকেই তুলনা দিয়েছেন আসলে। যে এখন দিক্বিদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই দায় আসলে কার? এই দায় তো সেই সমাজেরই, যে সমাজ জর্ডানের মতো সবুজ মানুষকে কেড়ে নিয়েছে প্রকৃতি থেকে। কিছু লাইন অনুবাদ করে দিচ্ছি সেই গানের- ও ইকো ফ্রেন্ডলি, প্রকৃতির রক্ষক, আমিও যে প্রকৃতি। সংস্কার থেকে, সমাজ থেকে, আমায় কেন আলাদা করলে? কেন তোমরা সত্য শেখাও? যেখানে সত্য শুনতেই ভয় পাও। 

সত্য বলে ফেললে কেউ তো, নিয়ম-কানুনের প্যাঁচে ফালাও? তাহলে কি বলতে চাও আমার জীবনে আমার চেয়েও তোমাদের অধিকার বেশি? আমার অধিকার আমাকে দাও, আমার অধিকার আমাকে দাও। শব্দ... শব্দের খেলার কথা বলেছিলাম না লেখার প্রথমে! কীভাবে মনের ভাবকে এক্সপ্রেস করতে গিয়ে শব্দরা তালগোল পাকিয়ে ফেলে, ইরশাদ কামিল রকস্টারের লিরিক লেখার ক্ষেত্রে বোধহয় এই ফ্যাক্টের ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছিলেন।

রনবীর কাপুর- ইন অ্যান্ড অ্যাজ রকসটার

তাই তো তিনি লিখে ফেললেন- যা-ই আমি বলতে চাই, বরবাদ হয়ে যায় বলতে গেলেই। কখনো আমার মনে হয় বুঝি এই পৃথিবী পুরোটা জাদু, যা আছে আর যা নেই তাও আমায় করে ইশারায় কাবু। কীভাবে বলি আমি গল্প এদের? যদিও আমি বলতে চাই, বরবাদ হয়ে যাবে বলতে গেলেই। এ আর রেহমান যখন কম্পোজিশনে লিরিক বসিয়ে ইমতিয়াজকে প্রথম শোনান এই গানটি তখন স্রেফ গানের মাঝে দিয়ে তাল দেয়ার জন্য ‘ঝ্যা ঝ্যা ঝ্যা’ বা ‘ইয়ে এ ও ইয়ে এ এ’ এরকম সাউন্ড ব্যবহার করেন, যেটা পরে ড্রামস বা কীবোর্ডে রিপ্লেস হয়ে যেত।

কিন্তু ইমতিয়াজের মনে হল এই ইমোশনটা দরকার মিউজিশিয়ান হিসেবে রকস্টারে। তাই এগুলোও রেখে দেন মূল গানে এ আর রেহমানের অজান্তেই। পরে অবশ্য এ আর রেহমান মেনে নেন ঠিকই। ইমতিয়াজ মনে করেন যে এ আর রেহমান যখনই নতুন কোন মিউজিক করেন তখনই বিশ্বসংগীত এক ধাপ এগিয়ে যায়, নতুন কিছু যুক্ত হয় এর সাথে। ইমতিয়াজ যে গল্প বলতে চেয়েছিলেন সেটি বলতে গিয়ে বরবাদ হয়ে যায়নি কারণ সে গল্পের স্বপ্ন তার সাথে শেয়ার করেছিল এ আর রেহমান ও ইরশাদ কামিলও।

এ আর রেহমান তার মিউজিক দিয়ে যা বলতে চেয়েছিলেন তা বলতে পেরেছিলেনও ঠিক এই কারণেই। ইরশাদ কামিলও যা লিখতে চেয়েছিলেন তা প্রকাশ করতে পেরেছেন সঠিক গল্প ও কম্পোজিশনের হাত ধরেই। রনবির যা ইন্যাক্ট করতে চেয়েছিলেন তা পেরেছিলেন এই সকলের সমন্বয়কে নিজের ঠোঁটে জায়গা করে দেয়ার ফলেই। রকস্টার একটা মিউজিক্যাল জার্নি যার মাঝে প্রকৃতি ও মানুষ মিলেমিশে একাকার হয়েছে সুরেলা প্রতিবাদে। কিন্তু এই রকস্টারের মিউজিকই শ্রোতাকে নিয়ে যায় স্পিরিচুয়ালিটির জগতেও, স্রষ্টার খুব কাছে। আবার বিশ্বসংগীত, ফোকটেল ও রকস্টার জিম মরিসনের প্রতি ট্রিবিউটও এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

Bird of Prey Bird of Prey Flying high Flying high take me on your flight...

জিম মরিসনের গাওয়া এই গানে জিম সঙ্গী হতে চাচ্ছেন এক শিকারি পাখির। উড়ে যেতে চাচ্ছেন সেই পাখির সাথে অনেক দূরে কোথাও। এরকমই এক পাখির দেখা পাই আমরা রকস্টারে। জর্ডানও সেখানে পাখির খোঁজ করছে, অথবা খোঁজ করছে নিজেকেই। ‘নিজেকে জানো’, ‘Know thyself’- লালন হোক বা সক্রেটিস, জিম মরিসন হোক আর জর্ডান- নিজেকে অনুসন্ধানের চেষ্টা চলছে, চলে আসছে সৃষ্টির শুরু থেকে।

রকস্টারের মিউজিকে সেই অনুসন্ধিৎসু মনই পূর্ণতা পায়। ‘সাড্ডা হাক’ গানে যে পাখির খোঁজ চলছিল সেই পাখিকেই আবার উড়তে বলে জর্ডান। নিজেকেই নিজে তাগাদা দেয়, কারণ সে জানে এই সমাজ-সংস্কার তার পাখির মতো স্বাধীনতাকামী পায়ে শেকল বেঁধে দিয়েছে। যে শেকল ভেঙ্গে সে যেতে পারে না এখন আর তার ভালোবাসার মানুষটির কাছে। দুজনে মিলে ঘুরে আসতে পারে না মুক্ত পাখি হয়ে বন থেকে বনান্তরে।

এই শেকল ভাঙার ডাক ইরশাদ কামিলের লিরিকে প্রাণ পেল “ফির সে উড় চালা” গানে। আর এরকম ফ্রি স্পিরিটেড লিরিকে দরকার ছিল ফ্রি স্পিরিটেড সুরেরও। এ আর রেহমান তা বুঝেই সুরের শেকলও এখানে ভেঙ্গে ফেললেন। গানের মাঝে ট্রেডিশনালি মুখরা আর অন্তরা দুটো ভাগ থাকে, এই গানে সেটি আর থাকলো না। মোহিত চৌহানের গলায় এই গানটি শুরু থেকে শুনলে মনে হবে হয়তো মাঝখান দিয়ে শুরু হল, শেষের দু লাইন শুনলে মনে হতে পারে এইতো শুরু।

রকস্টার এর শ্যুটিং এর এক ফাঁকে 

গানের সুরে কল্পিত ডানা এঁকে এ আর রেহমান ভাসিয়ে দিলেন যেন এই গানটিকে। নদীর মতো বহমান এই গান। মনপাখিকে তাগাদা দেয়ার গান। এই পাখি উড়তে শিখুক, আমরা চলুন এর মাঝে জেনে আসি অন্য কিছু- ইমতিয়াজ আলী যে রকস্টারের ছবি এঁকেছেন, সে রকস্টার ছোট একটা শহর থেকে উঠে আসা রকস্টার। তার গানে, তার অনুপ্রেরণায় তাই দেশীপনা থাকবে, আরও থাকবে তার নিজস্ব ধর্মবিশ্বাস আর অলৌকিকতাও।

প্রতিটি গানের উচ্চারণে তাই যেমন দেশীপনা থাকে তেমনি জীবনের স্ট্রাগলিং পিরিয়ডে তাকে শান্ত করা স্পিরিচুয়ালিটিও এসে জায়গা করে নেয় আমাদের রকস্টার জর্ডানের মাঝে। পরিবার থেকে বিতাড়িত জনার্দন আশ্রয় পায় হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়ার মাজারে। সেখানকার বিখ্যাত কাওয়াল নিজামি ব্রাদার্সদের সাথে যুক্ত হয়ে কাওয়ালি গেয়ে দিনাতিপাত করে কিছুদিন। এখানেই ইমতিয়াজ আলী প্লেস করেন “কুন ফায়া কুন” গানটি। এ আর রেহমান আর দশটা কাওয়ালি গানের মতো এই গানটি করতে চাননি।

হজরত নিজামউদ্দীন আউলিয়ার মাজার যেখানে, আমীর খসরুর মতো দিজ্ঞজের আশ্রয় ছিল যা, সেখানে কোন কাওয়ালি রচনা করতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই অনেক চাপ জেঁকে বসবে। তবুও এ আর রেহমান দমে যাননি, নিজের জীবন থেকেই টানলেন যেন সুর, ওপর থেকে শোনা গেল বুঝি একটা শব্দই- কুন, ওমনি ইরশাদ কামিল লিখে ফেললেন গানের লিরিক- কুন ফায়া কুন (হও, হয়ে যাও)। নিজামি ব্রাদার্স, জাভেদ আলী, এ আর রেহমান আর মোহিত চৌহানের গলায় হয়েও গেল এই গানটি। 

যখন কোথাও কিছুর অস্তিত্ব ছিল না, তখনও তুমি ছিলে, কেবল তুমিই ছিলে। আর বলেছিলে- 'কুন ফায়া কুন' (হও, হয়ে যাও) ট্রেডিশনাল কাওয়ালি সুরের সাথে এ আর রেহমান মিক্স করলেন আনকনভেনশনাল গিটার সলো। আর মোহিত চৌহানের আধুনিক গলা ও রনবিরের শুন্যদৃষ্টি মিলে তৈরি হল অদ্ভুতুড়ে অলৌকিকতার। সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গাওয়ার সাথে সাথে যেন শ্রোতা, গায়ক সবাই মিলে সৃষ্টিকর্তার খুব কাছে চলে গেল।

তারপর এই জনার্দন আবারও পেটের দায়ে জাগরণে গান গাওয়া শুরু করে, সেখানেও মা দুর্গার ভক্তিবাণী গাইতে গিয়ে সে ভিন্ন বিশ্বাসে দীক্ষিত হয়। সবগুলো বিশ্বাস থেকেই কিছু না কিছু নিয়ে তৈরি হয় এই সেক্যুলার রকস্টার, জর্ডান। শুধু ধর্ম থেকেই নয়, সংস্কৃতি থেকেও জর্ডান অনুষঙ্গ নিয়েছে। ভালোবাসার টানে প্রাগে গিয়ে জর্ডান সেখানকার জিপ্সি সুরে গেয়ে ওঠে ‘হাওয়া হাওয়া’। ইরশাদ কামিল চেকোস্লোভাকিয়ার ফোক রুপকথা “স্লিপি জন” কে উপস্থাপন করেন গানের লিরিকে, আর এ আর রেহমান জিপ্সি সুরের সাথে অপেরা গায়কী মিক্স করে উপহার দেন এই মাস্টারপিস কম্পোজিশন।

ইমতিয়াজ আলী, এ আর রেহমান- দ্য ম্যাজিকাল ডু্য়ো

এসব কিছু মিলেই তৈরি হয় অহংকারী, রগচটা, অ্যালকোহলিক ও ব্রোকেন রকস্টার জর্ডান। ভাঙা মন থেকে সংগীত বের হয়, এই ভেবে সংগীতের জন্য মন ভাঙাতে নিয়ে গিয়ে জনার্দন বুঝেছিল যে ভাঙা মন দিয়ে সংগীত হয় ঠিকই কিন্তু সেই সংগীত দিয়ে ভাঙা মন আর জোড়া লাগানো যায় না। মনভাঙাপাখি শেকল ভেঙ্গে উড়ে চলে গেছে তাকে একা রেখেই।  তাই যতই খোঁজ করা হোক না কেন সেই বোকা মনপাখির, সে পাখি আর ঘরে ফিরে আসবেনা।

মারামারি করে রক্তাক্ত জর্ডান স্টেজে উঠে গিটার কাঁধে তুলে নেয় ঠিকই কিন্তু সামনে থাকা হাজার হাজার মানুষ তার আর চোখে পড়ে না। তার চোখে শুন্যতা খেলা করে, সে শুন্যতা খোঁজে তারপ্রেয়সীকে, সে শুন্যতা খোঁজে নিজেকে। আকাশ যতই ভেঙ্গে দিস, পৃথিবী দুমড়াস-মুচড়াস, নিজেকে লুকাতে তাও পারবিনা তুই। যে রাস্তাতেই খুঁজতে যাস, নিজের মাঝে নিজেকে পাস, ঘুরে ফিরে নিজঘরেই ফিরবি তুই। ও বোকা মনপাখি, ঘরে আয় তুই... ফিরবে না আর সেই পাখি ঘরে।

মুভি শেষে সেটিরই ইঙ্গিত দিয়ে যায় “নাদান পারিন্দে” গানটি। প্রিয়জনকে হারানোর বেদনা, নিজেকে হারানোর কষ্ট মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় এ আর রেহমানের এই কম্পোজিশনে। ইরশাদ কামিল এই গানের লিরিকে শত শত বছর আগের বলে যাওয়া বাবা ফরিদের চারটি লাইন ব্যবহার করেন। যার অনুবাদ করলে কিছুটা এরকম হয়- শকুনি কাক তোর কাছে একটাই মিনতি শুধু বেছে বেছে খেয়ো আমার লাশ। 

চক্ষুজোড়া আস্ত রেখ, চোখ দুটো মোর খেয়ো না তো, প্রিয়কে দেখার বড় আশ... আমাদের বাংলা অঞ্চলে এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’ যেন মিলে যায় এই আর্তির সাথে। এই শকুনি কাক কি জর্ডানের হারানো সেই পাখিটাই কিনা সেই প্রশ্ন করাই যায়। নিজের হাতে নিজের ধ্বংস টেনে আনলে, হারানো সেই সরল-সোজা মনপাখির শকুনি কাক হয়ে যাওয়ার সিম্বল যথার্থ বলেই মনে হয়। জর্ডানের এই আর্তি জিম মরিসনের ‘বার্ড অফ প্রে’র সাথেও অদ্ভুতভাবে মিলে যায়।

দুজনেই শিকারি পাখির শিকার, দুজনেই হৃদয় ভাঙা রকস্টার। ইমতিয়াজ আলী অবশ্য সরাসরি ট্রিবিউট দিয়েছেন জিমকে, নাদান পারিন্দে গানে  জর্ডানকে বাথটাবে বসিয়ে। যে বাথটাবে বসে জর্ডান গিটারকে আগুনে জ্বলতে দেখছিল। ১৯৭১ সালে জিম মরিসনকেও মৃত আবিষ্কার করা হয় একটি বাথটাবে বসে থাকা অবস্থায়। জিম মরিসনের মৃত্যুর কারণ এখনো স্পস্ট হয় নি, জর্ডানও মরে গিয়েছিল কিনা কিছুদিন পর সে কথাও কেউ জানে না।

আমরা শুধু একটা কথাই জানি, যে দুজনের শারীরিক মৃত্যুর কারণ অজানা হলেও এই দুজনের আত্মিক মৃত্যু হয়ে গেছে অনেক আগেই। এই মৃত আত্মাগুলোই হয়ে ওঠে রকস্টার, এই মৃত আত্মার সংগীত তাই রিলেটেবল। রকস্টারের মিউজিক্যাল জার্নি অনেকগুলো আবেগকে স্পর্শ করে। সংগীতময়তা, ধর্মবিশ্বাস, দার্শনিকতা, রাজনীতি, সাহিত্য, প্রকৃতি ইত্যাদি সবকিছুর জন্যই কিছু না কিছু আছে এর মিউজিকে।

মোট ২০ টি ট্র্যাক এই মিউজিক এলবামে, ১৪ টি গান আর ৬ টি কম্পোজিশন। গিটার, ড্রামস, কিবোর্ডের সাথে মিলন হয়েছে সানাই, হারমোনিয়াম, বাঁশি, ক্ল্যাপের। রক, জ্যাজ, জিপ্সি অপেরার সাথে মিলন হয়েছে কাওয়াল, আলাপ, ক্লাসিক্যালের। কম্পোজিশনকে কমপ্লিমেন্ট করেছে লিরিক, লিরিককে কমপ্লিমেন্ট করেছে প্রেজেন্টেশন, প্রেজেন্টেশনকে কমপ্লিমেন্ট করেছে লিপসিঙ্ক আর এক্টিং।

এ আর রেহমান, ইরশাদ কামিল, ইমতিয়াজ আলী, রনবির কাপুর- একক অবদান কারোই নেই এখানে। এটাই সার্থক করেছে রকস্টারের মিউজিককে, রকস্টারকে। সংগীত বেঁচে থাকুক এভাবেই, বিশ্বাসে-অবিশ্বাসে, সংস্কার-প্রতিবাদে, রাজনীতি-প্রকৃতিতে, ভালোবাসা-মন্দবাসাতে।


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা