টেনিস খুব একটা অনুসরণ না করলেও রজার ফেদেরার কে চেনেন প্রায় সবাই। খেলার কারণেই যিনি গ্রেটেস্ট, যাকে ডাকা হয় লিভিং লিজেন্ড, ফেড এক্সপ্রেস নামে। আপাদমস্তক মার্জিত ব্যবহারের প্রতিমূর্তি এই মানুষটি টেনিসে যা যা পাওয়া সম্ভব, পেয়েছেন প্রায় তার সবই। মানুষের জন্যেও তিনি কাজ করে যাচ্ছেন নিরন্তর। কিন্তু এই ধীরস্থির, সফল, বিনয়ী মানুষটির জীবন-গল্পই ট্রাজেডি ও ধাক্কার বেশ জমজমাট এক থ্রিলার!

লন টেনিস সাধারণত তিন রকমের কোর্টে খেলা হয়- হার্ড কোর্টে, ক্লে কোর্টে আর গ্রাস কোর্টে। এই লন টেনিস নিয়ে একবার খুব অসাধারণ এক মন্তব্য করেছিলেন সাবেক ওয়ার্ল্ড নাম্বার ওয়ান টেনিস গ্রেট জিমি কনরস। তিনি বলেছিলেন-

হয় আপনি একজন হার্ডকোর্ট স্পেশালিস্ট, না হয় একজন ক্লে কোর্ট স্পেশালিস্ট, না হয় একজন গ্রাসকোর্ট স্পেশালিস্ট...অথবা আপনি রজার ফেদেরার!

উপমহাদেশের মানুষের মাতামাতি ক্রিকেট বা ফুটবল নিয়ে একটু বেশিই। টেনিস, ভলিবল, রাগবি, গলফ এসব খেলাকে অতটা পছন্দ করেনা এদেশীয় মানুষজন। তবুও এসব খেলার দুয়েকজন মানুষ এমন হয়, যারা তোয়াক্কা করেন না কাঁটাতারের। সীমানা ভেদ করে তারা ঢুকে যায় সারা পৃথিবীর প্রত্যেক ঘরের অন্দরমহলেই। এরকমই একজন- রজার ফেদেরার। টেনিস খুব একটা অনুসরণ না করলেও রজার ফেদেরার কে চেনেন না এমন মানুষ বোধহয় খুব কমই আছেন। খেলার কারণে যিনি গ্রেটেস্ট, যাকে ডাকা হয় লিভিং লিজেন্ড, সেই মানুষটা যেন আপাদমস্তক মার্জিত ব্যবহারেরই প্রতিমূর্তি। শান্ত, ধীর স্বভাব ও নম্র ব্যবহারের কারণে যাকে সম্মান করতে বাধ্য হয়েছেন কাছেদূরের প্রায় সবাই। টেনিসে যা যা পাওয়া সম্ভব, যিনি পেয়েছেন প্রায় তার সবই। রেকর্ড নিয়ে করেছেন ছেলেখেলা। আদর করে যাকা ডাকা হয় 'ফেড এক্সপ্রেস' ও 'সুইস মায়েস্ত্রো,' আজকের কথাবার্তা সেই মানুষটিকে নিয়েই।

১৯৮১ সালের ৮ই আগস্ট, ফেদেরারের জন্ম। বাবা সুইজারল্যান্ডের ব্যাসেল এর নাগরিক সুইস-জার্মান রবার্ট ফেদেরার ও মা সাউথ আফ্রিকান লিনেট ফেদেরারের ঘর আলো করে আসেন রজার ফেদেরার। এ বিষয়ে একটি তথ্য জানিয়ে রাখা ভালো। বাবা সুইস ও মা সাউথ আফ্রিকান হওয়াতে যেটা হয়েছে, ফেদেরার একইসাথে সুইজারল্যান্ড ও সাউথ আফ্রিকার দ্বৈত নাগরিক।

পড়াশোনা নিয়ে খুব বেশি আগ্রহ না থাকা ফেদেরারের ছোটবেলা থেকেই পছন্দের খেলা ফুটবল । নিজে অবশ্য ফুটবল খেলতেন না। খেলতেন ব্যাডমিন্টন ও বাস্কেটবল। তবে খেলাধুলা বেশিদিন বজায় রাখা সম্ভব হয়না, খেলাধুলা বাদ দিয়ে ফেদেরারকে যেতে হয় সামরিক বাহিনীতে। সুইজারল্যান্ডের একটি প্রথা হচ্ছে, সেদেশের প্রত্যেক পুরুষ নাগরিককে বাধ্যতামূলকভাবে সুইস সশস্ত্রবাহিনীতে যোগ দিয়ে সামরিক কাজ এ অংশগ্রহণ করতে হবে। ফেদেরারও সে দায়িত্ব পালনেই গিয়েছিলেন। কিন্তু পিঠের ব্যথার কারণে রজার এই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পান অল্পবয়সেই। এরপর তিনি মনোযোগ দেন টেনিসে। ফেড এক্সপ্রেসের প্রফেশনাল টেনিস ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। জুনিয়র খেলোয়াড় হিসেবে উইম্বলডনে খেলতে যায় সে। এবং প্রথমবারেই বাজিমাত। সিঙ্গেলস ও ডাবলস দুই ক্যাটাগরিতেই ট্রফি জেতার পরে সে সম্মানজনক 'অরেঞ্জ বল'ও পেয়ে যায়। একই বছরে আরো কয়েকটা কম্পিটিশনে পার্টিসিপেট করে সে। চ্যাম্পিয়নও হয়। বছরটি ফেদেরার শেষ করে ওয়ার্ল্ড র‍্যাংকিং এ নাম্বার ওয়ান জুনিয়র প্লেয়ার হয়ে।

এরপরেই আস্তে আস্তে ফেদেরারের পাখা মেলে ওড়া শুরু। ২০০১ সালের উইম্বলডনে প্রথম ইন্টারন্যাশনাল ব্রেকথ্রু পান তিনি। যেখানের একটি ম্যাচে ১৯ বছরের ফেদেরার মুখোমুখি হন চার বারের ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন এবং যাকে ধরা হয় অলটাইম গ্রান্ড-স্লাম লিডার, পিট স্যাম্প্রাসের। অদ্ভুত বিষয় হলো, রজার ফেদেরার তাকে হারিয়ে দেন প্রবল পরাক্রমে এবং উঠে যান কোয়ার্টার ফাইনালে। যদিও পরে কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই তাকে বাদ পড়তে হয়, তবে স্যাম্প্রাসকে হারিয়ে দেওয়ার এই ঘটনাটি ফেদেরারকে বেশ বড়সড় এক গ্লোবাল রিকগনিশন এনে দেয়।

২০০৩ সাল ফেদেরারের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এ বছরেই তিনি উইম্বলডনে সর্বপ্রথম গ্রান্ড স্ল্যাম সিঙ্গেলস টাইটেল জেতেন। ২০০৪ সালে এসে ফেদেরার টানা ৩টি গ্রান্ড স্লাম টাইটেল জেতেন এবং ১৯৮৮ সালের পরে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি টানা তিনটি গ্রান্ড স্লাম টাইটেল জিতেছিলেন। এবং আরো কিছু শিরোপা তিনি যেতেন এ বছরে এসে, ওয়ার্ল্ড র‍্যাংকিং এ প্রথমবারের মত নাম্বার ওয়ানও হয়ে যান। কিন্তু এত সাকসেসফুল একটা বছরের পরেরটাতেই হোঁচট। ২০০৫ এর অস্ট্রেলিয়ান ওপেন এবং ফ্রেঞ্চ ওপেন, দুটিরই সেমিফাইনাল থেকে বাদ পড়ে যান। তবে উইম্বলডনে তিনি আবার ফিরে আসেন আগের ফর্মে। উইম্বলডন আর ইউএস ওপেন দুটিই জেতেন। উইনিং মোমেন্টাম নিয়েই বছর শেষ করেন তিনি।

২০০৬ কে ধরা হয় ফেদেরারের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে সেরা সিজন হিসেবে। এবং অনেক ক্রিটিকের মতে এটি টেনিসেরই ইতিহাসের অন্যতম সেরা সিজন। ফেদেরার এ বছরে রেকর্ডসংখ্যক ১২টি সিঙ্গেলস টাইটেল জেতেন! শুধু এটুকু বললে পুরোটা বলা হবেনা। এ বছরে তিনি ১৭টি টুর্নামেন্ট খেলেন যার ১৬টিরই ফাইনালে গিয়েছিলেন তিনি! চারটি গ্রান্ড স্ল্যামের ফাইনালে খেলেন, যার মধ্যে তিনটিতেই জিতেছিলেন , জিততে পারেননি একটিতে। ফ্রেঞ্চ ওপেনে, লাল দুর্গের রাজা রাফায়েল নাদালের কাছে হেরে গিয়েছিলেন তিনি। এবং এটাই ছিলো কোনো গ্রান্ড স্ল্যাম ফাইনালে ফেদেরার ও নাদালের সরাসরি লড়াই। এবং ১৯৬৯ সালের রড লেভারের পরে রজার ফেদেরারই একমাত্র টেনিস খেলোয়াড় যিনি টানা চারটি গ্রান্ড স্ল্যামের ফাইনালে খেলেছিলেন। ২০০৭ সালে এসে তিনি আবার চারটি গ্রান্ড স্ল্যামের ফাইনালে খেলেন এবং তিনটিতে আবারো জেতেন।

২০০৮ সালে এসে এমন একটি বিষয়ের সাথে দেখা হয় ফেদেরারের, যে জিনিসটির সাথে তাঁর দেখা হয়েছে এরপর অনেকবারই, যে জিনিসটি তাঁর ক্যারিয়ারকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে বেশ ক'বারই। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, ইনজুরি। ব্যাক ইনজুরিতে পড়ে এ বছরে খুব বেশি কিছু করা হয়নি। একটাই মাত্র গ্রান্ড স্ল্যাম জিতেছেন। তবে এ বছরের অলিম্পিকেই আবার ডাবলসে স্বর্ন জিতে যান স্টান ভাভরিঙ্কার সাথে, যৌথভাবে।

২০০৯ সালে রজার ফেদেরারের সীজন শুরু হয় ১৩টি গ্রান্ড স্ল্যাম নিয়ে। আর একটি হলেই ধরে ফেলা যাবে পিট স্যাম্প্রাসের রেকর্ডকে। কিন্তু হোঁচট খান ফেদেরার আবার। তিনটি গ্রাণ্ড স্ল্যামেই হেরে যান। জেতেন শুধু ফ্রেঞ্চ ওপেনে। সেটি জিতেই স্যাম্প্রাসের সাথে যৌথভাবে হয়ে যান সর্বোচ্চ গ্রান্ড স্ল্যামের মালিক।

এরপরের সময়ে কখনো জিতেছেন কখনো হেরেছেন। ২০১০, ২০১১ তে ব্যক্তিগতভাবে বেশ কিছু ভালো রেকর্ড হয়েছে তাঁর। ২০১২ তে এসে আবার তিনি নাম্বার ওয়ান হয়ে যান ওয়ার্ল্ড র‍্যাংকিং এ । অসাধারণ এক সীজন কাটান ২০১২ তে। কিন্তু ২০১৩ তে এসে আবার সেই ইনজুরি। র‍্যাংকিং এ নীচে পড়ে যান আবার। ২০১৪ তে ডেভিস কাপে বেশ সাফল্য পান। ২০১৫তে উইম্বলডন আর ইউএস ওপেনের ফাইনালে খেলেন। মোমেন্টাম একটু একটু করে ফিরছিলো। কিন্তু ২০১৬ তে ফিরে আসে সেই পুরোনো শত্রু, ইনজুরি। সবাই ভেবেছিলেন, ফেদেরারের সময় বুঝি ফুরিয়ে এলো! ফেদেরারের বয়স তখন ৩৫, যে বয়সে অনেক খেলোয়ারই চিন্তা করেন অবসরের। কিন্তু অনেকের সাথে তাঁর পার্থক্য তো এখানেই, তিনি অবসর তো নেনই না, বরং দুর্দান্তভাবে কামব্যাক করেন এর পরের বছরেই, ২০১৭ সালে। গ্রান্ড স্ল্যামস টাইটেল জেতেন, নাদালকে হারিয়ে অস্টেলিয়ান ওপেনেরও শিরোপা জেতেন। রিভেঞ্জ, কামব্যাক সবই হয়ে যায় একসাথে। ২০১৮ সালে এসে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতে বিশতম গ্রান্ড স্ল্যামের মালিকও হয়ে যান তিনি। এবং তিনিই সর্বপ্রথম এবং একমাত্র ব্যক্তি যিনি বিশটি গ্রান্ড স্ল্যাম জিতেছেন। কিন্তু আবারও ছন্দপতন। ২০২০ সালে এসে আবারো ইনজুরি, ডান হাঁটুর সার্জারি করে এখন বিশ্রামেই আছেন ফেদেরার। আশা করা যাচ্ছে, সব ঠিক হলে আগামী বছর তিনি আবার ফিরবেন। বিশ্বব্যাপী তাঁর দর্শকদেরও সেটাই প্রত্যাশা।

রজার ফেদেরারের এত সব সাফল্যের পেছনে প্রথম কারণ তাঁর অধ্যাবসায়। খুব বেশি বাইরের কাজকর্মে মনোযোগ না দিয়ে নিষ্ঠাভরে তিনি টেনিস নিয়েই থাকেন। দ্বিতীয় কারণ- তাঁর সলিড টেকনিক। নিজে খুব একটা পাওয়ার টেনিস খেলেননা। তিনি ক্লাসিক স্টাইলে খেলেন, সেইসাথে প্রতিপক্ষকে দিয়ে প্রচুর ভুল করান। একটা সময়ে ভালো সার্ভ করতে পারতেন না। প্রচুর পয়েন্ট খোয়াতেন। কাজ শুরু করলেন তা নিয়ে। এখন তার সার্ভকে ভয় পায় প্রতিপক্ষের প্রায় সবাই। সচরাচর বেইসলাইন ধরে খেললেও মাঝেমধ্যে চলে আসেন নেটে। তাঁর ফোরহ্যাণ্ড শট তো পৃথিবী-বিখ্যাতই হয়ে গিয়েছে এখন । এছাড়াও ব্যাকহ্যান্ড স্ম্যাশ, স্কাইহুক, হাফভলির জন্যেও বিখ্যাত ফেদেরার। একসময়ে তৈরী করলেন একটা বিখ্যাত স্টাইল, নাম- এসএবিআর। স্নিক এ্যাটাক বাই রজার। একরকমের এ্যাগ্রেসিভ রিটার্ন। এরপর খেলার মাঝে আনা শুরু করলেন ড্রপশট। এমনিতেও তাঁর খেলা অনেকটাই ধাঁধার মতন। প্রত্যেক সীজনেই আসতেন তিনি নতুন নতুন শট নিয়ে। স্টাইল নিয়ে। প্রতিপক্ষ বিপদে পড়ে যেতো। ফেদেরার হয়তো হাসতেন মনে মনে আর বলতেন- দ্যাখো, কেমন বোকা বানালাম!

রজার ফেদেরারের ক্যারিয়ারের গ্রাফ অনেকটাই উঁচুনিচু। ক্যারিয়ারের ইনজুরির বিষয়টি যদি লক্ষ্য করি, তাহলে ফেদেরারের সাথে তুলনা হবে আমাদের মাশরাফির। ক্যারিয়ারে মাঝেমধ্যেই এসে হামলে পড়েছে ইনজুরি, অথচ ঠিকই কামব্যাক করেছেন আবার। সব গ্রেটদের গল্পটা মনেহয় এমনই হয়। হাল না ছাড়ার মানসিকতার। ফিনিক্স পাখির মত পুনর্জন্মের।

তবে ফেদেরারের ক্যারিয়ারের গ্রাফটা যেমনই হোক, ব্যক্তি ফেদেরার বরাবরই ছিলেন শান্ত, নীরব ও কাজে মনোযোগী। তবে জেনে অবাক হবেন, তার শুরুটা কিন্তু এমন না মোটেও। টিনেজ বয়সে যখন তিনি খেলা শুরু করেন, তখন তিনি ছিলেন বদমেজাজি এক কিশোর। মাঠে রাগারাগি, ব্যাট ছুঁড়ে ফেলে দেয়া...সবই করেছেন। কিন্তু এরমধ্যেই হুট করে ঘটে গেলো এক ঘটনা। তখন ফেদেরারের বয়স ২১। তাঁর প্রিয় কোচ পিটার কার্টার এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলেন। এই ঘটনাটি ফেদেরারকে নাড়িয়ে দেয় পুরোপুরি। জীবন সম্পর্কে ধারণা পালটে যায়। এবং জীবনের সাময়িকতা তাকে স্তব্ধ করে দেয় ভেতর থেকে। তারপর থেকে ফেদেরার হয়ে যান সম্পূর্ণ এক ভিন্ন মানুষ। গলা উঁচিয়ে আর কথা বলেননি এরপরে আর কোনোদিনই।

ফেদেরারকে আমরা গ্লোবাল প্লেয়ার বলে চিনি। আসলেই তিনি গ্লোবাল। এ পর্যন্ত তিনি ২৩টি দেশের টেনিস কম্পিটিশনে পার্টিসিপেট করেছেন এবং এরমধ্যে ১৫টি দেশ থেকে চ্যাম্পিয়নশিপও এনেছেন। যখনই যে দেশে গিয়েছেন, সে দেশের আনাচেকানাচে ঘোরার চেষ্টা করেছেন। এসেছেন এই উপমহাদেশেও, ভারতে। শচীন টেন্ডুলকারের সাথে বেশ ভালোই সখ্যতা তাঁর। শচীন যেমন তাঁর খেলা দেখতে ছুটে গিয়েছেন উইম্বলডনে। ফেদেরারও এসেছেন ভারতে। ক্রিকেট খেলা ভালো লাগে কী না, এ প্রসঙ্গে ফেদেরার হেসেহেসেই বলতেন-

যে খেলায় বল থাকে, আমার সেই খেলাই ভালো লাগে।

রজার ফেদেরার ও শচীন টেন্ডুলকার

তাছাড়া বিখ্যাত গলফ খেলোয়াড় টাইগার উডসের সাথেও সখ্যতা তার। এছাড়া যে রাফায়েল নাদালের সাথে এত দ্বৈরথ খেলার মাঠে, খেলার বাইরে তাদের সম্পর্কও খুবই ভালো। মজার ব্যাপার হলো, তিন প্রতিদ্বন্দ্বী- ফেদেরার, নাদাল ও জোকোভিচকে কিন্তু এক টীমেও খেলতে হয় মাঝেমাঝে। চমকে গেলেন? হ্যাঁ, এটাই সত্যি। লেভার কাপে টীম ইউরোপের প্রতিনিধিত্ব করেন এই তিনজন। খেলেনও একসাথে। আর কোন খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বীদের একসাথে খেলার নজির আছে বলে আমার জানা নেই। ভাবুন তো- মেসি, রোনালদো আর নেইমার এক টীমে খেলছে? কেমন লাগছে ভাবতে?

ব্যক্তিগত জীবনেও তাঁর রয়েছে চমক। স্ত্রী মিরোস্কালাভা মিরকার সাথে প্রথম দেখা হয় সিডনি অলিম্পিকে। সেখান থেকেই বন্ধুত্ব, দশ বছরের প্রেম, বিয়ে। দুটি যমজ ছেলে ও যমজ মেয়ে রয়েছে তাদের পরিবারে। যখনই কোনো ট্যুরে যান, পরিবারকে নিয়ে যেতে কখনো ভোলেন না ফেদেরার। প্রফেশনের কারণে পরিবারকে বঞ্চিত তিনি কোনোদিনই করেননি।

রজার ফেদেরারের স্ত্রী ও চার সন্তান

পিয়ানো বাজাতে পছন্দ করেন তিনি। তাঁর এই সবসময়ে ক্লিন শেভড হয়ে থাকার পেছনেও রয়েছে রহস্য। জিলেট রেজরস' এর ব্রাণ্ড এ্যাম্বাসেডর তিনি। সেকারণেই দাঁড়িগোফ গজাতে পারেনা ফেদেরারের গালে, মুখে।

রজার ফেদেরারের রয়েছে 'রজার ফেদেরার ফাউন্ডেশন', যে ফাউন্ডেশন থেকে দরিদ্র ও দুস্থ শিশুদের শিক্ষার ও খেলাধুলার জন্যে সবসময়েই কাজ করা হয়। সাউথ আফ্রিকার বেশ কিছু অর্গানাইজেশনের সাথেও সম্পর্ক রয়েছে তার, মাঝেমধ্যেই খেলাধুলা থেকে প্রাপ্ত টাকাপয়সা দুস্থ ও বন্যাদুর্গতদের জন্যে বিলিয়ে দেন তিনি। ইউনিসেফেরও শুভেচ্ছাদূত তিনি। এইডস নিয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে তিনি বেশ সরবও। তাছাড়া মাঝেমধ্যে চ্যারিটি ম্যাচেরও আয়োজন করেন ফেড এক্সপ্রেস। যেসব ম্যাচে বিল গেটস, রাফায়েল নাদাল থেকে শুরু করে অনেকেই খেলেন। এবং এসব ম্যাচ থেকে যে টাকা আসে তার পুরোটাই দুর্গত মানুষদের জন্যে ব্যয় করা হয়। এভাবেই নিজের মত করে মানুষকে সাহায্য করে যাচ্ছেন তিনি।

টেনিস মাঠে প্রতিদ্বন্দী, অথচ বাস্তবে বেশ ভালোই সখ্যতা তাদের

২০১১ সালের এক গবেষণায়, ফেদেরারকে বিশ্বের সবচেয়ে সম্মানিত, শ্রদ্ধার ও ভালোবাসার মানুষের র‍্যাংকিং এ দুই নাম্বারে রাখা হয়। এক নাম্বারে রাখা হয়েছিলো নেলসন ম্যান্ডেলাকে। বিল গেটস, স্টিভ জবস, অপরাহ উইনফ্রে এর আগে তাকে রাখা হয়েছিলো র‍্যাংকিং এ। ২০১৬ সালে তাকে ধরা হয়েছিলো সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে সম্মানিত মানুষ হিসেবে। ২০১৭ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অব ব্যাসেল থেকে পেয়েছেন সম্মানজনক ডক্টরেট ডিগ্রিও। এইতো কিছুদিন আগেই সুইস কয়েনে খোদাই করা হলো ফেদেরারের মুখ, দেয়া হলো তাকে ট্রিবিউট। জীবদ্দশায় সুইজারল্যান্ডের আর কোনো নাগরিককে এরকম বিরল সম্মান দেয়া হয়নি। এ পর্যন্ত যিনি জিতেছেন ২০টি গ্রান্ড স্ল্যাম, ৪টি টেনিস মাস্টার্স কাপ, ১৫টি টেনিস মাস্টার্স সিরিজ শিরোপা। তিনিই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি পরপর পাঁচ বছর উইম্বলডন ও ইউএস ওপেন শিরোপা জিতেছেন। সারাবিশ্বের ভক্তরা মানুষটিকে একটু বেশিই পছন্দ করেন। ভক্তদের ভোটে এটিপি ফ্যানস ফেভারিট এ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন টানা ১৭ বছর। বিবিসি'র ওভারসিজ স্পোর্টস পার্সোনালিটি এ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন চারবার। এছাড়াও সুইস স্পোর্টস পার্সোনালিটি নির্বাচিত হয়েছেন টানা ১৭বার। আরো কত যে পুরস্কার, তার সীমাসংখ্যা নেই। কিন্তু অপরপ্রান্তের মানুষটি শীতের রাতের পুকুরের মতন নীরব, শীতল, শান্ত। আপাদমস্তক ধীরস্থির এক মানুষ, মুখে সুন্দর একঝলক হাসি আর খেলতে নেমে চিতাবাঘের মত হিংস্র, তিনিই রজার ফেদেরার। যিনি বলেন-

র‍্যাকেট ছুড়ে মারা, খেলার মাঝে উত্তেজিত হয়ে যাওয়া...এগুলো এখন আর আসেনা। খেলার মাঠে প্রতিপক্ষ যখন এগুলো করে, আমি মনে মনে একটুখানি হাসি। কিন্তু সেটা আমার জন্যে কোনো সমস্যা না। আমি খেলতে এসেছি। খেলেই যাই একমনে।

শুভ জন্মদিন, সুইস জাদুকর, দ্য ফেড এক্সপ্রেস। কিংবদন্তিরা বুঝি এরকমই হয়। পাহাড়ের মত স্থির, ধ্যানী, অবিচল। এরকম হওয়াটাই হয়তো নিয়ম। আপনিও বা ব্যতিক্রম হবেন কেন?

  •  

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা