একাত্তরে সম্ভ্রম হারিয়েছেন। একাত্তরের পরে হারালেন পরিবার। এরপরের গোটাজীবন ধরে যে যুদ্ধটা তিনি লড়লেন, সে যুদ্ধের গল্পটা জানেন কয়জন!

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মুক্তিযোদ্ধা, হানাদার, রাজাকার নিয়ে যত কথাবার্তা হয়, বীরাঙ্গনাদের নিয়ে কেন যেন তার সিকিভাগও কথাবার্তা হয় না। হয়তো আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাদের নিয়ে কথা বলতে সংকোচবোধ করে। হয়তো সংকোচ না, হয়তো অন্য কোনো কারণে তারা বলেন না। শুধু সেটাই নয়, যুদ্ধের পরে অনেক বছর ধরেই এই নির্যাতিত নারীরা কোনো স্বীকৃতিও পান নি রাষ্ট্রের কাছ থেকে। এই তো সেদিন, ২০১৪ সালে এসে একাত্তরে সম্ভ্রম হারানো নারীদের 'বীরাঙ্গনা' বলে স্বীকৃতি দেয়া হলো। এর আগে তাদের নিয়ে সেরকম আলোচনাও শুনিনি। তবে আলোচনা হোক আর না হোক, বীরাঙ্গনাদের ত্যাগ ও অবদানের গল্পগুলো তাতে একটুও খাটো হবেনা৷ তাদের সীমাহীন কষ্টের গল্পগুলো রয়ে যাবে ভাস্বর, চিরন্তন। ভাস্বর রয়ে যাবে বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরী'র গল্পও।

১৯৩৬ সালে চট্টগ্রামে জন্ম তাঁর। প্রগতিশীল পরিবারের সন্তান হওয়ায় পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়েছেন নিয়মিত। দক্ষিন চট্টগ্রামের প্রথম নারী স্নাতকোত্তর (এমএ) ধরা হয় তাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ডিগ্রি অর্জনের পরের বছরেই তিনি কক্সবাজার বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে আসেন। শুরু হয় কর্মজীবন। ষোলো বছর ধরে তিনি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেছেন।

এরপরেই যুদ্ধ শুরু। শহরে, গ্রামে, পাড়া, মহল্লায় নারীদের উপর নির্যাতনও হয়েছে শুরু। তিন সন্তানের জননী তখন তিনি। স্বামী চলে গিয়েছেন ভারতে। বৃদ্ধা মা, তিন সন্তান নিয়ে রমা পড়ে থাকেন গ্রামের বাড়িতে। একদিন সকালে তাদের বাড়িতে চড়াও হয় হানাদারেরা। সম্ভ্রমহানি হয় রমা চৌধুরীর। সন্তানেরা ও বৃদ্ধা মা বেঁচে যান পাকেচক্রে৷ রমা চৌধুরী জীবন বাঁচাতে আশ্রয় নেন পুকুরের মধ্যে। পুকুরে থেকেই দেখতে পান, হানাদারেরা পুরো বাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে গানপাউডার দিয়ে। বাড়িতে থাকা বইখাতা যখন হানাদারেরা জ্বালিয়ে দিয়েছেন, মানসিকভাবে প্রচণ্ড ধাক্কা খান রমা চৌধুরী।

সম্ভ্রম, নিজের ঘর, সহায়সম্পত্তি সব হারিয়ে আত্মহননের পথই বেছে নিচ্ছিলেন প্রায়। সন্তানদের মুখ মনে পড়ায় সে পথ থেকে ফিরে আসেন৷ যুদ্ধের বাকি সময়টা বৃদ্ধা মা ও সন্তানদের নিয়ে জঙ্গলে, বনে-বাদাড়ে লুকিয়ে কাটান। রাত হলে আগুনে পোড়া ভিটেতে ফিরে এসে পলিথিনের নীচে কোনোরকমে রাত কাটাতেন।

এসব নিদারুণ কষ্টের বর্ণনা আছে রমা চৌধুরীর লেখা 'একাত্তরের জননী' বইতে। জাহানারা ইমামের 'একাত্তরের দিনগুলি' যেমন অবশ্যপাঠ্য। তেমনি অবশ্যপাঠ্য এ বইটিও। এক বীরাঙ্গনার বেঁচে থাকার লড়াইয়ের আদ্যোপান্ত বিবরণ আছে বইয়ের প্রত্যেক পৃষ্ঠায়।

'একাত্তরের জননী' বইটি ইতিহাসেরই এক অনন্য দলিল

যাই হোক, যুদ্ধ শেষ হয়। বিজয় অর্থাৎ ১৬ দিবসের আগের দিন শ্বাসকষ্টে ভুগে মারা যায় তাঁর এক সন্তান। এই একইভাবে মারা যায় দ্বিতীয় সন্তান। তৃতীয় সন্তানকে ওষুধ খাওয়াতে গিয়ে ভুলক্রমে শ্বাসরোধ করে মেরে ফেলেন তিনি। সন্তানদের হারিয়ে তিনি পাগলপ্রায়। ততদিনে স্বামী ফিরে এসেছেন ভারত থেকে। তিনিও ধর্ষিতা স্ত্রী'কে গ্রহণ করেন না। ত্যাগ করেন।

রমা চৌধুরী সব হারিয়ে পথে নামেন। দ্বিতীয় বিয়েও করেন। সে বিয়ের সন্তানও মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনায়। দ্বিতীয়পক্ষের স্বামীও তাঁর সাথে প্রতারণা করেন। তাকে ভোগ করে ফেলে দেন রাস্তায়।

রমা চৌধুরী তখন স্বাভাবিক চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতাও হারিয়েছেন। কিন্তু বেঁচে তো থাকতে হবে। তিনি কলমককে আঁকড়ে ধরেন, লেখালেখিকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। পাক্ষিক একটা পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। সে পত্রিকা থেকে তাকে বেতন দেয়া হতোনা। পত্রিকার পঞ্চাশ কপি দেয়া হতো। রোদ, জল, শীত... যেরকমই সময় হোক, তার মধ্যে হেঁটে হেঁটে সেই পত্রিকাগুলো তিনি বিক্রি করতেন। নিজের খাবার খরচ চালাতেন।

মৃত্যুর আগের পুরোটা সময়জুড়ে লিখেছেন বিশটির মত বইও। 'একাত্তরের জননী' বইটা তো আছেই। এছাড়াও বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখেছেন আরো বই। সেই সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শহীদের জিজ্ঞাসা, স্বর্গে আমি যাবো না, ভাব বৈচিত্র্যে রবীন্দ্রনাথ, চট্টগ্রামের লোকসাহিত্যে জীবন দর্শন, অপ্রিয় বচন, লাখ টাকা, হীরকাঙ্গুরীয় সহ গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস ধরণের কিছু বই লেখেন তিনি। সে বইগুলো তিনি নিজে হাতে করে বিক্রি করতেন বিভিন্ন জায়গায়।

তবে যতই কায়ক্লেশে দিনযাপন করুন না কেন, কখনো কারো কাছে হাত পাতেননি তিনি কোনোদিন। প্রধানমন্ত্রী তাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু শ্রদ্ধাভরেই তা প্রত্যাখান করেছেন তিনি। বলেছেন, যা তিনি উপার্জন করছেন সেটিই যথেষ্ট। আর কিছু লাগবে না।

তাঁর তৃতীয় সন্তান যখন মারা যায়, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন, এখন থেকে খালি পায়ে হাঁটবেন তিনি। মৃত্যুর আগে পনেরো বছর ধরে খালি পায়েই হেঁটেছেন তিনি। বলেছিলেন, যে মাটিতে তাঁর সন্তানেরা শুয়ে আছে, সে মাটিতে তিনি স্যান্ডেল পায়ে হাঁটতে পারবেন না। হাঁটেনওনি। যুদ্ধে সম্ভ্রম হারিয়েছেন, যুদ্ধের পর পরিবার হারিয়েছেন, তাও শিরদাঁড়া টা বরাবরই ছিলো সোজা। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি হেঁটে গিয়েছেন তাঁর নিজেরই শক্তিতে। রমা চৌধুরীকে যদি আমরা ভুলে গিয়ে থাকি, তাহলে সেটি আমাদের ব্যর্থতা। যদি আমরা মনে রাখতে পারি তাকে, যদি তাঁর অবদানকে বিনম্রচিত্তে আমরা স্মরণ করতে পারি, তাহলে সেটিই আমাদের সার্থকতা। এই ছোট্ট ভূখণ্ডের সার্থকতা।

ভালো থাকবেন, মা। বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি রইলো।

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা