ব্যাংক কর্মকর্তাদের নির্যাতন করে, খুনের হুমকি দিয়ে সবার নাকের ডগা দিয়ে এয়ার এম্বুলেন্সে দেশ ছেড়েছিলে দুই ভাই। ভ্যাকেশন শেষ, এখন তারা দেশে ফিরতে চাইছেন, সেটাও বেআইনীভাবে! এ যেন বাস্তবের এক্সট্র্যাকশন সিনেমা!
চাহিদামতো ঋণ না দেয়ায় একটা ব্যাংকের এমডি সহ কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে গুলি করেছিলেন তারা, নিজেদের অফিসে আটকে রেখে নির্যাতন চালিয়েছিলেন, খবরটা প্রকাশিত হবার পর আলোড়ন পড়ে গিয়েছিল চারিদিকে। এদেশে ভিআইপি এবং প্রভাবশালীরা চাইলেই যে ইচ্ছেমতো যা খুশি করতে পারে, এবং অপকর্ম করে বুক ফুলিয়ে সবার নাকের ডগা দিয়ে নিরাপদে দেশও ছাড়তে পারে- সেটার একটা চমৎকার কেস স্টাডি হয়ে আছে শিকদার গ্রুপের এমডি রন হক শিকদার এবং তার ভাই দিপু হক শিকদারের এই ঘটনাটা।
দুই ভাইয়ের ক্ষমতার দম্ভ অবশ্য এখনও শেষ হয়নি। করোনার কারণে গোটা পৃথিবীর বিমান চলাচল যখন স্থবির, তখন ভাড়া করা এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে রোগী সেজে সিঙ্গাপুরে চলে গিয়েছিল তারা, এদেশের পুলিশ যখন বলছে তারা পলাতক, দুই ভাই তখন বিমানবন্দরে গিয়ে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে বসেছে। মাস দুয়েকের ভ্যাকেশন কাটিয়ে এখন দেশে ফেরার ইচ্ছে হয়েছে তাদের, আর তাই বিদেশে বসেই আগাম জামিনের আবেদন করেছে তারা, সেই আবেদন ভার্চুয়াল আদালতে আজকের কর্মতালিকায় এক নম্বরে আছে। গোটা বিষয়টা জেনে যে কেউই ন্যায়-নীতির কথা ভুলে গিয়ে অর্থ আর ক্ষমতার অন্ধভক্ত হয়ে গেলে তাকে দোষ দেয়া যাব্ব না মোটেও।
অবাক করার মতো ব্যাপার হচ্ছে, হাইকোর্ট বেঞ্চের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বশির আহমেদ আমাদের জানাচ্ছেন, ভার্চুয়াল কোর্টের কার্যক্রম শুরুর পর গত তিন মাসে হাইকোর্টে আগাম জামিনের কোনো বিষয় তিনি দেখেননি। তার কাছ থেকেই আমরা জানতে পারছি, গোটা বিষয়টিই বেআইনী, আগাম জামিনের আবেদন করতে হলে আসামীকে সশরীরে কোর্টে হাজির হতে হবে, অন্য কোথাও বসে আগাম জামিনের আবেদন করার কোন সুযোগ নেই- "জামিনের আবেদনকারীরা বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। আইনের দৃষ্টিতে দেশের বাইরে থেকে আগাম জামিন চাওয়ার সুযোগ নেই।"
অথচ রাষ্ট্রপক্ষ আমাদের জানাচ্ছেন, এই দুই 'ফেরারি আসামী' সিঙ্গাপুরে বসেই আগাম জামিনের জন্য আবেদন করেছেন। গত ২রা জুলাই ইমেইলের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট আদালতে জমা দেওয়া হয়। গতকাল সন্ধ্যায় সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে দেখা গেছে, 'রন হক শিকদার অ্যান্ড এনাদার বনাম রাষ্ট্র' শিরোনামে আবেদনটি ওই বেঞ্চের সোমবারের (আজকের) কার্যতালিকার শীর্ষে রয়েছে। তাদের পক্ষে আইনজীবী হিসেবে আজমালুল হোসেন কিউসি, সাঈদ আহমেদ ও মুহাম্মদ সাইফুল্লাহ মামুনের নাম রয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, আসামীদের আইনজীবি নিজেও দেশে নেই, তিনিও নাকি লন্ডনে বসেই তার মক্কেলদের জন্য জামিনের আবেদন করেছেন!
গত ৭ মে রাজধানীর অভিজাত এলাকা বনানীর ১১ নম্বর সড়কের সিকদার হাউসে ঘটেছিল ন্যাক্কারজনক এই ঘটনাটা। এক্সিম ব্যাংকের এমডি মোহাম্মদ হায়দার আলী মিয়া ও অতিরিক্ত এমডি মোহাম্মদ ফিরোজ হোসেনকে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করেছিলে দুই ভাই রন এবং দিপু। জিম্মি দুজনের ওপর চালানো হয় নির্যাতন। জোর করে সাদা কাগজে সইও নেওয়া হয়। মূলত এক্সিম ব্যাংক থেকে ৫০০ কোটি টাকা ঋণ চেয়ে সময়মতো না পাওয়াতেই চলে এ নির্যাতন।
পরের কয়েকটা দিন একের পর এক নাটক মঞ্চস্থ হয়েছে। মামলা করতে বিলম্ব হয়েছে ভুক্তভোগীদের, গণমাধ্যমে খবরটা প্রকাশের পরে অনেকেরই বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়েছে, এমন কিছু যে বাস্তবেও ঘটতে পারে! এক্সট্র্যাকশন সিনেমা দেখে 'এই বাংলাদেশ প্রকৃত বাংলাদেশ নয়'- এমন যুক্তিতে নেগেটিভ রিভিউ দেয়া মানুষজন চমকে উঠেছে সিনেমার মতো ঘটনা ঘটতে দেখে। একদিকে পুলিশ বলছে দুই ভাইকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, তারা পলাতক, অন্যদিকে পত্রিকায় আমরা জানতে পারছি দুই ভাইয়ের বিদেশ গমনের ব্যবস্থা হয়ে যাচ্ছে, তারা চিকিৎসার জন্য দেশের বাইরে চলে যাচ্ছেন, নির্যাতন করে তারা নিজেরাই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন! মিডিয়ার কল্যানে আমরা আপডেট জানতে থাকলাম, এদিকে আইন-শৃঙখলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে নাকি তাদের কোন খবর নেই!
এসব নাটকের মাঝখান দিয়েই সুড়সুড় করে বিমানে চড়ে সবাইকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমালেন দুই ভাই, আমাদের জানিয়ে দিলেন, এদেশে টাকা যার, ক্ষমতা তার, আইনও তার জন্য অন্যরকম। এখন বিদেশ-বিভুঁই আর ভালো লাগছে না হয়তো, তাই তারা দেশে ফিরতে চাইছেন, সেখানেও আইনের তোয়াক্কা করছেন না তারা। কারণ তারা পাওয়ার প্র্যাকটিস করতে অভ্যস্ত, আইন ভাঙতে অভ্যস্ত, আইন মানতে নয়।
নোয়াখালির এক সাংসদের ছেলে বছর দুয়েক আগে বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালাতে গিয়ে গাড়িচাপা দিয়ে একজনকে মেরে ফেললো। সেই ঘটনার সাক্ষী-প্রমাণ থাকা স্বত্বেও সেটার বিচার হয়নি, এমপি সাহেব বহাল তবিয়তে আছেন, তার ছেলেও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এলাকায়। কয়েকদিন আগে সেই ছেলেই চট্টগ্রামে এক পুলিশের গায়ের ওপর গাড়ি তুলে দিয়েছে। এই ছেলের থাকার কথা ছিল জেলখানায়, তাকে রাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থা আইনের মুখোমুখি করতে পারেনি, কাজেই তার গাড়ির নিচে পড়াটা আমাদের নিয়তি। রাষ্ট্র রন বা দিপু শিকদারদের বিচার না করলে তাদের হাতে নির্যাতিত হয়ে, গুলি খেয়ে মরে যাওয়াটাও আমাদের পরিণতির তালিকায় যোগ হবে।
খারাপ লাগে, যখন দেখি আহমেদ কিশোরের মতো কার্টুনিস্টের জামিনের শুনানি হয় না ভার্চুয়াল কোর্টে, কোর্ট বিব্রতবোধ করেন শুনানি পরিচালনায়, কারণ কিশোরেরা রাষ্ট্রের অনিয়মের দিকে আঙুল তুলেছিলেন, অব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা বলেছিলেন। অথচ নির্যাতনকারী, নিপীড়কদের আগাম জামিনের শুনানি হাইকর্টের কার্যতালিকায় এক নম্বরে থাকে। ছোটবেলায় শুনতাম, আইনের হাত অনেক লম্বা। কিন্ত এমপিপুত্র, রন বা দিপু সিকদারদের দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, প্রভাবশালী এই অপরাধীদের হাত কি আইনের চেয়েও লম্বা? এই প্রশ্নের উত্তর কি আমরা পাব?
*
প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন