কোরআনের আয়াতে করোনাভাইরাস ও একজন গোলাম মাওলা রনি
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
- পড়তে সময় লাগবে মিনিট
সূরা আহযাবে 'ওয়াক্কুরনা' শব্দটি শুনেই যিনি 'ফেসবুক মুমিন'দের মতো মনগড়া থিওরি বানিয়ে করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব আবিস্কার করতে পারেন, তাকে তো একটা নোবেল পুরস্কার দেয়া উচিত!
বাংলাদেশের রাজনীতিতে হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের যোগ্য উত্তরসূরী যদি কেউ থেকে থাকেন, সেটা হচ্ছে গোলাম মাওলা রনি। যে কোন ব্যাপারে নগদে অবস্থান পাল্টাতে তার জুড়ি নেই। আজ তিনি আওয়ামী লীগে তো কাল বিএনপিতে। আজ জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধী বলছেন তো কাল কাদের মোল্লা কত ভালো লোক ছিলেন, রমজান মাসে কেন রাজাকার সাঈদীকে মুক্তি দেয়া উচিত সেসব নিয়ে বয়ান ঝাড়ছেন। রনির বাম কাঁধের যে ফেরেশতা, তার সম্ভবত প্রতিদিনই হাত ব্যথা হয়ে যায় আমলনামার খতিয়ান লিখতে লিখতে।
আমাদের এই গোলাম মাওলা রনি এবার নতুন এক আবিস্কার করেছেন। পবিত্র কুরআন পড়ে তিনি নাকি আবিস্কার করেছেন পৃথিবীতে করোনাভাইরাসের আগমনের কারণ! সূরা আহজাবের একটা আয়াতের আরবী এবং বাংলা তরজমা উল্লেখ করে সেটার মনগড়া একটা ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝানোরও চেষ্টা করেছেন যে, এই করোনাভাইরাস আসলে আমাদের পাপাচারের শাস্তি, মানুষের দাম্ভিক আচরণ এবং অশ্লীলতার কারণেই নাকি করোনাভাইরাসের আগমন ঘটেছে ধরাধামে!
রনি লিখেছেন- "আজ আমি পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত করতে গিয়ে সেখানে করোনা শব্দটি প্রায় হুবহু দেখতে পেয়ে চমকে উঠি এবং সংশ্লিষ্ট আয়াতের বাংলা অর্থ পড়ে একেবারে আশ্চর্য হয়ে যাই।
সূরা আহযাবের ৩৩ নম্বর আয়াতটি শুরু হয়েছে - "অক্করনা ফি বুইয়ুতিকুন্না" শব্দমালা দিয়ে। আমি আপনাদের সুবিধার জন্য পুরো আয়াটির তরজমা দিচ্ছি -
'এবং তোমরা স্বগৃহে অবস্থান করবে, প্রথম মূর্খ যুগের মত নিজেদেরকে প্রদর্শন করে বেড়িয়োনা, আর নামায কায়েম করবে, যাকাত প্রদান করবে, আল্লাহ ও তার রাসুলের আনুগত্য করবে, আল্লাহ তোমাদের মধ্যকার অপবিত্রতা দুর করতে চান এবং তোমাদেরকে সর্বতভাবে পবিত্র করতে চান!'
উল্লেখিত আয়াতে বর্ণিত অক্করনা শব্দটির সঙ্গে যদিও বর্তমান করোনার কোন সংযোগ নেই এবং আয়াতটি নাযিল হয়েছিল মূলত মহিলাদেরকে উদ্দেশ্য করে। মহিলাদেরকে জাহিলি জমানার মত বাইরে ঘুরা ফেরা না করে ঘরে থেকে পাক পবিত্রতা অর্জনের বিষয়ে এখানে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
কিন্তু পড়তে গিয়ে অক্করনা শব্দটি যখন উচ্চারণ করলাম এবং ঘরে থেকে প্রবিত্রতা অর্জনের বিষয়ে মহিলাদেরকে দেয়া নির্দেশনার কথা যখন নিজের গৃহবন্দিত্বের সঙ্গে মিলালাম তখন মনে হল এই সময়ে আল্লাহ নির্দেশিত কাজগুলো করে আমিওতো পবিত্রতা অর্জন করতে পারি।
বুঝার চেষ্টা করুন - বর্তমানের করোনা এবং আমাদের গৃহবন্দী থাকার প্রকৃত কারন কি হতে পারে... এটাও অনুধাবনের চেষ্টা করুন যে- আল্লাহ এবং তার কালামে পাকের মুজেজা কি এবং কত বিস্তৃত!
আমার মনে হয় - আমরা বড় বেশি অপবিত্র হয়ে পড়েছিলাম - জাহেলি যুগের মানুষের মত আমরা দম্ভ করে বেড়াতাম এবং শরীর-মন- বুদ্ধি এবং আচরণ দ্বারা শুধু বিতর্ক করার সুযোগ খুঁজতাম, সরল সোজা জিনিসের মধ্যে বনী ইসরাইলদের মত বক্রতা খুঁজতাম এবং অশ্লীলতার মাধ্যমে নিত্য নতুন পাপাচার পয়দা করতাম......."
এই হচ্ছে গোলাম মাওলা রনির আবিস্কার। কি চমৎকারভাবে ধর্মের ট্রাম্পকার্ড খেলে, পবিত্র কোরআন শরীফের আয়াতকে ব্যবহার করে লোকজনের বাহবা কুড়িয়ে নেয়ার একটা চাল দিয়েছিলেন তিনি। কিন্ত 'অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী' বলে একটা বাগধারা আছে বাংলায়, যে বিষয়টা জানেন না, বোঝেন না, সেই বিষয়ে আলগা পণ্ডিতি ফলিয়ে জ্ঞানী সাজতে গেলে ধরা খাওয়ার চান্সটা বেশি। রনিও ধরা খেয়েছেন।
সূরা আহযাবের যে আয়াতের কথা রনি উল্লেখ করেছেন তার স্ট্যাটাসে, তার ঠিক আগের আয়াতে ( সূরা আহজাব, আয়াত-৩২) স্পষ্ট করেই বলা ছিল- "হে নবীর সহধর্মীনিগন, তোমরা অন্য কোন স্ত্রীলোকের মতো নও, যদি তোমরা ধর্ম্ভীরুতা অবলম্বন করো..." এই সূরার ৩২, ৩৩ এবং ৩৪ নং আয়াতে আল্লাহ মহানবীর স্ত্রীদের প্রতি নির্দিষ্ট কিছু নির্দেশ দিয়েছেন, তাদের জীবনধারণের পাথেয় বাতলে দিয়েছেন। অথচ গোলাম মাওলা রনি সেখান থেকে খানিকটা অংশ কোট করে করোনাভাইরাসের আগমনের কারন বের করে ফেললেন, মনগড়া একটা থিওরিও বানিয়ে ফেললেন! ওয়াক্কুরনা শব্দ থেকে যিনি করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব আবিস্কার করতে পারেন, তাকে তো একটা নোবেল পুরস্কার দেয়া উচিত!
একসময় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ছিলেন গোলাম মাওলা রনি, দলেরই এক প্রভাবশালী নেতার বিরাগভাজন হয়ে দলছাড়া হয়েছেন, পরে তার দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং অবৈধ সম্পদের খোঁজ মিলেছে, জেল খেটেছেন। জেল থেকে বেরিয়ে আবার আওয়ামী লীগে ফিরতে চেয়েছেন, মনোনয়নের জন্যে দৌড়ঝাঁপ করেছেন, শিকে ছেঁড়েনি ভাগ্যে। স্বতন্ত্র হয়ে একবার মেয়র নির্বাচন করে গো-হারা হেরেছেন। এরপরে ভোজবাজির মতো অবস্থান পাল্টে বিএনপিতে চলে গেলেন তিনি, ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করলেন, হেরেও গেলেন।
বছরের পর বছর ধরে যিনি খালেদা জিয়া, তারেক রহমান আর বিএনপিকে টকশোতে তুলোধোনা করে এসেছেন, সেই লোক তারেক রহমানের আশীর্বাদ নিয়ে ধানের শীষে ভোট চাইছেন- এর চেয়ে বড় কৌতুক আর কি হতে পারে? এমন নজির গোলাম মাওলা রনির কল্যানেই দেখেছি আমরা। যে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের দাবী তিনি অজস্রবার তুলেছেন, সেই জামায়াতের দণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে তিনি এমনভাবে এখন কথা বলেন যে, 'মায়ের চেয়ে মাসীর দরদ বেশি' প্রবাদটার কথা মনে পড়ে যায়।
কাজেই তিনি যখন কোরআন শরীফের আয়াতকে খণ্ডিত এবং বিকৃতভাবে ব্যবহার করে নিজেকে জাহির করতে চাইলেন, তখন খুব একটা অবাক হইনি। তবে শঙ্কিত হয়েছি। কারণ তার প্রচুর ফ্যান-ফলোয়ার, একশ্রেনীর মানুষের কাছে তার তুমুল জনপ্রিয়তা। তারা অন্ধের মতো বিশ্বাস করে গোলাম মাওলা রনিকে। তার বক্তব্য, তার লেখা কলামের উদ্ধৃতিকে রেফারেন্স হিসেবে হাজির করে। এই লোকগুলো জানেও না, সস্তা খ্যাতির আশায় তাদের অন্ধ বিশ্বাসকে ব্যবহার করে যা খুশি তাই বলে চলেছেন রনি।
ফেসবুকে একশ্রেনীর বকধার্মিকের দেখা পাওয়া যায়। নামাজ-রোজা-ইবাদতের ঠিক নেই, এরা কমেন্টবক্সে ধর্মের প্রচার করে বেড়ায়, পর্দা করার নসিহত দেয়, মাছের গায়ে আল্লাহর নাম লেখা ছবি শেয়ার দিয়ে সুবহানআল্লাহ জিকির তোলে। কুরআন-হাদীসের মনগড়া রেফারেন্স তৈরী করে। এরা সংখ্যায় এক-দুইশো নয়, লাখ লাখ। আমি শঙ্কিত হই, যখন গোলাম মাওলা রনির মতো মানুষজন, যিনি কিনা সাংসদ ছিলেন কয়েক বছর আগে, তিনিও এদের মতো আচরণ করেন, নিজের ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জন্যে আল্লাহ'র কালামকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে হাস্যরসের উদ্রেক করেন। তখন পড়ালেখা না জানা এসব 'ফেসবুক মুমিন'দের সঙ্গে টকশো'র জ্বালাময়ী সবজান্তা শমসের বক্তা গোলাম মাওলা রনির কোন পার্থক্য খুঁজে পাই না...