অভাব-অনটনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া হয়নি রওশন আলীর। কর্মজীবনের ঘানি টেনে চাকরি থেকে অবসরের পরে ভাবলেন, অসমাপ্ত কাজটা শেষ করতে হবে। শুরু করলেন মাস্টার্সের জন্যে পড়াশোনা। দিলেন পরীক্ষাও, তারপর ফলাফলে তিনি চমকে দিয়েছেন সবাইকে...

সিসিলির অধিবাসী গিসেপ্পে প্যাতার্নোর কথা মনে আছে? মনে না থাকলে একটু মনে করিয়ে দেই। বেশ ক'মাস আগে তিনি সারা পৃথিবীতে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন, ৯৬ বছর বয়সে এসে স্নাতক পাস করে। যে ঘটনা সারা পৃথিবীতেই এক অন্যরকম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলো। তবে প্যাতার্নোর মতন মানুষের উদাহরণ কিন্তু খুব একটা কমও না। আশেপাশে খুঁজলে এমন অনেক মানুষকেই পাওয়া যাবে, শিক্ষা নিয়ে প্রবল আগ্রহ থাকার পরেও সময়ের ফেরে যারা হয়তো ঠিকবয়সে পড়াশোনাটা শেষ করতে পারেন নি। তাদের মধ্যে অনেকেই জীবনসায়াহ্নে এসে বহুদিনের আরাধ্য স্বপ্নটিকে পূরণের চেষ্টা চালান। অনেকে সফলও হন। যেমনটি হয়েছেন গিসেপ্পে প্যাতার্নো, যেমনটি হয়েছেন পাবনার রওশন আলী। আজকের গল্প পাবনার রওশন আলীকে নিয়ে। সম্প্রতি যিনি মাস্টার্স পাস করেছেন। তাও জীবনের শেষপর্যায়ে এসে! 

রওশন আলীর বর্তমান বয়স ৭৩। পাবনার চরতারাপুর ইউনিয়নের বান্নাইপাড়া গ্রামের বাসিন্দা রওশন আলী পড়াশোনা শুরু করেন নিজের এলাকাতেই। সুজানগর পাইলট মডেল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনি বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পাস করেছিলেন। এরপর ভর্তি হন পাবনা সরকারি শহীদ বুলবুল কলেজে। সেখান থেকে এইচএসসি পাস করেন। তার ইচ্ছে ছিলো এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করবেন। কিন্তু পারিবারিক নানা সমস্যার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দিতে আর প্রবেশ করা সম্ভব হয়নি তার।

তাছাড়া তখন আশেপাশে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ও ছিলোনা। পড়াশোনার জন্যে যেতে হতো হয়তো ঢাকায় অথবা রাজশাহীতে। কিন্তু পরিবারের কাছ থেকে পড়াশোনা করতে এতদূর যাওয়ার সমর্থন তিনি পাননি।  বাধ্য হয়েই পড়াশোনা স্থগিত করে, রণে ভঙ্গ দিয়ে তিনি চাকরীজীবন শুরু করেন। স্থানীয় এক হাইস্কুলে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু হয় তার। চাকরীর মাঝখানেই তিনি সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ থেকে প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে অনার্স পাস করেন। এরপর আর পড়াশোনা করা হয়নি। পরিবার, কর্মক্ষেত্রের নানাবিধ চাপে পড়াশোনাতে আর তিনি চাইলেও যুক্ত হতে পারেননি। 

২০০৮ সালে কর্মজীবন থেকে অবসর পান রওশন আলী। অখণ্ড অবসর। ছেলেদের মানুষ করেছেন। তাদের আলাদা আলাদা সংসার হয়েছে। সংসারের অতটা চাপও নেই এখন। এই তো সুযোগ, ভেতরে ভেতরে জিইয়ে রাখা পড়াশোনার ইচ্ছেটাকে নিয়ে আবারও ঝাঁপিয়ে পড়ার। সেটিই করেন তিনি। সিদ্ধান্ত নেন, এবার মাস্টার্স পাস করতেই হবে। হাতে সময় আর অখণ্ড অবসর তো আছেই। যা ভাবা তাই কাজ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্সের সান্ধ্যকালীন কোর্সে ভর্তি হয়ে যান তিনি। সেখানেও আছে এক অন্যরকম গল্প। তিনি প্রতিদিন পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে ঘুরঘুর করতেন। একদিন তিনি দেখেন, দেয়ালে একটা পোস্টার। সান্ধ্যকালীন কোর্সের জন্যে ভর্তি হওয়া যাবে। তিনি তখনই লুফে নিলেন সুযোগ। ভর্তিপরীক্ষা নেয়া হলো একটা। সেটাতে কৃতকার্য হয়ে ভর্তি হলেন তিনি। এরপর নিয়মিত ক্লাস ও পড়াশোনা করে  পরীক্ষাতেও অংশ নেন। সেই পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি। সিজিপিএ ৩.৫০ পেয়ে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়েছেন রওশন আলী! 

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমেই নিজের স্বপ্নকে সত্যি করেছেন রওশন আলী! 

এ ঘটনা পুরো এলাকায় বেশ অন্যরকম এক দ্যোতনা ছড়িয়েছে। রওশন আলীর প্রাক্তন কর্মপ্রতিষ্ঠানের সহকর্মীরা, পরিবারের সদস্যরা, এলাকাবাসী তার এই সাফল্যে বেশ খুশি। সবার মুখেমুখেই ফিরছে তার এই সাফল্যের খবর। সবার জন্যেই এক 'অনুপ্রেরণা' হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন তিনি। সে সাথে তিনি যেন মনে করিয়ে দিয়েছেন বহু প্রাচীন সেই আপ্তবাক্যও- 

শিক্ষার কোনো বয়স নাই! 

রওশন আলীর জন্যে শুভকামনা। 

তথ্যসূত্র: দ্য বিজনেস স্টান্ডার্ড বাংলা 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা