মনে আছে আপনাদের তার কথা? ঐ যে স্বামীর পাশবিক নির্যাতনে চোখ হারালেন, তারপর? হারিয়ে গিয়েছেন? না। ঘুরে দাঁড়িয়েছেন মাথা উঁচু করেই।

মনে আছে আপনাদের তার কথা? ঐ যে স্বামীর পাশবিক নির্যাতনে চোখ হারালেন, তারপর? হারিয়ে গিয়েছেন? না। ঘুরে দাঁড়িয়েছেন মাথা উঁচু করেই।  

ঘটনার সূত্রপাত, ২০১১ সালে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ছিলেন রুমানা মঞ্জুর। সাথে  ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলম্বিয়ার শিক্ষার্থীও ছিলেন। ছুটি কাটাতে দেশে আসেন। ৫ই জুন নির্যাতনের এক পর্যায়ে, স্বামী হাসান সাইয়িদ তাকে চোখ ও নাকে আঘাত করেন। এতে তার চোখ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এক পর্যায়ে চিরতরে অন্ধ হয়ে যান। 

সমাবর্তনে বক্তৃতা দিচ্ছেন রুমানা মঞ্জুর

এতো প্রতিকূলতাও তাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। শারীরিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও নিজের শিক্ষা জীবনকে ব্যাহত হতে দেননি। দৃষ্টিশক্তি হারানোর পর, ব্রেইলি পদ্ধতিতে আবারও পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। ২০১৩ সালে মাস্টার্স শেষ করার পর কানাডার ইউবিসির পিটার এ অ্যালার্ড স্কুল অব ল তে পড়াশোনা শুরু করেন। ঘটনার ৭ বছরের মাথায়, ২০১৮ সালে পড়া শেষ করেন এবং কানাডার আইনজীবী বারে যান রুমানা। অতঃপর, জুনিয়র পরামর্শক হিসেবে কাজ শুরু করেছেন কানাডায় বিচার বিভাগের আদিবাসী আইন বিভাগে।

সিটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি তাঁর কঠিন সময়ের কথা স্মরণ করে জানান তার সেই সিদ্ধান্তের কথা যেটা তাকে নতুন সব বাধার মুখোমুখি হতে সামনের দিকে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছিলো। তিনি আরো বলেন, ‘কোনো অলস জীবন নয় বরং অর্থবহ একটা জীবন কাটাতে চেয়েছিলেন। তাই অলসভাবে বসে থেকে যা হারিয়েছেন তা নিয়ে দুঃখ না করে কিছু একটা করতে চেয়েছেন। সেই লক্ষে নিজেকে একজন ভালো আইনজীবী হিসেবে গড়ে তুলতে চান তিনি।’

আইন পেশা নিয়ে নিজের আকাঙ্ক্ষার কথাও জানান তিনি। তার এই পদক্ষেপ তাকে ক্রমবর্ধমান আকাঙ্ক্ষা রয়েছে পারিবারিক সহিংসতার শিকার অন্যদের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। প্রান্তিক শিশু, বয়স্ক, পুরুষ এবং সবাইকেই সাহায্য করার স্বপ্ন দেখেন তিনি।

সেই ঘটনার পরে জনসম্মুখে কথাবর্তায় তিনি ট্রমাটিক অভিজ্ঞতার উল্লেখ করতেন অন্যদের উৎসাহিত করার জন্য। পাশাপাশি চালাতেন নিজের পড়াশোনা। অন্ধত্ব নিয়েই তিনি পড়েছেন আইনের মতো কঠিন বিষয়। এজন্য তাকে করতে হয়েছে কঠোর পরিশ্রম। পেয়েছেন অনেকের সহযোগিতা। সিএনআইবি থেকে তিনি সহায়তা পেয়েছেন কীভাবে নিজের বাড়ি চিনতে হবে। অ্যাক্রোবেটিক যোগ ব্যায়ামের চর্চা করেছেন। অন্ধদের পড়ালেখার কৌশল ব্রেইল পদ্ধতি শিখেছেন। নিয়েছেন বিশেষ প্রশিক্ষণ।

বর্তমান জীবনে সদা হাস্যজ্জল রুমানা মঞ্জুর

এ বিষয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে তিনি বলেন, ‘আমি উপলব্ধি করতাম সচেতনতা ছড়িয়েই আমি মানুষকে উদ্ধুদ্ধ করতে পারি যেন কোনো ব্যক্তি বুঝতে পারে কখন তাদের পদক্ষেপ নিতে হবে। সেটাই ছিলো পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারীদের সাহায্য করার মনোভাবের প্রথম পদক্ষেপ। ভালো আইনজীবী হওয়াই আমার লক্ষ্য। এই যোগ্যতা নিয়ে যদি আমি মানুষকে সাহায্য করতে পারি তাহলে ভাববো আমি কিছু অর্জন করতে পারলাম।’ 

এক রুমানা মঞ্জুরের সাথে যা ঘটেছে, তাতেই বোঝা যায় বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট। নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে এ দেশে ধনী, গরীব, শিক্ষিত, অশিক্ষিতের কোনো তফাৎ নেই। সমাজের প্রতিটি স্তরে রয়েছে নারী নির্যাতনের প্রকোপ। এ প্রতিকূলতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না অগণিত অসহায় নারী।

প্রিয় রুমানা মঞ্জুর, আপনি পেরেছেন। আপনার মুখের হাসি কেড়ে নিতে পারেনি সেই নরপিশাচ। বরং অনন্য এক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন নারীকূলের উদ্দ্যেশ্যে। যে সাহসিকতা আপনি দেখিয়েছেন, তা পাথেয় হয়ে থাকবে আমাদের জন্য। আপনাকে স্যালুট!   


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা