ষাটের দশকে প্লেব্যাকে যখন অভিষেক হলো, তখনও তিনি শিশুশিল্পী। সেখান থেকে নিজেকে তিনি কিংবদন্তিতে পরিণত করেছেন, বাংলা গানকে সমৃদ্ধ করেছেন নিজের প্রতিভায়, প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে সর্বোচ্চ সংখ্যক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার গেছে তার ঘরে...

সত্যিই সৃষ্টিকর্তা উনাকে সুরের ভুবনে সোনার আলোয় জীবন পূর্ণ করে দিয়েছেন। শুধু গান গেয়ে পরিচয়, সে যে কেন এলো না একি সোনার আলোয় জীবন ভরিয়ে দিলে কিংবা সব কটা জানালা খুলে দাও না, জন্ম আমার ধন্য হলো এরকম অসংখ্য কালজয়ী গানে মোহনীয় কন্ঠ দিয়ে তিনি শ্রোতাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বিমোহিত করে রেখেছেন। বাংলাদেশে সঙ্গীত জগতের সবচেয়ে দুইজন উজ্জ্বল তারকার একজন তিনি, শ্রোতাদের ভালোবাসায় পেয়েছেন 'কোকিলকন্ঠী' খেতাব, তিনি বাংলাদেশের গানের পাখি খ্যাত জীবন্ত কিংবদন্তি সাবিনা ইয়াসমিন।

বড় দুই বোন বিখ্যাত শিল্পী ফরিদা ইয়াসমিন ও নীলুফার ইয়াসমিন, তাদেরই পথ অনুসরণ করে সঙ্গীত জগতে হাতেখড়ি। 'নতুন সুর' ছবিতে শিশুশিল্পী হয়ে গায়িকা হিসেবে প্লেব্যাকে অভিষেক, এরপর 'আগুন নিয়ে খেলা' ছবিতে 'মধু রুপালী জোছনায়' গানে পরিনত বয়সে প্রথম চলচ্চিত্রের গানে কন্ঠদান। ষাটের দশকেই তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের গানের জগতে নিজেকে প্রতিশ্রুতিশীল গায়িকা হিসেবে পরিচিত করেন। এই সময়ে কন্ঠে বেঁধেছেন একি সোনার আলোয়, তুমি যে আমার কবিতা- সহ একাধিক জনপ্রিয় গান।

সত্তরের দশকে একের পর এক জনপ্রিয় গান নিজের সমধুর কন্ঠে বেঁধে চলচ্চিত্রের গানে হয়ে উঠেন শীর্ষস্থানীয় গায়িকা। এই সময়ে প্রায় সব জনপ্রিয় গানেই ছিল তাঁর ছোঁয়া, একক কিংবা ডুয়েট সব মাধ্যমেই প্রতিভার আলো ছড়িয়েছেন। সে যে কেন এলো না, শুধু গান গেয়ে পরিচয়, এই পৃথিবীর পরে, অশ্রু দিয়ে লেখা, এই মন তোমাকে দিলাম, ও আমার রসিয়া বন্ধু রে, একটুস খানি দেখো, আমি আছি থাকবো, চিঠি দিও প্রতিদিন, হায়রে কপাল মন্দ, কেউ কোনদিন আমারে তো থেকে সব সখীরে পার করিতে- সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গান নিজের কন্ঠে বেঁধেছেন তিনি। সময়ের প্রবাহে গান গুলো পেয়েছে কালজয়ীর মর্যাদা।

সাবিনা ইয়াসমিন- বাংলাদেশের গানের পাখি

আশির দশকেও তিনি নিজের জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিলেন,এই দশকে সিনেমার ধারা বদলের পাশাপাশি সংগীতেও পরিবর্তন এসেছিল, তার মাঝেও আমি রজনীগন্ধ্যা ফুলের মতো, দুঃখ ভালোবেসে, আহা চোখের লজ্জায়, সন্ধ্যার ও ছায়া নামে, শত জনমের স্বপ্ন, তুমি ছাড়া আমি একা, আবার দুজনে কিংবা সবাই তো ভালোবাসা চায়, পৃথিবী তো দুইদিনের বাসা- অসংখ্য জনপ্রিয় গানে শ্রোতাদের মাতিয়েছিলেন তিনি।

গত দশকগুলোর মতন নব্বই দশকেও অজস্র জনপ্রিয় গানে কন্ঠ দিয়েছিলেন। পৃথিবীতে সুখ বলে, ও সাথীরে, উড়ে যেতে যেতে, হৃদয়ের আয়না, তুমি আমার মনের মানুষ সহ দারুন সব গান কন্ঠ বেঁধেছিলেন। এরপর চলচ্চিত্রের গান ধীরে ধীরে অনিয়মিত হতে থাকেন, এরমাঝেও বরষার প্রথম দিনে, হাজার বছর পরে, প্রেমে পড়েছে মন, সুখ পাখিরে কিংবা চলো বৃষ্টিতে ভিজি সহ সমধুর কন্ঠে বেশ কয়েকটি জনপ্রিয় গান গেয়েছেন। এখনো মাঝে মাঝে চলচ্চিত্রের জন্য করেন, তবে তা একেবারেই কম।

বাংলা চলচ্চিত্রে সবচেয়ে বেশি গানে কন্ঠ দেয়া এই গায়িকা খান আতাউর রহমান, সত্য সাহা, আলাউদ্দিন আলী, আলম খান, আর ডি বর্মন, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল থেকে ইমন সাহা, হাবিব ওয়াহিদ- সব স্বনামধন্য সুরকারদের সাথে কাজ করেছেন, সহশিল্পী হিসেবে পেয়েছেন আব্দুল আলীম, মাহমুদুন্নবী, সৈয়দ আব্দুল হাদী, খুরশিদ আলম, কিশোর কুমার, এন্ড্রু কিশোর থেকে খালিদ হাসান মিলু, আগুন, আসিফ, মনির খান, হাবিবের মত জনপ্রিয় গায়কদের। কবরী, শাবানা, ববিতা থেকে দিতি, মৌসুমী, শাবনূর কিংবা এই যুগের মিম, পরিমনি সবাই উনার গানে ঠোঁট মিলিয়েছেন।

সঙ্গীত জীবনে চলচ্চিত্রের গানে বেশি মনোযোগ দেয়া এই সুকন্ঠীর চলচ্চিত্রের বাইরে তেমন জনপ্রিয় আধুনিক গান নেই, তবে দেশাত্মবোধক গানে নিজের প্রতিভার আলো ঠিকভাবে বিকশিত করেছেন। নিজের দরদ মাখা কন্ঠে গেয়েছেন সব কটা জানালা খুলে দাও না, জন্ম আমার ধন্য হলো, নাও ছাইড়া দে, একটি বাংলাদেশ, যে মাটির বুকে ঘুমিয়ে আছে, সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবন্য- সহ বহু হৃদয় ছোঁয়া দেশের গান।

সর্বোচ্চ ১৩ বার জিতেছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার

বর্ণিল ক্যারিয়ারে পেয়েছেন দেশের সর্বোচ্চ সম্মাননা একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার। প্লেব্যাকের জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন রেকর্ড সংখ্যক ১৩ বার। এছাড়া দেশে-বিদেশে বহু পুরস্কার পেয়েছেন, সংগীতের উপর ডক্টরেট ডিগ্রি নিয়েছেন এই কিংবদন্তি শিল্পী।

ব্যক্তিজীবনে প্রথমে বিয়ে করেন আনিসুর রহমানকে, এরপর সংসার পেতেছিলেন নৃত্য পরিচালক আমির হোসেন বাবুর সঙ্গে। দুইজনের সাথেই বিচ্ছদের পর বিয়ে করেছেন ওপার বাংলার জনপ্রিয় সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব কবির সুমনকে। বাঁধন ও শ্রাবন নামে দুই সন্তান রয়েছে তার, প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ খান আতাউর রহমান সম্পর্কে তার ভগ্নিপতি, কন্ঠশিল্পী আগুন তার আপন ভাগ্নে। ২০০৭ সালে মরনব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন, সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপা, শ্রোতাদের অগাধ ভালোবাসা, শুভকামনা, সরকারের সার্বিক সহযোগিতা ও সঠিক চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হয়ে ফিরেছিলেন। আমরা তার সুস্থতা কামনা করি।

১৯৫৪ সালের আজকের এইদিনে জন্মগ্রহণ করা সংগীত জগতের এই কিংবদন্তি গায়িকা সাবিনা ইয়াসমিন আজ পেরোচ্ছেন জীবনের ৬৬ টি বছর, তার জন্য রইলো শুভকামনা। শুভ জন্মদিন, সাবিনা ইয়াসমিন!

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা