কখনও হুমায়ূন আহমেদকে অনুকরণ, কখনও বইয়ের নামকরণ, কখনও বইয়ের দাম বেশির অভিযোগ, কখনও আবার মেলা শুরুর আগেই বইয়ের তৃতীয় মুদ্রণ শেষ হয়ে যাওয়া- বারবার সাদাত হোসাইনকে নিয়েই কেন এত বিতর্ক?

বাংলাদেশী ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে এই মুহূর্তে চলমান ট্রেন্ডের নাম সাদাত হোসাইন। জনপ্রিয় এই লেখক কেন তার বইয়ের নাম হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখেন, এটা বই বিক্রির একটা 'ধান্দা' কিনা, এসব নিয়ে যে মুখরোচক কিন্ত অবান্তর সমালোচনাটা শুরু হয়েছিল, সেটাই এখন বাড়াবাড়ি রকমের ব্যক্তি আক্রমণ এবং নোংরামির দিকে গড়িয়েছে। ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে সাদাত হোসাইনও মেজাজ হারিয়েছেন কখনও, নিন্দুকেরা তখন আরও পেয়ে বসেছে, কমেন্টের স্ক্রিনশট নিয়ে 'সাদাত হোসাইন হুমায়ূন আহমেদকে ছোট করে কথা বলেছেন' মর্মে অভিযোগের পাহাড় গড়ে তুলেছে। 

শুরু থেকেই পুরো ব্যাপারটা অনুসরণ করছি, বই সংক্রান্ত কয়েকটা ফেসবুক গ্রুপের পোস্ট এবং কমেন্টবক্সে নজর রেখে যেটা বুঝতে পারলাম, তাতে সাদাত হোসাইনের প্রাথমিক অপরাধ হচ্ছে তার বইয়ের নামের সঙ্গে হুমায়ূন আহমেদের কিছু বইয়ের নাম মিলে যাচ্ছে। এবং এক শ্রেনীর মানুষের অভিযোগ, এই নামকরণ মিলে যাওয়ার ব্যাপারটা মোটেও কাকতালীয় নয়। 

সাদাত হোসাইন নিজের বইয়ের বিক্রিবাট্টা বাড়ানোর জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে 'নির্বাসন' নামে বই প্রকাশ করেছেন, এই নামে হুমায়ূন আহমেদের আস্ত একটা উপন্যাসই আছে। হুমায়ূনের 'আজ আমি কোথাও যাব না' বই থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সাদাত তার বইয়ের নাম রেখেছেন 'আমার কোথাও যাওয়ার নেই'। কিংবা হুমায়ূন একটা 'দরজার ওপাশে' লিখেছেন বলে সাদাতকে জানালার ওপাশে লিখতেই হলো- ধরে নিলাম এসব অভিযোগ সত্যি। কিন্ত বইয়ের বিক্রি বাড়ানোর জন্য সাদাত হোসাইন এই পদ্ধতি অবলম্বন করছেন- এমন অদ্ভুত অভিযোগ তো মানতে পারলাম না। 

সাদাত হোসাইনের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া তিনটি বই সম্ভবত অন্দরমহল, আরশিনগর এবং মানবজনম (শীর্ষেন্দুর মানবজমিন থেকে এই বইয়ের নাম নকল করেছেন বলে কেউ অভিযোগ করেননি এপর্যন্ত)। প্রত্যেকটাই বিশাল কলেবরের উপন্যাস, একেকটা বইয়ের বিস্তারও চারশো-পাঁচশো বা তারও বেশি পৃষ্ঠা। এই তিনটি উপন্যাস তাকে পাঠকদের মধ্যে গগনচুম্বী জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে, তার বই কেনার জন্য ছুটির দিনে বইমেলায় লাইন ধরেছে লোকে, অনলাইনে প্রি-অর্ডারের রেকর্ড হয়েছে- সেই সাদাত হোসাইনকে নিজের বই বিক্রি করার জন্য জনপ্রিয় কোন লেখকের কাছ থেকে নাম ধার করতে হবে- এটা উটকো অভিযোগ ছাড়া আর কিছুই নয়। 

তারচেয়ে বড় কথা, ব্যাপারটা অন্যায় বা অনৈতিক কিছু নয়। যে হুমায়ূন আহমেদের নাম নিয়ে লোকজন সাদাতের বিরুদ্ধে অভিযোগের ফিরিস্তি আনছেন, সেই হুমায়ূন আহমেদেরই একটা বইয়ের নাম কবি, দুর্দান্ত একটা উপন্যাস। অথচ হুমায়ূনের অনেক আগেই তারাশংকর একই নামে উপন্যাস লিখে গেছেন, তখন তো কেউ বলেনি যে হুমায়ূন আহমেদ বই বিক্রির ধান্ধায় তারাশংকরের বইয়ের নাম মেরে দিয়েছে! 

হুমায়ূনের অনেক বইয়ের নামকরণেই দেখবেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা বা গানের লাইনের একটা ছাপ আছে। তার মানে এই নয় যে হুমায়ূন সেসব শুধু পাঠককে গেলানোর জন্য করেছেন। পাঠকের দেখা উচিত গল্পের বিষয়বস্তুর সঙ্গে নামকরণের মিল আছে কিনা, সেখানে অমিল থাকলে সমালোচনা হতে পারে, কিন্ত যেভাবে 'হুমায়ূনের বইয়ের নাম মেরে দিয়েছেন সাদাত' টাইপের নিন্দা হচ্ছে, এটা শুধু অনৈতিকই নয়, অবান্তরও। 

সাদাত হোসাইন, ছবি-ফেসবুক

লেখালেখি শুরু করার পর থেকেই সাদাত হোসাইনকে শুনতে হয়েছে যে তিনি হুমায়ূন আহমেদকে অনুকরণ করেন। অভিযোগটা পুরোপুরি মিথ্যেও নয়, শুরুতে তার লেখায় হুমায়ূনের ছাপ ছিল। আশি-নব্বই বা এই শতকের শুরুর দশকে যারা হুমায়ূন পড়ে বড় হয়েছে, দু'কলম লিখতে শিখেছে, তাদের সবার মধ্যেই হুমায়ূনের ছাপ থাকবে, থাকতে বাধ্য। ফেসবুকে অজস্র মানুষ হুমায়ূন আহমেদকে অনুকরণ করে লিখেছেন, লেখার চেষ্টা করেছেন- আজ পর্যন্ত তাদের কয়জন সাদাত হোসাইন হতে পেরেছেন? 

স্বয়ং হুমায়ূন আহমেদের ছোটগল্পেও আপনি রবীন্দ্রনাথের ছাপ পাবেন, চরিত্র বর্ণনায় কখনও শীর্ষেন্দুর ট্রেডমার্কটাও খুঁজে পাওয়া যাবে। হুমায়ূন আজাদ বা মুহম্মদ জাফর ইকবালের লেখাতেও বিদেশী অনেক লেখকের ছাপ পাওয়া যায়- তার মানে এই নয় যে তারা সেসব লেখককে অন্ধ অনুকরণ করছেন। লেখকেরা অবচেতন মনেই এই কাজটা করেন, অন্যের দ্বারা অনুপ্রাণিত হন, এটা যদি ত্রুটি হয়ে থাকে তবে জগতের কোন লেখকই এই ত্রুটি থেকে মুক্ত নন। 

বছরের পর বছর ধরে একই অভিযোগ শুনতে কারো ভালো লাগবে না। সাদাত হোসাইন অসংখ্যবার ক্ল্যারিফিকেশন দিয়েছেন এব্যাপারে, নিজের লেখার স্টাইলেও বদল এনেছেন, তাতে তার পাঠকপ্রিয়তা কমেনি। তবুও এসব অভিযোগ নিয়ে কানের কাছে কেউ ঘ্যানঘ্যান করলে মেজাজ খারাপ হবারই কথা। সাদাত হোসাইনের 'মুই কি হনুরে' টাইপের কমেন্টটাকে সমর্থন না করেই বলছি, একজন মানুষ মেজাজ হারাতেই পারেন, সেটাকে ইস্যু করে ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। তাছাড়া সেই কমেন্টে সাদাত লেখালেখির বাইরেও নিজের ভ্যারিয়েশনের ব্যাপারটা জানাতে চেয়েছিলেন বলেই মনে হয়েছে, কোথাও হুমায়ূন আহমেদকে ছোট বা হেয় করার ইচ্ছে তার ছিল বলে মনে হয়নি আমার কাছে। কারো কাছে ব্যাপারটাকে অন্যরকম লাগতেই পারে। 

আপনাদের কারো যদি মনে হয়, এই লেখার উদ্দেশ্য সাদাত হোসাইনকে ডিফেন্ড করা, বা লেখক বুঝি সাদাত হোসাইনের পাগলা ফ্যান- তাদের জন্য বলে রাখি, আমি সাদাত হোসাইনের গদ্য লেখনীর ভক্ত নই মোটেও। তবে কবিতা তিনি বেশ ভালো লিখেন, এবং এই জায়গাটায় তার আরও বেশি মনযোগ দেয়া উচিত বলে মনে করি। বোধ এবং দ্য শু'জ নামে দুটো শর্টফিল্ম দেখেছি তার, দুটোই ভালো লেগেছে। 

সৈয়দ আবদুল হাদীকে নিয়ে একটা প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন তিনি, ভালো লেগেছে সেটাও। তবে সাম্প্রতিক সময়ে গহীনের গান নামের যে মিউজিক্যাল ফিল্মটা বানিয়েছেন, এটা বিরক্তির উদ্রেকই করেছে। একজন পাঠক, একজন দর্শক হিসেবে এই সমালোচনাগুলো করার অধিকার আমার আছে, যেটা নেই সেটা হচ্ছে ভিত্তিহীন আর মনগড়া অভিযোগ তুলে ব্যক্তিগত আক্রমণের অধিকার- এই সহজ কথাটা অনেকেই বোঝে না। 

বারবার সাদাত হোসাইনকে নিয়েই কেন এত বিতর্ক? কখনও হুমায়ূন আহমেদকে অনুকরণ, কখনও বইয়ের নামকরণ, কখনও বইয়ের দাম বেশির অভিযোগ, কখনও বইমেলা শুরু হবার আগেই তার বইয়ের তৃতীয় মুদ্রণ চলে আসছে, যেটা অনেকে বিশ্বাসই করতে পারছেন না, দেশ-বিদেশের বইমেলায় এবং অনলাইনে প্রি-অর্ডারের কারণেই যে বইয়ের দুই/তিন মুদ্রণ শেষ হয়েছে, এমন যৌক্তিক ব্যাখ্যা দেয়ার পরেও অনেকে মানতে চায় না- এর কারণ কী? 

বড় একটা কারণ অবশ্যই ঈর্ষা। আট-দশ বছর আগেও সাদাত হোসাইন ব্লগে লিখতেন, তিনি ছিলেন আপনার-আমার মতোই সাধারণ একজন। ব্লগের যুগ শেষে ফেসবুক জমানার শুরু হলো, সাদাতের জনপ্রিয়তাও সেখান থেকেই। তারপর বই প্রকাশিত হলো, পাঠক হুমড়ি খেয়ে পড়লো, একদল তাকে হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে তুলনা করা শুরু করলো, কারো চোখে তিনি আবার হুমায়ূনের চেয়েও সেরা, শীর্ষেন্দুর চেয়েও ভালো! এমন নৈবদ্য আবার সহ্য হলো না অনেকের, তারা এই তেলবাজ গোষ্ঠীর সমালোচনার বদলে সাদাতকে আক্রমণ শুরু করলেন! এবং এই ঘটনাটাই রিপিটেটিভ মুডে বারবার ঘটে চলেছে। 

সাদাত হোসাইন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। কিন্ত তিনি কখনও দাবী করেননি যে তিনি হুমায়ূন আহমেদের মতো লিখতে পারেন, কিংবা ক্যামেরার পেছনে তার মাথা সত্যজিতের মতো কাজ করে। তার একশ্রেনীর ভক্ত অতিরিক্ত তোষামোদি করতে গিয়ে তাকে সাহিত্যের নবী-রাসূলের পর্যায়ে নিয়ে গেছে, নিন্দা করতে চাইলে এই লোকগুলোর করা হোক। সাদাত হোসাইন নিশ্চয়ই এদের মাসে মাসে বেতন দেন না তার প্রশংসা করার জন্য। 

আপনি মানুন আর না মানুন, এটা তো সত্যি যে, সময়ের সাথে সাথে সাদাত হোসাইন নিজের একটা পাঠকশ্রেনী তৈরি করেছেন, বইমেলায় সবচেয়ে বড় ব্র‍্যান্ড এখন তিনি, দেশের প্রকাশনা শিল্প খানিকটা হইলেও তার জনপ্রিয়তার ওপর নির্ভরশীল, এবং সবচেয়ে বড় কথা, বাংলাদেশে এখন হাতেগোনা যে কয়েকজন লেখকের নামে বই বিক্রি হয়, মানুষজন লেখার কোয়ালিটি না দেখে শুধু নাম শুনেই কেনে- সাদাত হোসাইন তাদের মধ্যে অন্যতম।

সাদাত হোসাইনের সাহিত্যগুণ নিয়ে অবশ্যই সমালোচনা হবে, তার উপন্যাসের প্লটে কোথায় খুঁত আছে সেটা নিয়েও আলোচনা হবে। কিন্ত 'সাদাত হোসাইন বিক্রি বাড়ানোর জন্য হুমায়ূনের বইয়ের নাম নকল করেন' বা 'সাদাত কেন হুমায়ূন আহমেদকে অপমান করে কথা বলেছেন' টাইপের অবান্তর নিন্দার কোন মানে হয় না। এদেশে এক শ্রেনীর লোক হুমায়ূন আহমেদের সমালোচনা করতো এভাবে- আরে আমি হুমায়ূন পড়ি না, হুমায়ূন একটা লেখক হলো? সে তো ক্যারেক্টারলেস, হাঁটুর বয়সী একটা মেয়েকে বিয়ে করসে...' এগুলো সমালোচনা না, এসব হচ্ছে ব্যক্তিগত ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ। একজন রুচীশীল পাঠকের যেটা শোভা পায় না। 

বইয়ের গ্রুপগুলো দেশ-বিদেশের বই নিয়ে, লেখক নিয়ে সৃজনশীল আলোচনায় ভরে উঠবে, এটাই প্রত্যাশা করি। অকর্মণ্য লোকজনের মতো বইয়ের পাঠকেরাও যদি স্রোতে গা ভাসায়, তাহলে সেই হতাশার কোন মাত্রা হয় না। 

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা