একদিন চট করে আম্মাকে জিজ্ঞেস করে ফেললাম, ‘আম্মা, এই মাসিক জিনিসটা কী?’ আম্মা খানিক থতমত খেয়ে গেলেন। তার পাশে তখন পাশের বাড়ির দুঃসম্পর্কের ভাবী, তরুণী ফুপু, কিশোরী চাচাতো বোন। তারা সবাই মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে গেলেন। যেন মেঘমুক্ত আকাশ থেকে হঠাৎই বজ্রপাত!

তখন কেবল ইলেক্ট্রিসিটি এসেছে গ্রামে। আমরা নিয়ম করে রেডিও শুনি। রেডিও বলতে টেপরেকর্ডারের সাথে যে ‘বিল্ট ইন’ রেডিও থাকে, সেই রেডিও। আব্বা ইয়া বড় সাইজের এক টেপ রেকর্ডার এনেছিলেন। কিন্তু এতোদিন ইলেক্ট্রিসিটি ছিলোনা বলে সেই টেপরেকর্ডার আমরা শুনতে পেতাম না। ছয় ছয়টা অলেম্পিক ব্যাটারি কিনে টেপরেকর্ডার শোনা বিলাসিতা! ফলে ছোট ভাইকে সেই আজদাহা টেপরেকর্ডারের পেছনে শুইয়ে কাঁথা দিয়ে ঢেকে দিতাম। 

তারপর শব্দ করে স্টার্ট বাটন টিপে আমি ঘোষক সেজে গম্ভীর গলায় বলার চেষ্টা করতাম, ‘প্রিয় শ্রোতাবৃন্দ, শুরু হচ্ছে অনুরোধের আসর গানের ডালি। এখন আপনারা শুনবেন  সারেং বউ ছায়াছবির গান, ওরে নীল দরিয়া… কণ্ঠ দিয়েছেন আব্দুল জব্বার। গানটি শুনতে অনুরোধ করেছেন…’ 

একগাদা নাম বলার পর কাঁথার নিচ থেকে আমার ছোট ভাই গুনগুন করে গান গাইতে শুরু করতো। সেই গান শ্রবণ অযোগ্য হলেও আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনতাম, আহা! সত্যি সত্যিই যদি কোনোদিন ব্যাটারি ছাড়াই রেডিও শোনা যেত!

আমাদের স্বপ্ন পূরণ হলো। গাঁয়ে ইলেক্ট্রিসিটি চলে এলো। আমাদের ব্যাটারি ছাড়া রেডিও শোনা শুরু হলো। রেডিওর অনুষ্ঠানসূচী আমাদের মুখস্থ। ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান মহানগর। দিনভর বিজ্ঞাপন দাতাদের সৌজন্যে অনুষ্ঠান। 

অনুষ্ঠানের নাম আজ ভুলে গেছি। সারাদিন বিজ্ঞাপন আর গান হতো। সেই বিজ্ঞাপন শুনতে শুনতে মাথায় কত প্রশ্ন জাগতো। সেই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য আমাদের একমাত্র ভরসা আম্মা। আমার মা গাঁও গ্রামে বড় হয়েছেন। খুব যে পড়াশোনা করেছেন এমনও নয়। তারপরও কোনো এক অদ্ভুত উপায়ে তিনি যেন আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে দিতে পারতেন। সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিতে পারতেন। 

স্যানিটারি প্যাড নিয়ে সেনোরার বিজ্ঞাপন

এ এক রহস্যময় ব্যাপার। আমাদের কেবলই মনে হতো, আমার মা জানেন না, এমন কিছু কি এই জগতে আছে! নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু আমাদের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা আর অতিক্ষুদ্র জানাশোনার জগতে কৌতূহল ছিলো অসীম। প্রশ্ন ছিল অফুরন্ত। সেইসব প্রশ্নের উত্তরও কেবল একজনই দিতে পারতেন, আমাদের মা। সম্ভবত সকলের মা-ই পারেন। তবে একটা বয়স অবধি। 

ফলে সেই বয়সে খানিক পরপরই আমরা মায়ের কাছে ছুটে যেতাম, ‘আম্মা, এই যে এডভেটাইজে কইলো, 'হক ব্যাটারি হক ব্যাটারি শাক সবজি বেশি' -এইটা কইলো কেন? হক ব্যাটারি কি শাকসবজি দিয়া বানায়?’ আম্মা মনোযোগ দিয়ে সেই ‘এডভেটাইজ’ শুনতেন। আমরা তখন ‘এডভার্টাইজমেন্ট’কে ‘এডভেটাইজ’ বলি। 

আম্মা ভালো করে সেই বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল শুনে বলতেন, ‘ওইটা শাকসবজি না, ওইটা হইলো সাত শ ছিয়াশি। হক ব্যাটারি সাত শ ছিয়াশি। সাত শ ছিয়াশি হইলো তাগো একটা নম্বর। এই নম্বর কেনো দিছে সেইটা জানি না। যেমন দেখোস না, তিব্বত পাঁচ শ সত্তর সাবান, তেমন’।

আমার ছোট ভাই তখন আরও ছোট। সে একদিন এসে বললো, ‘আম্মা, মাইনষের নাম কোনোদিন আন্ডা কুসুম হয়?’

আম্মা অবাক গলায় বলেন, ‘মাইনষের নাম আন্ডা কুসুম হইবো কেন?’

- ‘সেইটাইতো! ওই যে শোনেন, রেডিওতে কয়, এখন গান গাইবেন কণ্ঠশিল্পী আন্ডা কুসুম’।

আম্মা হাসতে হাসতে খুন, ‘ওইটা আন্ডা কুসুম নারে বোকা, ওইটা এন্ড্রু কিশোর’।

আমাদের মাথা ভর্তি তখন গিজগিজে প্রশ্ন। সবকিছুই আমাদের জানতে ইচ্ছে হয়। বুঝতে ইচ্ছে হয়।  আম্মা অবশ্য সহাস্যে সেইসব প্রশ্নের উত্তর দেন। তিনি যেটা জানেন না, সেটাও জেনে বা নিজের যুক্তি দিয়ে বুঝে  আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করেন। হয়তো নিজের আরও বেশি শিক্ষা-দিক্ষা অর্জনের অপূর্ণ স্বপ্নটা তিনি আমাদের দিয়ে পূরণ করাতে চান। ওই অজপাড়া গাঁয়েও যেন আমরা ভুল শিক্ষা, ভুল জানাশোনা কিংবা মানসিক অন্ধত্ব নিয়ে বেড়ে না উঠি। যেন আমাদের ভাবনার জগত সংকীর্ণ হয়ে না ওঠে। 

রাতে রডিওতে একটা অনুষ্ঠান হতো। পুঁথি পাঠের মাধ্যমে পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে জনসচেতনতা বিষয়ক অনুষ্ঠান। খানিক পুঁথি পাঠ, পুঁথির গল্পের সূত্রে ধরে সংলাপ ভিত্তিক নাটিকা, আবার পুঁথি, আবার নাটিকা। শিরিন বকুল নামে আমাদের কাছে অপরিচিত এক শিল্পীর বালিকাসূলভ কণ্ঠে তখন আমরা বুঁদ হয়ে থাকি। সমস্যা হচ্ছে,  পুঁথি পাঠের পরের অংশ। 

এই অনুষ্ঠানে প্রচুর চিঠি আসে। নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্য বা পরিকল্পনা বিষয়ক নানান চিঠি। সেইসব চিঠিতে পরিবার পরিকল্পনা বিষয়ে অসংখ্য প্রশ্ন থাকে। থাকে নিজেদের সমস্যার কথা। অনুষ্ঠানের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সেইসব প্রশ্নের উত্তর দেন। রেডিওতে তখন যা-ই হয়, আমরা রাজ্যের কৌতূহল নিয়ে শুনি। সেই অনুষ্ঠানও শুনি। 

সেই অনুষ্ঠানে একটা শব্দ খুব কমন- 'মাসিক’। প্রায় সব চিঠিতেই প্রশ্ন থাকে এই ‘মাসিক’ নিয়ে,  'মাসিক শুরুর কতদিন বাদে ওষুধ খাওয়া শুরু করবেন? মাসিক বন্ধ বা অনিয়মিত হওয়া বিষয়ক জটিলতা। বা আরও নানান প্রশ্ন’। সেইসব প্রশ্নের মাথামুণ্ডু আমি কিছুই বুঝিনা। 

একদিন চট করে আম্মাকে জিজ্ঞেস করে ফেললাম, ‘আম্মা, এই মাসিক জিনিসটা কী?’ আম্মা খানিক থতমত খেয়ে গেলেন। তার পাশে তখন পাশের বাড়ির দুঃসম্পর্কের ভাবী, তরুণী ফুপু, কিশোরী চাচাতো বোন। তারা সবাই মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে গেলেন। যেন মেঘমুক্ত আকাশ থেকে হঠাৎই বজ্রপাত! 

তারা বজ্রাহতের মতো তাকিয়ে রইলেন। একজন কটমট চোখে আম্মার দিকে তাকালেন, ‘পোলাপান লাই দিবেন ভালো কথা, কিন্তু তাই বইল্যা এইগুলানও তাগো শুনতে হইবো? এইসব অনুষ্ঠানও? নেন, এহন দেন উত্তর’।

অন্যজন নিজেকে খানিক সামলে নিয়ে বললেন, ‘ওই যে স্কুলে পড়ছো না, সাত দিনে এক সপ্তাহ, পনেরো দিনে এক পক্ষ, ত্রিশ দিনে এক মাস, এইটা হইলো সেই ত্রিশ দিনে এক মাস। সাত দিনে যেইটা হয়, ওইটারে যেমন সাপ্তাহিক বলে, তেমনি এক মাসে যেইটা হয়, সেইটারে বলে মাসিক।’

‘কিন্তু কী হয়?’

‘অসুখ হয়’।

‘কী অসুখ হয়?’

সবাই চুপ।

‘একদম মাইপ্যা মাইপ্যা ত্রিশ দিন পর পর অসুখ হয়? কী অসুখ এইডা? কই আমারতো হয়না! আর হইলেও ডাক্তার দেহায় না ক্যান? তাইলেইতো অসুখ ভালো হইয়া যাইব? প্রত্যেক মাসে অসুখ হওনের দরকার কী?’

এই কথায় পুরো ঘর স্তব্ধ। পীনপতন নীরবতা। সবাই কটমট চোখে আম্মার দিকে তাকিয়েই রইলো। এক দুজন বোধহয় উঠে চলেও গেলেন। আম্মাও যেন আড়ষ্ট হয়েই রইলেন। 

এখনও অজস্র মানুষের কাছে পিরিয়ড একটা ট্যাবুর নাম

তবে তার সেই আড়ষ্টতা কেটে গেলো। তিনি কী ভাবলেন কে জানে! পরদিন সন্ধ্যায় সেই অনুষ্ঠান শুরু হতেই তিনি আমাদের দুই পাশে বসিয়ে সেই অনুষ্ঠান শোনাতে বসালেন। তারপর মাসিক নিয়ে আমাদের কৌতূহল, প্রশ্ন সবিস্তারে মিটিয়ে দিলেন। বললেন, ‘এইটা একটা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। পৃথিবীর প্রত্যেকটা মেয়ের প্রতি মাসে এইটা হয়। এই সময়ে তাদের শরীর খুব খারাপ থাকে। মন খারাপ থাকে। এইটা একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। এইটা না হইলে মেয়েরা মা হইতে পারে না। এই যে আমি তোমাগো মা, আমার যদি এইটা না হইতো, তাইলে আমিও তোমাগো মা হইতে পারতাম না!’। 

আরও কত কিছু যে বললেন তিনি। আমরা কী বুঝেছিলাম জানিনা।

তবে একটা বিষয় সেদিন স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিলো, সেই বয়ঃসন্ধিকালে নারী শরীর নিয়ে বন্ধু মহলে যে ফিসফাস, যে নানাবিধ কাল্পনিক ব্যখ্যা, তথ্য, যে ফ্যান্টাসি, তার অধিকাংশই সেদিন বদলে গিয়ে তৈরি হয়েছিলো অসাধারণ এক সংবেদনশীলতা, দারুণ এক বোঝাপড়া, স্পষ্টতা। মনে হয়েছিলো, আমার বন্ধুরা যে বিষয়টি নিয়ে আড়ালে আবডালে কথা বলে একধরনের গোপন ‘আনন্দ’ বা ‘ফ্যান্টাসি’তে ভোগে, যে বিকৃত কল্পকাহিনী বানায় বা ভাবে, আমি সেখানে সেই বিষয়টিতেই অনুভব করতে শুরু করেছিলাম অদ্ভুত এক সংবেদনশীলতা, শ্রদ্ধা, মমতা। 

সেই মায়াময় সংবেদনশীলতা আমাকে এই ভাবনাটি ভাবিয়েছিলো যে, মানুষ কেনো এই বিষয়টাকে ‘পাপ’ এর মতো ঠাওর করায়? কেনো আড়ালের আবডালের করে রেখে বরং ‘ফ্যান্টসাইজ’ করে তোলে? বরং এই অতি স্বাভাবিক, সাধারণ প্রাকৃতিক বিষয়টি কত সহজ হয়ে উঠতে পারতো সবার কাছে!

এরপর দিন গিয়েছে। আমরা বড় হয়েছি, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে আরও শিক্ষিত হয়েছি। বড় হয়েছে আমাদের বন্ধুরা, চারপাশের মানুষও। কিন্তু সেই অতি সহজ, সাধারণ হয়ে ‘ওঠার কথা’ বিষয়টি এখনো সহজ-সাধারণ হয়ে উঠতে পারেনি, রয়ে গেছে অজপাড়া গাঁয়ের সেই অস্বাভাবিক, অসহজ, গোপন, আলোচনা-অযোগ্য বিষয় হয়েই। কেন?

এই ‘কেন’র উত্তর আমি অনেক খুঁজেছি। খুঁজতে গিয়ে মনে হয়েছে এর কারণ পরিবার। পরিবার আমাদের যা শেখায় আমরা তাই শিখি। যা ভাবায়, আমরা তাই ভাবি। ফলে এই পরিবার আমাদের কাছ থেকে এই সহজ স্বাভাবিক বিষয়টাকে এমন আড়ালের, এমন সংকোচের, এমন দ্বিধার করে রেখেছে যে বিষয়টি ক্রমশই আমাদের কাছে হয়ে উঠেছে ভয়াবহ এক ‘ট্যাবু’। 

অথচ আমার সেই মা, সেই অজপাড়া গাঁয়ের আটপৌড়ে মা, অত বছর আগে, কী অকপটে, কী সংবেদনশীলতায় আমাদের ভাবনার জগতে পৌঁছে দিয়েছিলেন দারুণ এক ভাবনা কিংবা অনুভবও। যা বাদ বাকী জীবনে নারীর ‘পিরিয়ড’ কে সংকোচের নয়, বরং ভাবতে শিখিয়েছিলো গভীর সংবেদনশীলতায়।
এই সংবেদনশীলতাটুকু খুব দরকার। 

সম্প্রতি সেনোরার একটি বিজ্ঞাপন নিয়ে চারপাশের শোরগোল। শুনে কৌতূহল নিয়ে সেই বিজ্ঞাপন দেখতে গেলাম। গিয়ে মনে হলো পিরিয়ড নিয়ে পরিবার থেকেই ভাবনার যে সহজতা,  অনুভব ও বোঝাবুঝির যে স্পষ্টতার কথা আমি ভাবতাম, সেটিরই একটি শক্তিশালী বার্তা এই বিজ্ঞাপন।   

আমার বিশ্বাস, আজ যারা এটিকে সংকোচের ভাবছেন, কাল তার বুঝবেন, এটি সংকোচের নয়, বরং সংবেদনশীলতার। সেই সংবেদনশীলতা নারীর জন্য তার পরিবার থেকে শুরু করে পুরো পৃথিবীকেই একদিন করে তুলবে সহজ, স্বাভাবিক, সংকোচহীন সুন্দর।

আরো পড়ুন- 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা