মানুষটা বদ্ধ ঘরে চিৎকার করেছেন, খাবার চেয়েছেন, পানি চেয়েছেন, দেয়া হয়নি তাকে, তিনি মারা গেছেন অসহায়ভাবে। স্ত্রী-সন্তান কেউ এগিয়ে আসেনি। কারণ তার শরীরে করোনার উপসর্গ আছে। আমরা যাদের পশু বলি, তারাও তো এত নির্মম হয় না!

একটা মানুষ সারাজীবন ধরে চাকরি-বাকরি করেছেন, পরিবার সামলেছেন, ছেলে-মেয়েদের বড় করেছেন, পড়ালেখা করিয়েছেন, বিয়ে দিয়েছেন। তাদের জীবন গড়ে দেয়ার জন্যে নিজের সব শখ-আহ্লাদ বিসর্জন দিয়েছেন। অথচ সেই মানুষটা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন- এমন সন্দেহ করে তাকে একটা রুমের ভেতরে তালাবদ্ধ করে রেখে দিয়েছেন তার স্ত্রী আর মেয়েরা। তাকে খাবার দেয়া হয়নি, মানুষটা শ্বাসকষ্টে চিৎকার করলেও কেউ সাড়া দেয়নি। এমনকি সেই বদ্ধ কামরায় তিনি মারা যাওয়ার পরেও কেউ দেখতে আসেনি, লাশটাও দাফন করতে আসেনি তারা, সেই কাজ করেছেন স্থানীয় প্রশাসন। 

নির্মম এই ঘটনাটা ঘটেছে ফেনীর সোনাগাজীতে। চট্টগ্রামের একটি পেট্রোল পাম্পে চাকরি করতেন সাহাব উদ্দিন। তার বয়স ছিল ষাটের বেশি। কিছুদিন আগে সাহাব উদ্দিনের শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। একই সঙ্গে জ্বর ও কাশি ছিল। স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা নিয়ে তিনি সুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। হঠাৎ জ্বর, কাশি ও শ্বাসকষ্ট আবার বেড়ে গেলে গত বুধবার কর্মস্থল থেকে নিজ বাড়িতে আসেন তিনি। শনিবার রাতে শরীর আরো খারাপ হলো, তারপর রবিবার দুপরে নিজেই গিয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়ে আসেন তিনি। 

মিঃ হাইজিন: জীবাণুমুক্ত হাতের প্রতিশ্রুতি

হাসপাতাল থেকে ফেরার পরে নিজের পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকেই ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন সাহাবুদ্দীন। তার ছেলের সঙ্গে কথা বলে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গণমাধ্যমকে যা জানিয়েছেন, সেটা শিউরে ওঠার মতোই। তিনি বলেছেন- গতকাল হাসপাতাল থেকে আসার পর থেকে পরিবারের কেউ সাহাব উদ্দিনের সঙ্গে কথা বলেননি। দুপুরে তাঁকে খাবারও দেয়া হয়নি। 

বিকেলে তার শ্বাসকষ্ট ও কাশি বেড়ে যায়। এ সময় তিনি চিৎকার করে খাবার চাইলেও কেউ দেননি। বরং তাকে শয়নকক্ষে রেখে বাইরে থেকে দরজায় ছিটকিনি লাগিয়ে রাখেন পরিবারের সদস্যরা। ছোট ছেলে এগিয়ে যেতে চাইলে তাকে বোনেরা বাধা দেন। এভাবে চিৎকার করতে করতে রাত ১০টার দিকে সাহাব উদ্দিনের মৃত্যু হয়। রাতে সাড়াশব্দ না পেয়ে পরিবারের লোকজন জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখেন তিনি মারা গেছেন। এরপর সবাই যার যার ঘরের দরজা বন্ধ করে ভেতরে ঢুকে যান। পরে ছোট ছেলে 'বাবা মারা গেছে' বলে চিৎকার শুরু করেন। তখন প্রতিবেশীরা এগিয়ে আসেন।

আশপাশের অন্য লোকজনের মাধ্যমে খবর পেয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান গ্রামপুলিশ নিয়ে ওই বাড়িতে ছুটে যান। দীর্ঘক্ষণ ডাকাডাকি করলেও কেউ দরজার খুলছিল না। অনেকক্ষণ পরে পরিবারের একজন দরজা খুলে দিয়ে নিজ কক্ষে চলে যান। এরপর তারা লাশ দাফন করার জন্য স্থানীয় মসজিদ থেকে খাটিয়া আনতে লোক পাঠালে মসজিদ কমিটির লোকজন খাটিয়া দিতে অস্বীকৃতি জানান, এটাও জানিয়ে দেন যে, সাহাবুদ্দীন যেহেতু করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন, তাই তাকে গ্রামে কবর দিতে দেয়া হবে না! পরে বাধ্য হয়ে ইউপি চেয়ারম্যান স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় গভীর রাতে পরিবারের লোকজনের অনুপস্থিতিতেই জানাজা শেষে লাশ দাফন সম্পন্ন করেন। 

স্থানীয় এক ইউপি সদস্য (মেম্বার) ফেরদৌস রাসেল জানালেন, 'সাহাব উদ্দিনের বাড়ি থেকে চিৎকারের শব্দ শোনার বিষয়টি একজন প্রতিবেশী চেয়ারম্যানকে জানান। চেয়ারম্যান আমাকে খোঁজ নিতে বলেন। পরে রাত একটার দিকে চেয়ারম্যান সহ আমরা কয়েকজন ওই বাসায় গিয়ে উপস্থিত হই।অনেক ডাকাডাকির পর ওই বাড়ির লোকজন মূল দরজা খুলে দিয়ে যার যার কক্ষে চলে যান। 

মৃত সাহাবউদ্দীন

বাড়ির একটি কক্ষে সাহাব উদ্দিনকে রেখে বাইরে থেকে ছিটকিনি লাগানো ছিল। ছিটকিনি খুলে আমরা ভেতরে বিভৎস দৃশ্য দেখতে পাই। সম্ভবত সাহাবউদ্দীনের শ্বাসকষ্ট উঠেছিল এবং তিনি তা সহ্য করতে না পেরে মাটিতে গড়াগড়ি করেছিলেন। তার পরনের কাপড় খোলা অবস্থায় পাশে পড়েছিল।' ফেরদৌস জানালেন, পরে তারাই দাফনের ব্যবস্থা করেন। সাহাবউদ্দীনের তিন মেয়ে, তিন জামাতা ও ছোট ছেলে বাড়িতেই ছিলেন, কিন্ত কেউ জানাজায় আসেনি। দাফন করে চলে আসার সময় ছোট ছেলেটি তার বাবার জন্য সবার কাছে দোয়া চান।

মানুষটা বদ্ধ ঘরে চিৎকার করেছেন, খাবার চেয়েছেন, পানি চেয়েছেন। কেউ এগিয়ে আসেনি। বাবার প্রতি ভালোবাসার চেয়ে তাদের কাছে বড় হয়েছে মৃত্যুভয়। সাহাবউদ্দীনের জায়গায় নিজেকে।একবার কল্পনা করুন। প্রিয়জনের এমন চেহারাটা দেখার পরে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা চলে যাবে। সাহাবউদ্দীন মরে গিয়েই বরং বেঁচে গেছেন। আর যে মানুষগুলোর অবহেলায় তিনি মৃত্যুর পরে ঢলে পড়েছেন, যারা বাবার চিৎকার শুনেও কান বন্ধ করে রেখেছেন, তারা ঠিকই সম্পত্তির ভাগ বুঝে নিতে যথাসময়ে হাজির হয়ে যাবে। অসুস্থ বাবার দাম না থাকতে পারে, ঘরবাড়ি-জমিজমার দাম তো আছে!

রাস্তায় মরে পড়ে থাকা কুকুরের পাশে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে দেখেছি সঙ্গীকে। ওয়াইল্ডলাইফ ডকুমেন্টরিতে দেখেছি, কাদায় পরা সঙ্গীকে উদ্ধার না করে পশুর দল সেই জায়গা ছাড়ছে না। এমনকি বাঘের মুখে পরা একলা বাইসনকে ছেড়ে যায়নি সঙ্গীরা, উল্টো আক্রমণ করে রক্ষা করেছে আহত সঙ্গীকে। এদের আমরা পশু বলি, জানোয়ার বলি। আর নিজেদের দাবী করি আশরাফুল মাখলুকাত- সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে! নিজের অসুস্থ বাবাকে যারা একটা রুমে তালাবদ্ধ করে রাখে, তার প্রাণপণ আর্তনাদেও যাদের হৃদয় গলে না, মানুষটা মরে যাওয়ার পরে যারা একটাবার দেখতেও আসে না- তারা নিজেকে মানুষ বলবে কোন যুক্তিতে? 


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা