মানুষ কতটা জঘন্য হলে, কতটা নীচে নামলে সুস্থ মানুষকে গাড়িচাপা দিয়ে অসুস্থ করে ব্যবসা করতে চায়, সেটা আসলে খুবই অস্বস্তিকর একটি প্রশ্ন...

শিরোনামহীন ব্যান্ডের বেশ বিখ্যাত এক গান আছে- "এই অবেলায়' সে গানের একটা লাইন এরকম- কেউ কোথাও ভালো নেই। এ লাইনটা বোধ করি, করোনার সময়কে ভেবেই লেখা। আসলেই তো। কেউই কোথাও ভালো নেই। প্রতিদিন কিছু মানুষ হুট করে " নাই" হয়ে যাচ্ছে৷ অদৃশ্য এক মৃত্যুভয় মানুষকে আটকে রেখেছে ঘরের কোনে। ডাঙায় ওঠা মাছের মতন তড়পাচ্ছে সবাই। প্রিয়জনের কাছে থেকেও স্বস্তি নেই। নিজের ঘরের মধ্যে থেকেও নিরাপত্তা নেই । মাথার ওপরে "মৃত্যু" খড়গ হয়ে ঝুলে আছে। অস্বস্তি হয়ে গিয়েছে প্রতিদিনের নিয়তি। কেউ কোথাও আসলেই কী ভালো আছে? থাকার কি কথা? অনুপম রায়ের গানের মতন "কথার ওপর কেবল কথা, সিলিং ছুঁতে চায়।" 

অদ্ভুত বিব্রত লাগে, যখন শুনি, এই বিধ্বস্ত সময়ে এসেও এই মহামারিকে কেন্দ্র করে ব্যবসার ভোজবাজি নিয়ে বসেছেন কেউ কেউ। টাকার বিনিময়ে মিলছে করোনার নেগেটিভ, পজেটিভ সার্টিফিকেট। জিহবা দিয়ে আঙ্গুল ভিজিয়ে ব্যবসায়ীয়া গুনছেন টাকা। আমরা ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছি অন্ধকারের কালিগোলা সব টানেলে। নিজেদের বিবেককে নিজেরাই টেনে নামাচ্ছি নীচে, মানবিকতা দিচ্ছে তাদের কাজে ইস্তফা। 

আমাদের আশেপাশে অজস্র সব মানুষ, চকচকে সব মানুষ। ওপরের চাকচিক্যের প্রলেপে আমরা ভড়কে যাই বরাবরই। কিন্তু এই প্রলেপ যদি সরিয়ে ফেলা যায় কোনোভাবে, তাহলে দেখবো, সেখানে আছে থকথকে কাদা, ক্লেদাক্ত অবয়ব। এরকম এক মানুষের গল্পই আজ জানা যাক। 

সম্প্রতি মিডিয়া তোলপাড় হচ্ছে রিজেন্ট হাসপাতাল ও তার চেয়ারম্যান মোঃ সাহেদের নামে। যদিও জাতীয় পরিচয়পত্রে তার নাম- সাহেদ করিম। তাও তিনি নিজেকে পরিচয় দিতেন ভিন্ন নামে। অর্থের ভ্যাক্সিনে 'করোনা পজিটিভ" রোগিকে বানিয়ে দিতেন "করোনা নেগেটিভ।" বিচিত্র সব ব্যবসা, বিভিন্ন চলকের ভণ্ডামি, দমবন্ধকরা জোচ্চুরির সাথে যুক্ত ছিলো তার নাম। যেগুলোর আখ্যান পড়লে  হয়তো "মানুষ" হিসেবে এই মানুষটির সাথে একই গোত্রভূক্ত হওয়ার কারণে খানিকটা লজ্জাও লাগবে আমাদের। হয়তো ভরসা বা বিশ্বাসের জায়গাটুকু আরেকটু নড়ে যাবে। হয়তো "মানুষের ওপরে বিশ্বাস হারানো পাপ" কথাটিকে মনে হবে ফাঁকাবুলি।

গল্প, উপন্যাস, সিনেমাতে ভাড়াটে গুণ্ডা দিয়ে মানুষকে আক্রমণ করা, আহত করা, নিহত করার ঘটনা তো আমরা হরহামেশাই পড়েছি, দেখেছি। এগুলো আমাদের কাছে নতুন কিছু না। এবং আমরা এটাও জানি, বাস্তবে কখনোসখনো এরকম ঘটনা ঘটেও।  কিন্তু কখনো কি শুনেছেন- ভাড়াটে চালক দিয়ে মানুষকে এক্সিডেন্ট করিয়ে এরপর জোর করে হাসপাতালে ভর্তি করানো যে হতে পারে? আমি নিশ্চিত আপনি শোনেননি। কিন্তু এই বিষয়টিই নিয়মিত ঘটনা ছিলো মোঃ সাহেদের পরিচালিত রিজেন্ট হাসপাতালে। উত্তরা এলাকায় তার কিছু ভাড়াটে ড্রাইভার ছিলো। তাদের কাজই থাকতো রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো এবং মওকা পেলে মানুষকে গাড়িচাপা দেয়া এবং তারপর জোর করে রিজেন্ট হাসপাতালে নিয়ে আসা। একজন আহত রোগী নিয়ে কোনো ড্রাইভার হাসপাতালে যেতে পারলে তিনি পেতেন ৮০০০ টাকার কমিশন।

আর ওদিকে হতো আরেক কাণ্ড। যাদের নিয়ে আসা হতো হাসপাতালে, তাদের চোট গুরুতরই থাকুক আর সামান্য, তাকে জোরজবরদস্তির মাধ্যমে অচেতন করে নিয়ে যাওয়া হতো আইসিইউ'তে। আহত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনকে ধরিয়ে দেয়া হতো লাখ দেড়েকের বিল! ভাবুন তো, আপনার কোনো একজন স্বজন আইসিইউতে, আপনার কাছে এসে দেড় লাখ টাকার বিল ধরিয়ে দেয়া হলো হাসপাতাল থেকে। আপনি কী করবেন? নিশ্চয়ই টাকার পরোয়া করবেন না। দিয়ে দেবেন টাকাটি। ঠিক এভাবেই কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিতো এই হাসপাতালটি এবং তাদের লিডার মোঃ সাহেদ। এখানেই শেষ না। জ্বর, সর্দিকাশির রোগীকেও  আইসিইউতে নিয়ে গিয়ে অপারেশন টেবিলে মেরে ফেলার অভিযোগ আছে তাদের বিরুদ্ধে। এভাবেই মানুষের লাশের স্তপে সওয়ার হয়ে, রোগ এবং রোগীকে পুঁজি করে মো.সাহেদ উঠছিলেন ফুলেফেঁপে। 

এবার এই মোঃ সাহেদেরও একটু পরিচয় দেয়া দরকার। মোঃ সাহেদের জীবন-গল্পও বেশ রোমাঞ্চকর। শিক্ষাগত যোগ্যতায় মাধ্যমিকের গণ্ডিও পেরোতে পারেননি এই ভদ্রলোক। নবম শ্রেনিতে থাকতেই পড়াশোনায় ইস্তফা দিয়ে চলে আসেন ঢাকায়। ঢাকা নিয়ে একটা গল্প বেশ মুখরোচক যে, ঢাকায় টাকা ওড়ে। কেউ ধরতে পারে। কেউ পারেনা। আমাদের এই মোঃ সাহেদ টাকা ধরার কায়দাটা খুব সহজেই রপ্ত করেন। আস্তে আস্তে গড়ে তোলেন বিভিন্ন সব ব্যবসা।দেশের অন্যতম পুরোনো বেসরকারি বিমান সংস্থা "রিজেন্ট এয়ারওয়েজ"কে তার নিজের মালিকাধীন প্রতিষ্ঠান বলে দাবী করতেন তিনি। যদিও পরে এ জানা যায়, এ দাবীর পুরোটাই মিথ্যে। তাছাড়া চট্টগ্রামেও " রিজেন্ট গ্রুপ" নামের একটি প্রতিষ্ঠান আছে, সেটাকেও নিজের বলে প্রচার করেছেন বিভিন্ন সময়ে। নিজেকে "কর্নেল" পরিচয় দিয়ে কোন এক সময়ে ব্যাঙ্ক থেকে নিয়েছিলেন বেশ মোটা অংকের ঋণ। যে জোচ্চুরির মামলা এখনো আদালতে বিচারাধীন। 

মিথ্যের বেসাতি চলছিলো তার। বিমান নিয়ে মিথ্যাচার আর গাড়ি নিয়ে দুর্ঘটনার নাটক তো নিয়মিতই মঞ্চস্থ হচ্ছে। তিনি তার শ্যেনদৃষ্টি  প্রসারিত করলেন অন্যদিকেও। শুরু করলেন- রিক্সা নিয়ে ব্যবসা। ভুয়া লাইসেন্স বানিয়ে রিক্সাওয়ালাদের দিতেন তিনি। এই লাইসেন্সের জন্যে রিক্সাওয়ালাদের কাছ থেকে প্রথমে নিতেন ২০০০ টাকা এবং প্রত্যেক মাসে নিতেন ৫০০ করে টাকা। যারা টাকা দিতে পারতেন না, তাদের আটকে রাখা   হতো হাসপাতালের অজ্ঞাত রুমে, যার নাম "টর্চার সেল।" করা হতো ভয়ঙ্কর নির্যাতন। রিজেন্ট হাসপাতালের টর্চার সেলটির সন্ধান পাওয়া গিয়েছে সম্প্রতি, তখনই উঠে আসে এসব তথ্য। 

মোঃ সাহেদের স্বভাব ছিলো অনেকটা আলুর মতন। আলু যেমন সব তরকারিতে মিশে যেতে পারে পুরোপুরিভাবে, উনিও ছিলেন তেমন। যখনই যে সরকার এসেছে ক্ষমতায়, তাদের সাথেই বেশ ভালো খাতির রেখেছেন। বিএনপি'র সময়ে ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা'র সাথে ছিলো ভালো সম্পর্ক, আবার আওয়ামীলীগের এই সময়ে এসেও নিজেকে দাবী করতেন- তিনি আওয়ামীলীগের আন্তজার্তিক বিষয়ের উপকমিটির সদস্য বলে। তাছাড়া "নতুন কাগজ" নামে সংবাদপত্র খুলে হয়ে বসেছেন তার সম্পাদকও। শিক্ষাগত যোগ্যতায় হয়তো মাধ্যমিকটাও পেরোনো হয়নি কিন্তু জাতে ওঠার কোনো চেষ্টাই বাদ রাখেননি তিনি। তাছাড়া বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের টকশোতেও আসতেন নিয়মিত। শোনাতেন মানবতার বাণী। "দগদগে ঘা" এর চেহারাটা ঢেকে দিতেন ন্যায়পরায়ণতার বুলিতে। তখন তাকে দেখলে কে বলবে, এই লোকটিই এত জঘন্য সব অপকর্মের হোতা! 

মানুষ কতটা জঘন্য হলে, কতটা নীচে নামলে সুস্থ মানুষকে গাড়িচাপা দিয়ে অসুস্থ করে ব্যবসা করতে চায়, সেটা আসলে খুবই অস্বস্তিকর একটি প্রশ্ন। তাছাড়া মানুষ কতটা অমানুষ হলে এই মহামারীকে কেন্দ্র করে প্রসারিত করতে পারে লোককে প্রতারিত করার ক্ষেত্র, সেটাও আসলে খুবই ভাববার বিষয়। এই সময়ে এসে এগুলো নিয়ে ভাবতে বসলেও বুকে একতাল পাথরের মতন চেপে বসে "হতাশা।" তাই এ প্রসঙ্গে আর কথা না বাড়ানোই ভালো। একটাই কথা বলার, বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক কারণে এদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর জনগনের আস্থা খানিকটা কম৷ আশা করতেই পারি আমরা, এই পলাতক অপরাধীকে ধরে এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে মানুষের কমে যাওয়া আস্থাকে আবার ফিরিয়ে আনবেন তারা। সে সাথে এটাও প্রত্যাশা থাকবে, তার রাজনৈতিক পরিচয় যাতে তার জন্যে কোনো "বর্ম" হয়ে না আসতে পারে। এরকম ঘৃন্য মানুষদেরকে ঠিকঠাকভাবে শাস্তি দেয়া গেলে, সেটা বাকিদের জন্যেও একটা দৃষ্টান্ত হিসেবে থেকে যাবে। সমাজের "পাপ" আরেকটু হলেও কমবে৷ এটাই শুধুমাত্র চাওয়া,  সময়ের এই চলকে এসে। 

*

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা