"চেহারা পরিবর্তনের জন্য চুলে রঙ করেছিল সাহেদ, কেটে ফেলেছিল গোঁফ। বোরকা পরে নৌকায় করে পাশের দেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় ছিলেন সে। আর কিছুক্ষণ দেরি হলে হয়ত তাকে আর পাওয়া যেত না..."

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যখন হন্যে হয়ে খুঁজছে রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদক, তখন স্ত্রীর সঙ্গে ফোনালাপে পালিয়ে থাকা সাহেদ বলেছিল, সে যসখানেই আছে, নিরাপদে আছে। তার সেই 'নিরাপদে' থাকার কাল শেষ হয়েছে আজ ভোরে, সাতক্ষীরার সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় তাকে গ্রেফতার করেছে র‍্যাব। 

সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার কোমরপুর গ্রাম, সীমান্তের লাগো এই গ্রামটা সুন্দরবনের কোল ঘেঁষেই অবস্থিত। লবঙ্গবতী নামের নদীটা পার হয়ে কিছুদূর গেলেই ভারতীয় সীমান্ত। সীমান্তে কড়াকড়ি থাকলেও, এই অংশ দিয়ে পার হওয়া যায়, চোরাকারবারিরাই পার হয় নিয়মিত। বিজিবি-বিএসএফের চোখ ফাঁকি দিয়ে এই সীমান্ত ব্যবহার করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার ছক কষেছিল প্রতারক সাহেদ। কেউ যাতে তাকে চিনতে না পারে, এজন্য বোরখা পরে মহিলার বেশ ধরে চলাফেরা করছিল সে, বোরখা পরেই সীমান্ত পাড়ি দেয়ার পরিকল্পনা ছিল তার। একবার ভারতের মাটিতে পা রাখতে পারলে বাস্তবায়িত হয়েই যেত তার প্ল্যান। 

সংবাদ সম্মেলনে র‍্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ক্ষণে ক্ষণে অবস্থান পরিবর্তন করছিল ধুরন্ধর সাহেদ। চেহারা পরিবর্তনের জন্য চুলে রঙ করেছিল সে, কেটে ফেলেছিল গোঁফ। নৌকায় করে নদী পার হয়ে চলে যাচ্ছিল সাহেদ। র‍্যাবের কাছে তার অবস্থানের ব্যাপারে তথ্য আসার সঙ্গে সঙ্গেই অভিযান চালানো হয়। র‍্যাবের বিশেষ টিম পৌঁছানোর পর সে পালানোরও চেষ্টা করে। র‍্যাবের টিম দেখে সাহেদকে বহনকারী নৌকার মাঝি সাঁতরে পালিয়ে যায়। কিন্তু সাঁতার না জানায় দৌড়ে কিংবা সাঁতরে পালাতে পারেনি প্রতারক সাহেদ। এ সময় তার পরনে ছিল কালো রঙের বোরকা।

র‍্যাবের হাতে গ্রেফতারের পর সাহেদ

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ জানান, “বোরকা পরে নৌকায় করে পাশের দেশে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টায় ছিলেন সাহেদ। আর কিছুক্ষণ দেরি হলে হয়ত তাকে আর পাওয়া যেত না। সাহেদ ভারতে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছিল। এর আগেও একবার একই সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালিয়েছিলো। বিশেষ হেলিকপ্টার যোগে তাকে ঢাকায় আনা হচ্ছে।" 

গ্রেফতারের পর তোলা ছবি এবং ভিডিওতে দেখা গেছে, সাহেদের গায়ের বিভিন্ন জায়গায় লেগে ছিল কাদা। কোমরে বাঁধা ছিল পিস্তল। সাহেদের কাছ থেকে গুলিসহ একটি পিস্তল উদ্ধার করেছে র‍্যাব। নীল রঙের শার্টের ওপর কালো বোরকা পরে ছিলেন সাহেদ।

রিজেন্ট হাসপাতালে র‍্যাবের অভিযানের পর গা ঢাকা দিয়েছিল কখনও রাজনীতিবিদ, কখনও ব্যবসায়ী কিংবা সাংবাদিক পরিচয় দেয়া সাহেদ। সে সময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোনও দিয়েছিল সে। কিন্তু আত্মসমর্পণের আহ্বানে সাড়া দেয়নি। গ্রেফতার এড়াতে বেশ কয়েকদিন ঢাকা শহরের ভেতরেই এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছে সে, এক জায়গায় স্থির থাকেনি। এরমধ্যে, করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যায় সাহেদের বাবা। কিন্তু তখনও সাহেদ প্রকাশ্যে আর আসেনি।

গ্রেফতারের পর সাহেদ

সাহেদের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা সাতক্ষীরায়। সীমান্তবর্তী সেই এলাকা দিয়েই ভারতে পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করেছিল সে। এর আগেও একবার গ্রেফতার এড়াতে এভাবেই ভারতে পাড়ি জমিয়েছিল সে। তবে যেভাবে সাহেদের একের পর এক অপকর্ম সামনে আসছিল, পাশাপাশি তার সঙ্গী-সাথীরা গ্রেফতার হচ্ছিল, তাতে এই প্রতারক যে বেশিদিন পালিয়ে থাকতে পারবে না, সেই ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন অনেকেই। সেই সঙ্গে কেউ কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, রাঘব-বোয়ালদের নাম যাতে সামনে না আসে, এজন্য সাহেদকে সরিয়েও দেয়া হতে পারে! তবে সেই আশঙ্কা বাস্তবে রূপ পায়নি।   

সরকারের মন্ত্রী, এমপি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তা এবং সরকারি আমলাসহ গুরুত্বপূর্ণ বহু ব্যক্তির সঙ্গে তোলা অসংখ্য সেলফি নিজের ফেইসবুক পেইজে দিয়ে রেখেছে সাহেদ। এর মধ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে ‘ভিআইপিদের’ মধ্যে তার উপস্থিতির ছবিও আছে। ২০১৬ সালে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ কমিটির সদস্য হওয়ার মধ্য দিয়ে সরাসরি সে রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে যায়। টেলিভিশন টকশোতে তাকে নানা বিষয়ে জ্ঞানের সবক দিতে দেখা যেতো, আওয়ামী লীগের নানা কাজকর্মকে সে যেভাবে ডিফেন্ড করতো, দেখে মনে হতো, শেখ হাসিনার চেয়েও বড় আওয়ামী লিগার বুঝি এই লোক! 

গত ৬ জুলাই সোমবার র‌্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত রিজেন্ট হাসপাতালের দুটো শাখায় অভিযান চালায়। বিভিন্ন অভিযোগের কারণে শাখা দুটির কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়া হয়। পরদিন বিকেলে উত্তরায় রিজেন্টের প্রধান কার্যালয় সিলগালা করে দেয় র‌্যাব। তখনই রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মোঃ সাহেদের নানা অপকর্মের ফিরিস্তি সামনে আসে। করোনা পরীক্ষা না করেই সার্টিফিকেট প্রদানসহ বিভিন্ন অভিযোগে রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে মামলা করে র‌্যাব। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এর আগেও সাহেদের নামে পঞ্চাশটির বেশি মামলা চলমান আছে, যার বেশিরভাগই প্রতারণামূলক। সাহেদের গ্রেফাতারের পর তার মতো প্রতারকের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের এত দহরম-মহরমের রহস্যটা খোলাসা হবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

প্রিয় পাঠক, চাইলে এগিয়ে চলোতে লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই লিংকে ক্লিক করে- আপনিও লিখুন


শেয়ারঃ


এই বিভাগের আরও লেখা